বেগম রোকেয়ার জীবন ও শিক্ষা দর্শন
০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম
বেগম রোকেয়া রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানাধীন পায়রাবন্ধ গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম জমিদার পরিবারে ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর জš§গ্রহণ করেন। তার পিতা জহির উদ্দীন মোহা¤মদ আবু আলী সাবের ও মাতা রাহাতুন্নেছা সাবেরা চৌধুরাণী। পিতা-মাতা তাদের পুত্রদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার ব্যবস্থা করেন। তখনকার দিনে মুসলমান সমাজে মেয়েদের আধুনিক শিক্ষার সুযোগ ছিল না। তাই তিনিও তার কন্যাদের জন্য পারিবারিক শিক্ষা ছাড়া আর কোনো শিক্ষার ব্যবস্থা করেননি। বেগম রোকেয়ার জীবনে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের সুযোগ ঘটেনি। ছোটবেলা থেকেই রোকেয়ার মধ্যে চার দেয়ালের গন্ডি পেরিয়ে মুক্ত পরিবেশে শিক্ষা লাভের অদম্য আকাক্সক্ষা জšে§। তার দুই ভাই কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়তেন এবং বোন করিমুন্নেছা পিতৃহীন সন্তানদের শিক্ষার জন্য কলকাতায় অবস্থান করতেন। রোকেয়া তাঁর বড় ভাই ইব্রাহিম সাবেরের কাছে ইংরেজি শিখেছেন। রোকেয়াকে অনুপ্রেরণা জোগাতেন তার বড় বোন করিমুন্নেছা। এভাবেই মুসলিমবঙ্গের নারীরা যখন সামাজিক বঞ্চনা ও অবিচারকে ললাট লিখন হিসেবে গ্রহণ করে ঘরের চার দেয়ালকেই আপন ভূবন মনে করেছে তখন সংগোপনে জ্ঞান সাধনায় মগ্ন ছিলেন বেগম রোকেয়া। ভাই-বোনের অনুপ্রেরণা এবং নিজের চেষ্টায় রোকেয়া ক্রমে উর্দু, ফারসি, বাংলা ও ইংরেজি প্রভৃতি ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন করেন। ষোল বছর বয়সে ১৮৯৬ সালে ভাগলপুরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবোরের সন্তান সৈয়দ সাখাওয়াৎ হোসেনের সাথে তার বিয়ে হয়।
নারীকে শিক্ষার মাধ্যমে বিকশিত করে সমাজে নারী-পুরুষের অংশীদারিত্বে সাম্য সৃষ্টি করাই ছিল রোকেয়ার লক্ষ্য। স্বামীর সামাজিক ও আর্থিক অবস্থান এবং নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি স¤পর্কে মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গী রোকেয়ার চিন্তা ও কাজের সহায় হয়েছিল। স্বল্পস্থায়ী সংসার জীবনে তিনি পড়াশোনা ও সামাজিক মেলামেশার সুযোগ পেয়েছেন। তিনি দেখেছেন সমাজে নারীরা কতটা নিগৃহীত। স্বামীর সহযোগিতায় রোকেয়া পাশ্চাত্য জীবন ধারা, গণতন্ত্রের গতি-প্রকৃতি এবং নারী সত্ত্বার বিকাশের স্তর ও পথ নির্দেশনা স¤পর্কে ধারণা লাভ করেন।
১৯০১ সালে স্বামীর মৃত্যুর অব্যবহিত পর রোকেয়া স্বামী প্রদত্ত অর্থে ভাগলপুরে মাত্র পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু চক্রান্তের শিকার হয়ে তিনি মিশনারীদের চর হিসাবে সামাজিকভাবে নিন্দিত হন। হতাশা অনিশ্চয়তা ও ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ১৯১৯ সালে তিনি কলকাতায় আসেন। ১৯১১ সালের মার্চ মাসে একটি ভাড়া বাড়িতে তিনি আটজন ছাত্রী নিয়ে আবার শুরু করেন সাখওয়াত বালিকা বিদ্যালয়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি নিয়ে আসেন মেয়েদের। মেয়েদের প্রতিষ্ঠা এবং প্রকৃত যোগ্যতাসম্পন্ন করে তোলার মানসে তিনি শিক্ষাকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন। অভাবনীয় আর্থিক অসুবিধা, নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রদত্ত সামাজিক বাধাকে সামনে রেখে তার বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও কিছু কিছু মানব হিতৈষীর সহযোগিতায় তার প্রতিষ্ঠিত স্কুল শক্তি লাভ করে।
