ইসলামী শক্তির সম্ভাবনা কতটা
২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১৩ এএম | আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১৩ এএম
বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ। এদেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। সারাদেশে ৩ লাখের বেশি মসজিদ রয়েছে। ৩ লাখ মসজিদে প্রায় ৬ লাখ ইমাম ও মোয়াজ্জিন রয়েছেন। প্রায় ২০ হাজার কওমি মাদরাসা রয়েছে। এই মাদরাসাগুলোতে প্রায় ২০ লাখ আলেম রয়েছেন। আলিয়া মাদরাসার সংখ্যাও ছোট বড়ো প্রায় ২০ হাজারের মতো। সেখানেও আলেমের সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। দেশে অর্ধ শতাধিক ইসলামী দল রয়েছে। উল্লেখযোগ্য পীরের দরবার সংখ্যা একশোর কাছাকাছি। সব মিলিয়ে দেশে প্রায় ৪০ লাখ আলেম রয়েছেন। ফজরের আযান শুনে এদেশের মানুষের ঘুম ভাঙ্গে। আবার ইশার আযান শুনতে শুনতে তারা ঘুমাতে যায়। সব মিলিয়ে দেশের সামগ্রিক পরিবেশ ধর্মীয় আবহে জড়িত। দেশের অধিকাংশ মানুষ তাই ধর্ম প্রিয়।
বাংলাদেশ দুইবার স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ থেকে একবার এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে আরেকবার। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীনের পেছনে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আবেগ কাজ করেছিল। এদেশের অধিকাংশ মানুষ মনে করেছিলো, ব্রিটিশ থেকে দেশ স্বাধীন হয়ে পৃথক একটি ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হবে। দেশের শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইসলামী ভাবধারায় প্রণীত হবে। ব্যাংক-বীমা, কোর্ট-কাছারি, অফিস-আদালত ইত্যাদি ইসলামের নীতিতে পরিচালিত হবে। কিন্তু তা হলো না। দেশ নায়কেরা সেকুলারনীতির ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করলেন। ফলে মুসলিম জনতা আশাহত হল। বিশেষ করে, পাকিস্তানি শাসকেরা পূর্ব বাংলার জনগণকে বঞ্চিত করার মাধ্যমে জালেমের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। ফলে ১৯৭১ সালে বীর বাঙালি পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে বাধ্য হয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বরে তারা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হয়। ১৯৭১ থেকে ২০২৪- ৫৩ বছর। দেশটি পরিচালিত হয়ে আসছিল ধর্মহীন নীতির ভিত্তিতে। বিশেষ করে ২০০৮ থেকে ২০২৪ সময়টি ছিল ভয়াবহ ইসলামবিরোধীনীতির বহিঃপ্রকাশ। তাদের জুলুম ও ফ্যাসিবাদী নীতি পাকিস্তান ও ব্রিটিশদেরকে পিছনে ফেলে দিয়েছিল। আর এ ফ্যাসিবাদের মাস্টার মাইন্ড ছিলেন শেখ হাসিনা। হাসিনা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করেছিলেন। শিক্ষা ব্যবস্থাকে একটি তামাশার বস্তুতে পরিণত করেছিলেন। তরুণ-তরুণী ও শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের চরিত্রকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেছিল শেখ হাসিনার শিক্ষা নীতি। পৌত্তলিকতার প্রতি তার ছিল প্রবল আগ্রহ। পাঠ্যবইয়ের পাতায় পাতায় ছিল নানা ধরনের মূর্তির ছবি। গুম, খুন ও রক্তের নেশা ছিল তার প্রবল। তার হৃদয়টি ছিল নিষ্ঠুরতা, হিংস্রতা এবং পরশ্রীকাতরতায় ভরা। তার হিংস্রতা চরিতার্থ করতে তৈরি করেছিলেন আয়না ঘর। আয়না ঘর ছিল মাজলুমের আর্তনাদে ভরা এক বিভীষিকাময় জাহান্নাম। ছিল এক ভয়ানক টর্চার সেল। ধর্মপ্রিয় ও দেশপ্রেমিক মানুষকে এখানে তিলে তিলে হত্যা করা হতো। শুধু আয়না ঘরই নয়। বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চল এক একটি আয়না ঘরে পরিণত হয়েছিল। ভয়াবহ আতংকের জনপদে পরিণত হয়েছিল গোটা বাংলাদেশ। উন্নয়নের নামে দেশ থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছিল। ফলে বাংলাদেশ একটি ফকিরের দেশে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে শোষণ এবং নির্যাতনের কারণে দেশের সকল শ্রেণীর মানুষ তিক্ত ও বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাঁর অস্ত্রধারী ও লাঠিয়াল ছাত্রলীগ কর্তৃক সাধারণ ছাত্র-জনতা পিষ্ঠ ও অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। অবশেষে পিষ্ঠ এই ছাত্র-জনতা ফ্যাসিবাদকে বিতাড়িত করতে ফুঁসে উঠে। তাদের দীপ্ত শপথ আর বজ্রধ্বনি ফ্যাসিবাদের পতনকে ত্বরান্বিত করে। ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে ফ্যাসিবাদের জননী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে কোনোরকমে জীবন রক্ষা করেন। তার সাঙ্গ পাঙ্গরাও আত্মরক্ষার্থে ভারতে পাড়ি জমায়।
মূলত শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে ভারতের একটি করদ রাজ্যে পরিণত করেছিলেন। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে ক্ষমতায় আসীন হয়েই শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সেনাবাহিনী এবং বিডিআরের মেরুদ- ভেঙ্গে দেন। রাক্ষসরানী জাতীয়তাবাদী শক্তির শিকড় উপড়ে ফেলেন। ভারত এদেশের ইসলামী শক্তিকে প্রধান শত্রু মনে করে থাকে। ‘র’ এর সরাসরি হস্তক্ষেপে এদেশের ইসলামী শক্তির মূলোৎপাটন করতে সব আয়োজন সম্পন্ন করেন শেখ হাসিনা। ৫ মে ২০১৩ সালে ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে আলেমদের সমাবেশে শেখ হাসিনার পুলিশ বাহিনী সরাসরি গুলি করে শত শত নিরীহ আলেমকে শহীদ করে। শহীদী দেহগুলোকে জালিম সরকার পুড়িয়ে ছাই করে দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি’র শীর্ষ কয়েকজন নেতাকে ভারতের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ফাঁসি দেওয়া হয়।
অবশেষে ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে জনরোষের শিকার হয়ে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। তাঁর সরকারের মন্ত্রী-এমপিরাও আত্মগোপনে চলে যান। কেউ কেউ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। দেশে অভাবনীয় এক বিপ্লব সংঘটিত হয়। জনমনে অনাবিল এক প্রশান্তি নেমে আসে। দেশব্যাপী মিষ্টি বিতরণ হয়। মত প্রকাশের এক অভিনব ও অভূতপূর্ব ইতিহাস সৃষ্টি হয়। আলেমরা নির্বিঘেœ তাদের আদর্শ প্রচার করতে থাকেন। ভয় ও বাধাহীনভাবে আদর্শ প্রচার করতে পেরে তাদের মাঝে এক ধরনের আবেগ ও উচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়।
আলেমদের ব্যাপারে জনমনে একটি স্বপ্ন জাগ্রত হয়েছে। ইসলামী দলগুলোর মাঝে ঐক্যের এক আবহ তৈরি হয়েছে। ময়দানে যেহেতু আওয়ামী লীগ অনুপস্থিত সেহেতু বিএনপির পরেই জনগণ বড়ো শক্তি হিসেবে ইসলামী শক্তিকে বিবেচনা করছে। জনগণের ধারণা এই যে, সব ইসলামী দল এক কাতারে এলে আগামী নির্বাচনে ভালো ফল পেতে পারে। ইসলামী শক্তির জন্য এটা একটা বড়ো সুযোগ বলে অনেকে মনে করেন। ইসলামী শক্তির মধ্যে জামায়াতে ইসলামী সবচেয়ে গোছানো একটি পুরনো দল। যেকোনো সময়ের চেয়ে এ দলটির গ্রহণযোগ্যতা এখন বেড়েছে। কিন্তু দলটি তাদের এই গ্রহণযোগ্যতা কাজে লাগাতে পারছে না। তাদের মাঝে বাস্তবতার চেয়ে আবেগ কাজ করছে অনেক বেশি। দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোনো বুদ্ধিজীবী তৈরি হয়নি। বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতিতে তারা অনেক পিছিয়ে। লেখাপড়া, শিক্ষা, গবেষণা এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তারা এখন পর্যন্ত কোনো দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি। দলের নেতাকর্মীরা সাংগঠনিক সিলেবাসের বাইরে কোনো বই পড়েন না বললেই চলে। দলটির মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ আলেমের উপস্থিতি নাই।
