ভারতবিমুখ রোগী ও পর্যটক

Daily Inqilab ইনকিলাব

০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন এবং ভারতে তাকে আশ্রয় দেয়া নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ ভারতের ওপর খুবই ক্ষুব্ধ। অন্যদিকে, শেখ হাসিনার পতন মেনে নিতে না পেরে ভারতের মোদি সরকার তথাকথিত হিন্দু নির্যাতনের কথা বলে বাংলাদেশের ওপর বেশ আক্রোশ ঢেলে দিয়েছে। বাংলাদেশ ও অন্তর্বর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল ও ব্যর্থ করে দিতে মোদি ও হাসিনা একের পর এক ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করে যাচ্ছেন। হিন্দু নির্যাতনের অজুহাতে নানা ষড়যন্ত্র করেছে এবং করছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ভারতে বাংলাদেশিদের ট্যুরিস্ট ও মেডিক্যাল ভিসা নিয়ন্ত্রণ ও আমদানি-রফতানি হ্রাস করেছে। ফলে ভারতে এসব খাতে ধস নেমেছে। তার ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে উঠতে বসেছে। প্রতিবছর ভারতে দুই লাখেরও বেশি বাংলাদেশি পর্যটনে যায়। ভারতে যাওয়া পর্যটকদের মধ্যে বাংলাদেশিদের অবস্থান দ্বিতীয়। তারা ভারতের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখছে। তবে ভিসা নিয়ন্ত্রণ এবং বাংলাদেশের সাথে দেশটির হিংসাত্মক ও বৈরি আচরণের কারণে বাংলাদেশিরা এখন ভারত বিমুখ হয়ে পড়েছে। দেশটিতে ভ্রমণে তারা নিরাপদ বোধ করছে না। ফলে দিল্লী, আগ্রা, কলকাতা, শিলিগুড়ি, আসাম, সিকিম, শিলংসহ ভারতের অন্যান্য স্থানে বাংলাদেশীদের ভ্রমণ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে। এ নিয়ে সেখানের হোটেল-মোটেল, পরিবহন খাতে হাহাকার চলছে। বাংলাদেশী পর্যটকরা শুধু ভ্রমণেই ভারত যেত না, সেখানে তারা বেড়ানোর পাশাপাশি বিপুল কেনাকাটাও করত। এই কেনাকাটার পরিমাণ বছরে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার। কলকাতার ব্যবসায়ীরা মূলত বাংলাদেশের ক্রেতাদের টার্গেট করে ব্যবসা করে। তারা সারাবছর বাংলাদেশী ক্রেতাদের জন্য অপেক্ষায় থাকে। বাংলাদেশী ক্রেতা না থাকায় এখন তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। চিকিৎসা সেবা নেয়ার জন্য ভারতে প্রতিবছর প্রায় ২৫ লাখের বেশি বাংলাদেশি যেত। প্রতিমাসে ভারত গড়ে ২৫ হাজার মেডিক্যাল ভিসা ইস্যু করত। এখন তা কমে হয়েছে ৭০০’র মতো। এর মধ্যে বেশির ভাগই পুরনো রোগী। ভারতে চিকিৎসা নিতে গিয়ে বাংলাদেশি রোগীরা বছরে খরচ করত ৫০০ মিলিয়ন ডলার, যা ভারতের অর্থনীতিতে ২.৫ শতাংশ অবদান রাখত। তথাকথিত হিন্দু নির্যাতনের কথা বলে ভারত বাংলাদেশের প্রতি যে আক্রমণাত্মক ও বিদ্বেষমূলক আচরণ করছে, তাতে বাংলাদেশের মানুষ ক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদমুখর হয়ে ভারতে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছে।

