ভারতের বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা রুখতে হবে
০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম
ভারতের বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা সীমা ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুরা হত্যা-নিপীড়ন-ধর্ষণ ইত্যাদির শিকার, এমন অপতথ্য প্রচার করে বাংলাদেশকে বিশ্ববাসীর চোখে হেয় প্রতিপন্ন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ করাই এই মিথ্যা-বানোয়াট প্রচারণার মূল লক্ষ্য। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর ভারতের গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা শুরু হয়, যা পরবর্তীতে বৃদ্ধি পায়। ইসকনের সাবেক নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস গ্রেফতার হওয়ার পর তা চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছে। ‘হাজার হাজার হিন্দুকে হত্যা করা হচ্ছে’, ‘হিন্দু নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে’, ‘হিন্দুদের বাড়িঘর-দোকান-পাট পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে’, ‘হিন্দু মন্দিরে হামলা করা হচ্ছে’ বলে অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে এবং বাংলাদেশবিরোধী বিক্ষোভগুলোতে তা উচ্চারিত হচ্ছে। এই মিথ্যাচার একদিকে যেমন ভারতীয়রা বিশ্বাস করছে এবং তাদের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি বিদ্বেষ বিস্তার লাভ করছে, অন্যদিকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এটা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেও ভারতবিদ্বেষ সৃষ্টি করছে। আরো লক্ষ্যণীয়, ভারতীয় মিডিয়া ও সরকারের এই যুথবদ্ধ অপপ্রচার বিশ্বের কোনো কোনো দেশ বিশ্বাস করে বিরূপ প্রতিক্রয়া ব্যক্ত করছে। যা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর। বিবিসি বাংলা, ভারতের তথ্য যাচাই ও ভুয়া খবরের খোঁজ দেয়, এরকম একটি ওয়েবসাইট অল্ট নিউজের বরাত দিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বলেছে, অল্ট নিউজ বাংলাদেশ সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি খবর খুঁজে পেয়েছে, যেগুলিতে ‘বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর আক্রমণ’ হচ্ছে বলে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হয়েছে। এসব ভুয়া টুইট বা ফেসবুক পোস্টে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে ‘সেভ বাংলাদেশী হিন্দুজ’, বা ‘অল আইজ অন বাংলাদেশী হিন্দুজ’, অথবা ‘প্রে ফর বাংলাদেশী হিন্দুজ’ বলে। এ ধরনের ভুয়া পোস্টগুলোতে দেখা যাচ্ছে, ‘জেহাদীরা বাংলাদেশের হিন্দুদের কেটে ফেলছে অথচ বিশ্ব একেবারে চুপ করে আছে ইত্যাদি কথা। অল্ট নিউজের সম্পাদক প্রতীক সিনহার মতে, বহু ভুয়া তথ্য ও অসত্য খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করা হচ্ছে। এর মধ্যে অনেক ভুয়া তথ্যই আবার মূলধারার গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হচ্ছে। অল্ট নিউজ একটি ভুয়া খবর তুলে ধরেছে, যেখানে একদল টুপিপরা মানুষ লাঠি ও লোহার বড় হাতে চাষের ক্ষেতের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে, যেখানে পেছন থেকে গুলির শব্দ শোনা গেছে। এক্সে এ সম্পর্কে লেখা হয়েছে, কট্টরপন্থী জনতা বাংলাদেশের শেরপুর জেলার একটি গ্রামে হামলা চালিয়েছে হিন্দুদের বাড়ি, ক্ষেতের ফসল ধ্বংস করে দিয়েছে। একজনকে হত্যা করেছে। আসলে এই ভিডিওটি হলো ওই গ্রামের দরবার শরীফে ২৬ নভেম্বর যে হামলা হয়েছিল তার। ওদিকে ঢাকার ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলার একটি ভিডিও হিন্দুত্ববাদী সামাজিক মাধ্যমে ‘হিন্দুদের গণহত্যা’ বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে।