স্বশিক্ষিত রোকেয়াকে বিদ্যালয়ের অপর্যাপ্ত আর্থিক সংস্থানের মধ্যে মেয়েদের জ্ঞান দক্ষতা বিকাশে তাকে রাত দিন খাটতে হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানব জাতি পুরুষ ও নারীর মিলিত ধারারই ফল। পুরুষ ও নারীর সম্মিলনে গঠিত বৃহত্তর মানবগোষ্ঠী একে অন্যের সহযোগী, পরিপূরক। এ মানবিক দর্শনকে সামনে রেখে নিগৃহীত ও পিছিয়ে পড়া নারী সমাজের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যই তার শিক্ষা প্রচেষ্টা শুরু হয়। নারী সমাজকে উচ্চ জীবনবোধে উজ্জীবিত করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। নারীর মানসিক বিকাশে শিক্ষামূলক সমাজ, সংস্কারমূলক ধর্ম গ্রন্থের সমর্থক ব্যাখ্যামূলক গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ও ব্যঙ্গ রচনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তার শানিত লেখনী কখনও কখনও পুরুষশাসিত সমাজকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেছে। এতদসত্ত্বেও তার লেখার উদ্দেশ্য ছিল নারী বিশেষ করে বাংলার পশ্চাৎপদ মুসলিম নারী সমাজকে মানবিক চেতনা ও অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করা এবং পুরুষকে নারীর অগ্রগতির অন্তরায়সমূহ অনুধাবনে সাহায্য করা। রোকেয়া রচিত সাহিত্যের সংখ্যা বিপুল না হলেও প্রত্যেকটি অত্যন্ত তাৎপর্যম-িত। তার রচিত গ্রন্থের সংখ্যা পাঁচ। এছাড়াও সমাজ সেবামূলক বিভিন্ন সমিতির কাজের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। ১৯১৬ সালে তিনি ‘আঞ্জুমান-ই-খাওয়াতিনে ইসলাম’ বা ‘মুসলিম মহিলা সমিতি’ গঠন করেন। নিরক্ষর ও দরিদ্র নারীদের আত্মনির্ভরতা অর্জনের বহুমুখী উন্নতি বিধান এ সমিতির উদ্দেশ্য ছিল। বেগম রোকেয়া নারীর লাঞ্ছনা অত্যন্ত নিকট থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। তার নিজ সমাজে মেয়েদের চলাফেরা ও শিক্ষায় কোনো স্বাধীনতা ছিল না। একজন নারী পুরুষের মতো পরিবারের সদস্য হয়েও ছিল পুরুষের অধীন এবং পুরুষ রচিত বিধিনিষেধ তাকে মানতে হতো। তিনি নারীর মর্মবেদনা ও নারীর চাহিদা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন। তিনি তার কর্মজীবনে সহযোগিতা যেমন পেয়েছেন, তেমনি বাধাও পেয়েছেন প্রচুর। প্রবল প্রতিরোধের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি নারীর অগ্রযাত্রার পথ নির্মাণে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। এ মহিয়সী মহিলা ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর কলকাতায় ইন্তেকাল করেন।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যতিরেকেই নারী শিক্ষার চাহিদা ও প্রয়োজন সম্পর্কে সুপষ্ট উপলব্ধি, শিক্ষাক্রম ও শিক্ষাদান বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা এবং বিদ্যালয় পরিচালনে সাংগঠনিক দক্ষতা ও জনসংযোগে কুশলী হওয়ার কারণে রোকেয়ার ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল বালিকা বিদ্যালয়’ সকল প্রতিকূলতাকে জয় করে। এ কারণেই বেগম রোকেয়ার শিক্ষা প্রচেষ্টা ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। তিনি এ বিশ্বাসে স্থিত ছিলেন যে, নারী শিক্ষার অগ্রযাত্রায় পরাজয়ের কোনো স্থান নেই। বেগম রোকেয়া তার স্বপ্নের নারীকে প্রথমে নারী এবং তারপর মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় সকল দক্ষতার অধিকারী করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তার নিজের গার্হস্থ্য বিজ্ঞান, পারিবারিক স্বাস্থ্যরক্ষা ও পুষ্টিবিজ্ঞানে ছিল অবাধ জ্ঞান।