ভারতের বৈরি আচরণের কারণে বাংলাদেশি পর্যটক, ক্রেতা ও রোগী এখন বিকল্প দেশ খুঁজে নিয়েছে। তাদের নতুন ডেশটিনেশন হয়েছে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, নেপাল, মালদ্বীপ, ভুটান, চীনসহ বিভিন্ন দেশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি পর্যটন ও চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডমুখী হয়েছে। পত্র-পত্রিকার সংবাদ থেকে জানা যায়, ৫ আগস্টের পর থেকে থাইল্যান্ডে বাংলাদেশীদের গমনের হার শতকরা ২০ ভাগ বেড়েছে। ঢাকা থেকে থাইল্যান্ড যে ১৪টি বিমান পরিচালনা করে সেগুলোতে আগে সিঠ ফাঁকা থাকলেও এখন সিট পাওয়া যায় না। থাইল্যান্ড সরকারও বাংলাদেশিদের আগমন সহজ করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশিরাও সহজ ভিসা, স্বল্প সময় ও কম বিমান ভাড়া, উন্নত চিকিৎসা, সুলভ মূল্যে থাকা-খাওয়া, আকর্ষণীয় পর্যটন, প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকসহ নিরাপত্তার কারণে এখন তারা থাইল্যান্ডমুখী হয়েছে। রোগীরা ভারতের চেয়েও ২০ থেকে ২৫ পার্সেন্ট কম খরচে উন্নত চিকিৎসা পাচ্ছে। কোনো কোনো হোটেল ভাড়াও ভারতের চেয়ে কম। ফলে বাংলাদেশীরা এখন ভারতের চেয়ে থাইল্যান্ড বেশি যাচ্ছেন। বাংলাদেশিদের প্রতি ভারতের বিরূপ আচরণের কারণে তারা শুধু থাইল্যান্ড নয়, পাকিস্তান, চীন, সিঙ্গুপুর, মালদ্বীপ, ভুটান, নেপালসহ অন্যদেশগুলোর প্রতি বেশি ঝুঁকেছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশগুলো বাংলাদেশি পর্যটক ও রোগীদের জন্য নানা সুযোগ-সুবিধার উদ্যোগ নিয়েছে। পাকিস্তান বাংলাদেশের সাথে সরাসরি বিমান চালু করতে যাচ্ছে। দেশটিতে বাংলাদেশীদের আকর্ষণ করতে পর্যটন, চিকিৎসা ও কেনাকাটার সুবিধা বৃদ্ধি করছে। অন্যদেশগুলোও বাংলাদেশি পর্যটক টানতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে বাংলাদেশিদের জন্য ভারতের বিকল্প বহু নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। দেশে এখন পর্যটন মৌসুম চলছে। গতকাল দৈনিক ইনকিলাবের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্য বছরের তুলনায় এবার মৌসুমের শুরুতেই কক্সবাজার, সিলেট, কুয়াকাটা, বান্দরবানসহ দেশের পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে বিপুল পর্যটকের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে। হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউস, রিসোর্টগুলো আগাম বুকিং হয়ে গেছে। হোটেল-মোটেল মালিক সমিতি জানিয়েছে, অধিকাংশ হোটেল-মোটেল অগ্রীম বুকিং হয়ে গেছে। ১ ডিসেম্বর থেকে সেন্টমার্টিনে যাওয়া-আসার জাহাজ চালু হওয়ায় দিন দিন পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোর চেয়ে এবার সবচেয়ে বেশি পর্যটকের সমাগম হবে বলে তারা আশা করা হচ্ছে। পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও বিশেষ পরিকল্পনা নিয়েছে। কক্সবাজার পুলিশ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার পাশাপাশি পর্যটকদের সুবিধার্থে অনলাইন বাস টার্মিনাল, কক্স ক্যাবসহ অনলাইন হোটেল বোর্ডার ইনফরমেশন সেন্টার চালু করেছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছে, বাংলাদেশের সাথে ভারতের শত্রুতামূলক আচরণের কারণে বাংলাদেশীরা ভারতবিমুখ হয়েছে। এতে বাংলাদেশের লাভ হয়েছে। ভারত ছাড়া অন্য দেশগুলোর সাথে পর্যটন ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক যেমন দৃঢ় হচ্ছে, তেমনি বাংলাদেশের চিকিৎসা, কেনাকাটা ও পর্যটন খাতও সমৃদ্ধ হচ্ছে। কয়েক বছর আগে ভারত কোরবানির গরু বন্ধ করে দেয়ায় বাংলাদেশের খামারিরা স্বউদ্যোগে গরু লালন-পালন করে ডেইরি খাতকে স্বাবলম্বী করে তুলেছে। এখন কোরবানির চাহিদা পূরণ করেও পশু উদ্বৃত্ত থেকে যাচ্ছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, ভারত বাংলাদেশের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য সীমিত করায় শাপে বর হবে। যেসব কৃষিপণ্য ভারত থেকে আমদানি করা হতো, সেগুলো উৎপাদনে কৃষকরা এখন অনেক বেশি তৎপর হবে। পেঁয়াজ থেকে শুরু করে অন্য কৃষিপণ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করে খাতগুলোকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলবে।

