কেন পেছন ফিরে দেখারও প্রয়োজন আছে
০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আগের কথায় ফিরে আসি। ঢাকার আরো কিছু উন্নয়ন যেমন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পিজি হাসপাতাল, পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ ঢাকা ডেন্টাল কলেজ এন্ড হাসপাতাল (আগষ্ট ১৯৬১), হোটেল শেরাটন, বীমা, চা, পাট, লবণ, চিনি, রবার এবং কাগজ শিল্প, নানা জাতের কুঠির ও মৃৎশিল্পে পাকিস্তানের সময় কখনো ধস নামেনি। তখন শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থা আজকের মতো বাণিজ্যিক হয়নি। বিগত দুই দশক ধরে এবং চলমান কোচিং ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো মানুষের পকেট কাটার বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৭১ এর পর উন্নয়নের মধ্যে দেখেছি ভূমি কেনাবেচা এবং ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা আবাসন প্রকল্প। বিদেশি পণ্য এনে বাজারজাতকরণের কোম্পানি, ইনডেন্টিং ফার্ম এবং শপিং মল নির্মাণ করেছি। আর কিছু এনজিও। নিজস্ব মেধা ও প্রযুক্তি প্রয়োগ করে ভারী মিল-কারখানা বা শিল্প গড়ে তুলতে পারিনি। অর্থাৎ সস্তা উপায়ে অধিক মুনাফা অর্জনের পথটিকে বেছে নিয়েছি। আমদানিনির্ভর দেশ কখনো স্বনির্ভর হতে পারে না। এ কারণে দীর্ঘ ৫৪ বছরে যে জায়গায় দেশটির থাকার কথা ছিলো সেটা সম্ভব হয়নি। পাকিস্তান আমলে যেগুলো ছিলো সেবা, এখন সেগুলে হয়েছে বাণিজ্য। যেমন শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্যপণ্য এবং আবাসন।
এবার চট্টগ্রামের দিকে একটু নজর দেই, যেখানে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় অতিবাহিত হয়েছিল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি অনার্সসহ মাস্টার্স করেছি। প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক-বাহক প্রসিদ্ধ সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম সরকারি উইমেন কলেজ, সরকারি ‘ল’ কলেজ, চিটাগাং স্টিল মিলস, স্টিল এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনের বড় বড় লৌহ ও ইস্পাত শিল্প চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ ও ফৌজদারহাটে গড়ে উঠেছিল। ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ এবং আধুনিক মানের গাড়ি কারখানা, পতেঙ্গা তেল শোধনাগার, পতেঙ্গা পোর্ট, চট্টগ্রাম স্টেডিয়াম, ঐতিহাসিক লালদিঘি ময়দান, ঐতিহাসিক জামে মসজিদ আন্দরকিল্লা,পুলিশ হেডকোয়ার্টার, জজকোর্ট, চট্টগ্রামের সর্ব বৃহৎ পাইকারি বাজার যেমন, আসাদ গঞ্জ, খাতুন গঞ্জ, রিয়াজুদ্দিন বাজার, পাথর ঘাটা, আন্দরকিল্লা, সিরাজদৌলা রোড ইত্যাদি বাজার পাকিস্তান আমলে গড়ে উঠেছে।
পাকিস্তানের শাসনকালে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থানটা পরিষ্কার করা দরকার। কারণ, বর্তমান বাংলাদেশের মানুষ বলে পাকিস্তান আমাদের শুধু শোষণ করেছে এবং শাসন ক্ষমতাও দেয়নি, এমনকি পূর্ব বাংলায় কোনো উন্নয়নও করেনি। সে বিষয়ে কিছু আলোকপাত করা দরকার। ১৯৪৮ সালে জিন্নাহর মৃত্যুর পর বাঙালি নেতা স্যার খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। ১৯৫১ সালে নবাবজাদা লিয়াকত আলি খান একটি বিশাল জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময় আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে খাজা নাজিমুদ্দিন দ্বিতীয়বার গভর্নর জেনারেল ও প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলি বগুড়া প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ প্রাপ্ত হন। এর পর বাঙালি নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হন।
উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৪০ সলে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক সাহেব লাহোরে প্রথম পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপন করেন পাকিস্তান আন্দোলনে লড়াকু ভূমিকা পালন করেন। তার আরো উল্লেখযোগ্য দায়িত্ব ছিলো যেমন পূর্ব বাংলার অ্যাডভোকেট জেনারেল (১৯৪৭-১৯৫২), পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী (১৯৫৪), পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (১৯৫৫-১৯৫৬) এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর (১৯৫৬-১৯৫৮)। খুলনার সবুর খাঁ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। খুলনার বহুমুখী উন্নয়নে তার যথেষ্ট অবদান ছিলো। এবার পাকিস্তানের দুইজন প্রভাবশালী ব্যক্তি জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন, যারা