জামায়াতের বাইরে যেসব ইসলামী দল রয়েছে তাদের অবস্থা আরো করুণ। এসব দল প্রধানত কওমী মাদরাসাকেন্দ্রিক। তাদের গন্ডির চৌহদ্দি মসজিদ ও মাদরাসার মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাদের অনেককে ফ্যাসিবাদের সমর্থক শক্তি হিসেবে মনে করা হয়। হেফাজতে ইসলাম বেশ কয়েকটি ইসলামী রাজনৈতিক দলের সমষ্টি। অথচ, দলটির নেতারা দলটিকে অরাজনৈতিক বলে দাবি করেন। এ দাবিটি হাস্যকর বলেই মনে করি। হেফাজতে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলন, চরমোনাই একে অপরের সহযোগী সংগঠন। এ সংগঠনগুলো কওমি মাদরাসাকেন্দ্রিক। ইসলামী আন্দোলন একটি পীর-মুরিদী দরবার। তাদের জনশক্তির বড়ো একটা অংশ গ্রামের সহজ সরল মানুষকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। দেশে কওমি মাদরাসাকেন্দ্রিক কয়েক ডজন দল রয়েছে। তারা পবিত্র কোরআনকে মাখরাজসহ উচ্চারণ করতে পারলেও কোরআন নিয়ে গভীর অনুসন্ধানী তৎপরতা তাদের মধ্যে নেই বললেই চলে। কোরআন মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখানোর ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এ সমস্ত ওলামায়ে কেরাম কোরআন থেকে শুধুমাত্র পূণ্য অর্জনের চিন্তা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। যুগ জিজ্ঞাসার জবাব ও আধুনিক উন্নত জ্ঞান গবেষণা তাদের ভিতরে অনুপস্থিত। কওমি মাদরাসার বাইরে লেখাপড়াকে তারা পছন্দ করেন না! একসময়ে এ গোষ্ঠীটি রাজনীতিকে হারাম মনে করতেন। সুতরাং এ জাতীয় দলকে শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় দল হিসেবেই ট্রিট করা যেতে পারে। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও সামাজিক নেতৃত্ব গড়ে তোলার কোনো উদ্যোগ নেই। তাদের মধ্যে দলীয় কোন্দল চোখে পড়ার মতো। সম্প্রতি কওমি সমর্থিত তাবলীগ জামাতের মধ্যে গ্রুপিং এবং মারামারি তাদের নেতৃত্বের লোভকেই হাইলাইট করছে। এ ঘটনায় দেশপ্রেমিক তৌহিদী জনতা আশাহত হয়েছে। উম্মাহর স্বার্থে যে সময়ে ইসলামী শক্তির ঐক্যের প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে, ঠিক সে সময়ে তাদের মধ্যে নতুন করে কামড়াকামড়ি ও ফতোয়াবাজি শুরু হয়েছে। জাতীয় জীবনে এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার আর কিছুই হতে পারে না। সুতরাং এসব ইসলামী শক্তি জাতিকে কিছুই উপহার দিতে পারবে না। তাদের পক্ষে জাতীয় ও সামগ্রিক বিপ্লব সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। বর্তমানের সুন্দর সন্ধিক্ষণ আলেমরা যেহেতু কাজে লাগাতে ব্যর্থ সেহেতু আগামী দিনে ইসলামী শক্তির ভবিষ্যৎ মোটেই আশাব্যঞ্জক হবে না।
লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ঢাবিতে আজ মেধাবীদের মুখোমুখি হচ্ছে শিবির, সকল প্রশ্নের জবাব দিবে নেতারা
অবশেষে টাঙ্গাইলের সেই আলোচিত ব্রীজটির উদ্বোধন হলো আজ
অস্ট্রেলিয়ার শেষ উইকেট জুটিতে বিপদে ভারত
দেশীয় অস্ত্রসহ খুলনার শীর্ষ সন্ত্রাসী আটক
'দি ওডিসি' সিনেমায় বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন নোলান
রোমানিয়ার নির্বাচনে অস্বচ্ছতা নিয়ে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর ক্ষোভ
বাউফলে হামলা-পাল্টা হামলা, বিএনপির এক পক্ষের মানববন্ধন ও আরেক পক্ষের সংবাদ সম্মেলন
১৫ দিনের মধ্যে সাংবাদিকদের জন্য ডিজিটাল কার্ড ইস্যু হবে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে ২১ সাংবাদিক
চাকরিচ্যুত সাবেক সেনাদের সড়ক অবরোধ, ২ ঘণ্টা পর যান চলাচল স্বাভাবিক
আশুলিয়ায় ভবন মালিকের স্বেচ্ছাচারিতায় অর্ধশত শিক্ষার্থীর লেখাপড়া বন্ধ
হাটহাজারী সাংবাদিক ঐক্য পরিষদের প্রতিবাদ সভা
৫ আগস্টের পর বেশ কয়েকটি ইসলামী ব্যাংক দখল করেছে একটি ইসলামী দল
মেহেরপুরে তসলিমা হত্যা মামলায় ২ জন আটক
ঈশ্বরদীতে ৫ বছরের শিশু কন্যাকে যৌন হয়রানির অভিযোগে সৎ বাবা গ্রেফতার
নাসার নতুন সাঁতারু রোবট , ইউরোপায় প্রাণের খোঁজে এক বিস্ময়কর যাত্রা
৩১ ডিসেম্বরের ঘোষণাপত্র লিখিত দলিল হিসেবে থাকবে : সারজিস
ইসলাম নিয়ে রাজনীতি করেন, ইসলাম মানে তো বারবার মোনাফেকি করা না : রিজভী
উখিয়ায় চুরির দায়ে পিটিয়ে এক যুবককে হত্যা, পরিবারের অভিযোগ পরিকল্পিত খুন
৩১ ডিসেম্বর মুজিববাদী সংবিধানের কবর রচিত হবে : হাসনাত আবদুল্লাহ