ভারতের আধিপত্যবাদ ও দাদাগিরি যে বাংলাদেশের মানুষ কখনোই পছন্দ করেনি, তা ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে। শেখ হাসিনার মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের উপর যে খবরদারি করত, তা হারিয়ে সে এখন উন্মাদের মতো আচরণ করছে। এতে প্রথমবারের মতো দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের স্বার্থে এবং ভারতের আগ্রাসণের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দল, মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সকলেই ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশ যে আর ভারতের মাতব্বরি সহ্য করবে না, তা বুঝিয়ে দিয়েছে। ভারতকে তা বুঝে পারস্পরিক সমতা ও সমস্বার্থভিত্তিক সম্পর্ক সৃষ্টিতে এগিয়ে আসতে হবে। তাকে বুঝতে হবে, বাংলাদেশে আর কখনোই হাসিনার মতো তার দাস হয়ে থাকা কেউ ক্ষমতায় আসবে না। বাংলাদেশের জনগণ তা হতেও দেবে না। ইতোমধ্যে বাংলাদেশিরা ভারতীয় পণ্যবর্জন ও ভারতবিমুখ হয়ে তা বুঝিয়ে দিয়েছে। পর্যটন, চিকিৎসা, কেনাকাটার জন্য তারা ভারতকেই একমাত্র গন্তব্যস্থল ভাবছে না। তারা বিকল্প গন্তব্য খুঁজে নিয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে, সরকারের উদ্যোগ যেমন থাকতে হবে, তেমনি বেসরকারি খাতকেও এগিয়ে আসতে হবে। পর্যটনের ক্ষেত্রে, পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে মসৃণ যাতায়াত ব্যবস্থা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ থাকা-খাওয়ার আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। পর্যটন খাতকে সরকারকে অর্থনীতির নতুন ক্ষেত্র হিসেবে গুরুত্ব দিতে হবে। সরকারি হাসপাতালে শৃঙ্খলা ও উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা ব্যয় কমানোসহ উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করে রোগীদের আস্থা অর্জন করতে হবে, যাতে তারা বিদেশমুখী না হয়।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বেপরোয়া গাড়ি চালানো বন্ধ হোক
জিয়া : স্বাধীনতার ঘোষক
আমাদের পথ
পাহাড়িদের নিয়ে ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে
স্মার্টফোনের দাসত্ব থেকে মুক্তির উপায়
আরও

আরও পড়ুন

মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে : তারেক রহমান

মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে : তারেক রহমান

ঋণখেলাপিরা যাতে মনোনয়ন না পায় চেষ্টা করবো : মির্জা ফখরুল

ঋণখেলাপিরা যাতে মনোনয়ন না পায় চেষ্টা করবো : মির্জা ফখরুল

অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর না হলে রাজনৈতিক সংস্কার টেকসই হবে না : বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি

অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর না হলে রাজনৈতিক সংস্কার টেকসই হবে না : বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি

টিসিবি’র এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডধারীর মধ্যে ৩৭ লাখই ভুয়া: বাণিজ্য উপদেষ্টা

টিসিবি’র এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডধারীর মধ্যে ৩৭ লাখই ভুয়া: বাণিজ্য উপদেষ্টা

ভোজ্যতেলের সরবরাহ নিশ্চিতে কারখানা পরিদর্শন ভোক্তা অধিকারের

ভোজ্যতেলের সরবরাহ নিশ্চিতে কারখানা পরিদর্শন ভোক্তা অধিকারের

গণপরিবহনে শৃঙ্খলায় কাউন্টার স্থাপনের পরিকল্পনা

গণপরিবহনে শৃঙ্খলায় কাউন্টার স্থাপনের পরিকল্পনা

রাজধানীর তিন পার্কে ভেন্ডারের চুক্তি : শর্ত ভঙ্গের তদন্তে ডিএনসিসি

রাজধানীর তিন পার্কে ভেন্ডারের চুক্তি : শর্ত ভঙ্গের তদন্তে ডিএনসিসি

বাবা-মায়ের পুরোনো বাড়িতে যাই : শফিকুল আলম

বাবা-মায়ের পুরোনো বাড়িতে যাই : শফিকুল আলম

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসায় ১৫০ কোটি টাকা অনুদান

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসায় ১৫০ কোটি টাকা অনুদান

২০২৪ সালে ৩১০ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

২০২৪ সালে ৩১০ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

ভারতীয় ৭২ গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে অপতথ্য প্রচার

ভারতীয় ৭২ গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে অপতথ্য প্রচার

লেবানন থেকে দেশে ফিরলেন আরো ৪৭

লেবানন থেকে দেশে ফিরলেন আরো ৪৭

প্লাটফর্ম বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত

প্লাটফর্ম বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত

শক্তিশালী অর্থনীতি ও গর্বিত জাতি গড়তে শহীদ জিয়ার দর্শন ধারণ করতে হবে : আমির খসরু

শক্তিশালী অর্থনীতি ও গর্বিত জাতি গড়তে শহীদ জিয়ার দর্শন ধারণ করতে হবে : আমির খসরু

কী আছে তৌফিকার লকারে?

কী আছে তৌফিকার লকারে?

ঘটনার তিনদিন পর থানায় মামলা

ঘটনার তিনদিন পর থানায় মামলা

অনিয়ম ঢাকতে তড়িঘড়ি করে নির্বাচনের পাঁয়তারা

অনিয়ম ঢাকতে তড়িঘড়ি করে নির্বাচনের পাঁয়তারা

শেবাচিম হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের দুরবস্থা

শেবাচিম হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের দুরবস্থা

৯৬টি সিএনজি ভাঙ্গাড়ি হিসাবে সাড়ে ১১ লাখ টাকায় বিক্রি

৯৬টি সিএনজি ভাঙ্গাড়ি হিসাবে সাড়ে ১১ লাখ টাকায় বিক্রি

৩১ দফা জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে রূপগঞ্জে বিএনপির সমাবেশ

৩১ দফা জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে রূপগঞ্জে বিএনপির সমাবেশ