বাঙালি ছিলেন। শাহেদ আলী পাটোয়ারী ১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ও পরিষদের ডেপুটি স্পিকার ছিলেন। স্পিকারের চেয়ারে বসা অবস্থায় তৎকালীন আওয়ামী লীগের হামালার শিকার হয়ে মৃত্যু বরণ করেন। আইয়ুব খানের শাসনামলে (১৯৫৮-১৯৬৮) সালে পূর্ব পাকিস্তানের নেতা হিসেবে আমরা পেয়েছি জাতীয় পরিষদের স্পিকার ফজলুল কাদের চৌধুরীকে। তার জীবনের শেষ ভাষণ দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম লালদিঘী ময়দানে। আমি কৌতূহলবশত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্রাম কারে করে এসেছিলাম তার ভাষণ শুনতে। জানতাম, চট্টগ্রামে তার জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। এতো মানুষের সমাগম আগে কখনো দেখিনি। মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ। গাছে মানুষ ছাদে মানুষ। যে দিকেই তাকাই শুধু মানুষ আর মানুষ। জনশ্রুতি আছে, চৌধুরী সাহেব লৌহমানব হিসেবে চট্টগ্রামবাসীর কাছে বিশেষভাবে পরিচিত এবং জনহিতকর কাজেও তার যথেষ্ট সুনাম ছিল। তিনি একজন সাহসী ও সুবক্তা হিসাবে দেশ-বিদেশে প্রচুর সুনাম অর্জন করেছিলেন। চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী পত্রিকায় লিড নিউজ দেখেছিলাম ফজলুল কাদের চৌধুরী নিজেই শতাধিকের উপর মুক্তিযোদ্ধাকে জেল থেকে বের করে আনেন, আবার তাদের নিয়ে শহরে মিছিলও করেন। আসলে তিনি যে জনদরদী নেতা সেটা তার কর্মকা-ে আরো স্পষ্টতরভাবে প্রমাণ মেলে। তার বক্তৃতার একপর্যায়ে তিনি বলেন, কাগজ-কলম বা ডাইরি থাকলে আমার কথাগুলো আপনারা লিখে রাখুন, ভারত তার চতুর্পার্শ্বের নির্মিত বাঁধগুলি খুলে দিয়ে এমনভাবে পানি ছাড়বে, যাতে গোটা বাংলাদেশ তলিয়ে যায়। যখন আমাদের পানি প্রয়োজন হবে, তখন পানি আটকিয়ে আমাদের শুকিয়ে মারবে। ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী কালচার এমনভাবে মিডিয়ার মাধ্যমে মনোজগতে ঢুকিয়ে দেয়া হবে, তখন আমাদের সন্তানরা আর সত্যিকার মুসলমান থাকবে না। ৫৪ বছর সেটাই আমরা দেখছি। ভারতের ষড়যন্ত্রের মূল থিম হলো: ভারতের চতুর্পার্শ্বের প্রতিবেশী কোনো দেশ শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক, এটা কখনো ভারত চাইবে না। এজন্য বাংলাদেশ যাতে ভারতের আজ্ঞাবহ একটি অঙ্গ রাজ্য হিসাবে ‘ওঠ বস’ করার মতো অবস্থায় পরিণত হয়, যা বিগত ৫৪ বছর ধরে চলমান, প্রক্রিয়াধীন আছে। এ জন্যই ভারত ১৯৭১ সালে স্বীয় সুবিধার্থে পূর্ব বাংলার মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। উল্লেখ্য, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদ বলেছিলেন, পাকিস্তানের মানুষ যেদিন থেকে ভারতকে ঘৃণা করবে না সেদিন পাকিস্তান ভেঙ্গে যাবে। আর তাই হয়েছিল। বাঙালিরা যেদিন থেকে ভারতকে বন্ধু ভাবা শুরু করলো তখন পাকিস্তান ভেঙে গেল। হিসাব-নিকাশ করলে যে অর্থ দাঁড়াবে তা হলো: উপমহাদেশে পাকিস্তানের শক্তিকে খর্ব করা ভারতের একছত্র আধিপত্য এবং একচেটিয়া বাজার সম্প্রসারণ করাই ছিলো ভারতের মূল টার্গেট। মওলানা আবুল কালাম আজাদের সেই দিনের কথাগুলি আজ হুবহু মিলে গেছে। (সমাপ্ত)
লেখক: গ্রন্থকার, গবেষক ও সমাজ বিশ্লেষক।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
গাজীপুরে থানায় ব্যবসায়ীকে আটক করে ২ লাখ টাকা ঘুষ নিলো ওসি
রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র অফিস অবরোধের ঘোষণা চাকরি বঞ্চিতদের
শামীম ওসমান-নানক পরিবারের বিরুদ্ধে দুই মামলা
বায়ু দূষণে আবারও শীর্ষে ঢাকা
এক মাসের মধ্যে সংস্কারের রোডম্যাপ দিবে সরকার: পরিবেশ উপদেষ্টা
দেশে ফিরেই ছিনতাইয়ের শিকার মালয়েশিয়া প্রবাসী ডালিম
বিপিএল শেষ কর্নওয়ালের
ওয়াটসাপ, টেলিগ্রাম বা বিভিন্ন সোশ্যাল মাধ্যমে মেসেজ দিয়ে দেওয়া সালামের জওয়াব দেওয়া প্রসঙ্গে?
আরচ্যারী ফেডারেশনের তারুণ্যের উৎসব কর্মসূচি শুরু
বেনাপোলে আড়াই বছর পর কবর থেকে তোলা হলো বিএনপি নেতা আলিমের লাশ
রাষ্ট্রের কল্যাণে উপসচিব পদে কাকে প্রয়োজন: নীতি ও ন্যায্যতা কী
ধূমপানকে না বলুন
জালিমের পরিণতি ভালো হয় না
অখণ্ড ভারতের নীলনকশা এবং মুখোশপরা গণশত্রুদের দাস্যবৃত্তি
মাজারে হামলা ও উগ্রপন্থা কাম্য নয়
১২ কোটি জনসংখ্যার ৭ কোটি আক্রান্ত
শেষ তিন মাসে রেকর্ড বাজেট ঘাটতি যুক্তরাষ্ট্রের
সিরিয়া সীমান্তে কুর্দিদের নিয়ে তুরস্কের উদ্বেগ বৈধ : যুক্তরাষ্ট্র
বিশ্ব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একত্রে কাজ করলেই সফল হবে জাতিসংঘ
এলোপাতাড়ি গোলাবর্ষণে ১২০ নিহত সুদানে