রান্নায়, গৃহসজ্জায় তিনি ছিলেন পটু। রোকেয়া তাঁর ‘সুগৃহিণী’ প্রবন্ধে ঐ সকল মহিলা যারা স্বল্প শ্রমে, স্বল্প ব্যয়ে ও স্বল্প সময়ে ঘরকন্নার কাজ নিপুণভাবে করতে পারে তাদের রুচিশিল বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি মনে করেন, সুগৃহিণী হওয়ার নিমিত্তে সুশিক্ষা আবশ্যক। তাই বালিকাদের শিক্ষার জন্য তিনি শিশু পালন, পুষ্টিবিজ্ঞান, উদ্যানতত্ত্ব ও উদ্যানরচনাকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে বিবেচনা করেন। মতিচুর গ্রন্থের ‘গৃহ’ প্রবন্ধে তিনি গৃহকে মানুষের শারীরিক আরাম ও মানসিক শান্তিনিকেতন হিসেবে দেখিয়ে সেখানে নারীর নিজস্ব অধিকার প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়েছেন।
রোকেয়া শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মুখস্থ করানোর পদ্ধতিকে ঘৃণার চোখে দেখতেন। ধর্ম শিক্ষায় পবিত্র কুরআনের মর্মার্থ অনুশীলন ও অনুধাবনের ওপর তিনি জোর দিয়েছেন। নীতি শিক্ষা ও চরিত্র গঠনের শিক্ষায় তিনি আচরণ অনুশীলনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে তিনি ব্যবহারিক কাজের উপর জোর দেন। তার মতে, মিথ্যা ইতিহাস বা ইতিহাসের নিরেট ঘটনা পাঠ নয় বরং ইতিহাসকে জীবনের ধারার সাথে মিলিয়ে নিয়ে পাঠ করা এবং তা থেকে দেশপ্রেম শিক্ষা ও স্বাধীনতার প্রেরণা লাভ করা প্রয়োজন। বিজ্ঞানকেও তেমনি ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষাদান করতে হবে। ‘সুলতানার স্বপ্ন’ গ্রন্থে তার কল্পনার নারীকে বিজ্ঞানের জ্ঞান সম্প্রসারণে সব সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যাপৃত রেখেছেন। অন্যদিকে বিজ্ঞান শিক্ষাদানে তার বিদ্যালয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
নারী শিক্ষাকে ফলপ্রসূ করার জন্য প্রকৃতি পাঠ, বস্তু পাঠ এবং বৃত্তি শিক্ষাকে রোকেয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন। মূলত রোকেয়ার শিক্ষাদান পদ্ধতি প্রয়োগবাদী দর্শনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল যার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল নারীর শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতার বিকাশ। মোট কথা, জীবনের সঙ্গে শিক্ষার স¤পর্কায়ন ও হাতে-কলমে কাজ ছিল তার শিক্ষাদান পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ব্যাংক খাত নিপুন কারিগরের মতো যেভাবে ধ্বংস করেন এসকে সুর
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আজকের বৈঠক বর্জন করবে লেবার পার্টি
দেশে ফিরতে চান মডেল তিন্নি হত্যা মামলায় খালাস পাওয়া অভি
দুর্নীতির মাধ্যমে পুতুলের ডব্লিউএইচও'র পদ পাওয়ার অভিযোগ: দুদকের অনুসন্ধান শুরু
বাড়িতে ঢুকে সাইফ আলিকে ৬ বার ছুরিকাঘাত, হাসপাতালে ভর্তি
রাজশাহী জেলা ছাত্রদল নেতার পিতা বাচ্চু সরকারের দাফন সম্পন্ন
মোংলায় সড়কের ওপর রাখা পাথরের ধাক্কায় যাত্রীবাহী ভটভটিতে থাকা দুই যাত্রীর মৃত্যু, আহত ৪
গাজায় ঐতিহাসিক পরাজয় ইসরাইলের
১৭ বছর পর আজ দুপুরে কারামুক্ত হচ্ছেন বাবর
দীর্ঘ এক যুগ পর কারামুক্ত হলেন ডেসটিনির চেয়ারম্যান
আজ কুড়িগ্রামে মার্চ ফর ফেলানী, নেতৃত্বে সারজিস আলম
বাংলাদেশে আসছেন পাকিস্তানের জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ জেনারেল সাহির শমসদ
গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি ইসরাইলের ‘ঐতিহাসিক পরাজয়’: হামাস
যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার পরও গাজায় হামলা ইসরাইলের, নিহত অন্তত ৩০
জুলাই ঘোষণা : কারা যাচ্ছেন আজকের বৈঠকে
গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত হামাস-ইসরাইল
যে সব শর্তে গাজায় যুদ্ধবিরতি
এনসিটিবির সামনে হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার ২
নোয়াখালীর সদর উপজেলার ইউপি চেয়ারম্যান বাবলু আটক
বগুড়ায় কলেজ শিক্ষার্থী হত্যা মামলায় গ্রেফতার ৪