ভারতের মূলধারার এবং সামাজিক মাধ্যমে মিথ্যা খবর ও ভুয়া তথ্যের ছড়াছড়ি। এ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহির কোনো বালাই নেই। প্রচ- বাংলাদেশবিদ্বেষ বা মুসলিমবিদ্বেষই এর প্রধান কারণ। আরেক তথ্য যাচাই সংস্থা ‘রিউমার স্ক্যানার’ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটার পর থেকেই ভারতের গণমাধ্যম বাংলাদেশ নিয়ে ভুয়া খবর ও গুজব ছড়াচ্ছে। এরূপ ভুয়া খবর ও অপতথ্য প্রচারকারী ৪৯টি গণমধ্যমের সন্ধান পেয়েছে রিউমার স্ক্যানার। ১২ আগস্ট থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব গণমাধ্যমে অন্তত ১৩টি ভুয়া খবর প্রচারিত হয়েছে। ভারতের গণমাধ্যম রিপাবলিক বাংলা সর্বাধিক ৫টি গুজব প্রচার করেছে বলে রিউমার স্ক্যানার জানিয়েছে। এরপর রয়েছে হিন্দুস্থান টাইমস, জি নিউজ, লাইফ মিন্ট যারা ৩টি করে প্রচার করেছে। এছাড়া রিপাবলিক ইন্ডিয়া টু ডে, এবিপি আনন্দ ও আজতক ২টি করে প্রচার করেছে। ভুয়া খবর ও গুজব ছড়ানো বাকী ৪১টি গণমাধ্যমের মধ্যে রয়েছে এশিয়ান নিউজ ইন্টারন্যাশনাল, এনডিটিভি, ইকোনমিকস টাইমস, দ্যা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া, দ্য স্টেটম্যান, সংবাদ প্রতিদিন প্রভৃতি। স্মরণ করা যেতে পারে, মিথ্যা ও ভুয়া খবর ও গুজব প্রচারকারী গণমাধ্যমের মধ্য বিখ্যাত গণমাধ্যমও রয়েছে। অধিকাংশ গণমাধ্যমের ভাষা ইংরেজি হওয়ায় এই ভুয়া ও মিথ্যা খবর, গুজব ও অপতথ্য দ্রুত বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে যাচ্ছে। কী ধরনের ভুয়া ও মিথ্যা খবর গুজব প্রচারিত হচ্ছে, নমুনা হিসাবে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর তার নামে খোলাচিঠি, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আইসিইউতে ভর্তি, বাংলাদেশের নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠনগুলোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, পাকিস্তানি জাহাজের মাধ্যমে অস্ত্র আনা, চট্টগ্রামে নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী হিসাবে প্রচার ইত্যাদির কথা উল্লেখ করা যায়।
এসব মিথ্যা খবর, ভুয়া তথ্য ও গুজব সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ, তার সরকার ও জনগণের বিষয়ে ভুল বার্তা যাচ্ছে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের প্রভূত ক্ষতি হচ্ছে। এছাড়া সরকার ও রাজনৈতিক পর্যায় থেকে শুরু করে জনগণ পর্যায় পযর্ন্ত পারস্পারিক বিদ্বেষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব যে ভারতের সংশ্লিষ্ট মহলগুলো জানে না বা বোঝে না, এমন নয়। তবে তারা প্রচন্ড আঘাত পেয়েছে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার বিদায় নেয়ায়। হাসিনা সরকার ছিল তাদের খরিদা গোলাম। তার আমলের প্রভূ-ভৃত্য সম্পর্ক বদলে গিয়ে এখন সম্পর্ক হচ্ছে সমানে সমানে। এটা ভারত মোটেই মানতে পারছে না। বাংলাদেশ তার হাত ছাড়া। তার এতদিনের বাংলাদেশ নীতি সম্পূর্ণ ব্যর্থ ও অকার্যকর হয়ে পড়েছে। পরাজয়ের গ্লানি তাদের পক্ষে ভুলে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ জন্যই ভারত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একের পর এক চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। পতিত স্বৈরাচারকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সে বেদিশা বা পাগলপারা হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশবিরোধী অলআউট প্রচারণা তার মূল উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনারই অংশ। ভারতের বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণার প্রভাব বিভিন্ন দেশে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এ সম্পর্কে বলেছেন, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ইস্যু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ও প্রভাবশালী দেশের শীর্ষ সংসদীয় শুনানিতে অন্যায্যভাবে তুলে ধরা হচ্ছে। তিনি তার ভেরিফায়েড ফেসবুক একাউন্টে পোস্ট করা এক বিবৃতিতে সেকুলার সংবাদপত্র ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে বাংলাদেশের কথিত ধর্মীয় সংহিসতার মামলাগুলো তদন্ত করার আহবান জানিয়েছেন। তার এ আহবানটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংবাদপত্র ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো যদি বাংলাদেশে আসে এবং সরেজমিনে সবকিছু প্রত্যক্ষ করে তবে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে। এছাড়া সংখ্যালঘুদের, বিশেষত হিন্দুদের যেসব সংগঠন আছে, তারা সবাই যদি অপপ্রচারণার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় তবে উচিত জবাব হতে পারে। সরকারকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। অপপ্রচারণা, অপতথ্য ও গুজবের মোকাবিলা করার জন্য সরকারের একটি পৃথক সেল থাকতে পারে, যার কাজ হবে, সত্য ও সঠিক তথ্য তুলে ধরে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রতিহত করা। দেশের মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে। আমাদের মেইন স্ট্রিম মিডিয়া যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে না। স্বৈরাচারের দোসর মিডিয়াগুলো নীরবতা পালন করছে। তথ্য দিয়ে তথ্য মোকাবিলায়াই উৎকৃষ্ট পন্থা। সকল মিডিয়াকে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা রুখতে একজোট হতে হবে। সরকার, রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সংগঠন, মিডিয়া একত্র হয়ে ময়দানে নামলে অপপ্রচারণা অবশ্যই ব্যর্থ হবে।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
রাজশাহী জেলা ছাত্রদল নেতার পিতা বাচ্চু সরকারের দাফন সম্পন্ন
মোংলায় সড়কের ওপর রাখা পাথরের ধাক্কায় যাত্রীবাহী ভটভটিতে থাকা দুই যাত্রীর মৃত্যু, আহত ৪
গাজায় ঐতিহাসিক পরাজয় ইসরাইলের
১৭ বছর পর আজ দুপুরে কারামুক্ত হচ্ছেন বাবর
দীর্ঘ এক যুগ পর কারামুক্ত হলেন ডেসটিনির চেয়ারম্যান
আজ কুড়িগ্রামে মার্চ ফর ফেলানী, নেতৃত্বে সারজিস আলম
বাংলাদেশে আসছেন পাকিস্তানের জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ জেনারেল সাহির শমসদ
গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি ইসরাইলের ‘ঐতিহাসিক পরাজয়’: হামাস
যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার পরও গাজায় হামলা ইসরাইলের, নিহত অন্তত ৩০
জুলাই ঘোষণা : কারা যাচ্ছেন আজকের বৈঠকে
গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত হামাস-ইসরাইল
যে সব শর্তে গাজায় যুদ্ধবিরতি
এনসিটিবির সামনে হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার ২
নোয়াখালীর সদর উপজেলার ইউপি চেয়ারম্যান বাবলু আটক
বগুড়ায় কলেজ শিক্ষার্থী হত্যা মামলায় গ্রেফতার ৪
মতিঝিলে শিক্ষার্থীদের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত ১৫
সাভারে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ২৫ লাখ টাকার তেলসহ পিকআপ ছিনতাই
ডাকসু নিয়ে ৩৭৭ সংস্কার প্রস্তাব ঢাবি ছাত্রদলের
গাজীপুরে থানায় ব্যবসায়ীকে আটক করে ২ লাখ টাকা ঘুষ নিলো ওসি
রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র অফিস অবরোধের ঘোষণা চাকরি বঞ্চিতদের