তিস্তা মহাপরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে
০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:২৬ এএম | আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:২৬ এএম
ভারত তার চাহিদার সব কিছুই নিয়েছে বাংলাদেশ থেকে। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো ন্যায্য দাবিই পূরণ করেনি। এর অন্যতম হচ্ছে তিস্তার ন্যায্য পানি বণ্টন চুক্তি। এ ব্যাপারে চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত হয়েছিল ২০১২ সালে। কিন্তু তা সাক্ষর হয়নি। দীর্ঘদিন থেকে করবো করবো বলে আশ্বাসের মূলা ঝুলিয়ে রেখেছে ভারত। তাই বাংলাদেশের প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন ৩০ মে, ২০২২ সালে এনডিটিভির সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ভারতের সাথে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিটি ১১ বছর ধরে ঝুলে আছে, যা দুর্ভাগ্যজনক এবং লজ্জাজনক। তবুও সেপ্টেম্বর, ২০২২ সালে বাংলাদেশ-ভারতের শীর্ষ বৈঠকের যৌথ বিবৃতিতে তিস্তা চুক্তির কোনো উল্লেখ নেই। সেখানে দুদেশের অভিন্ন ৫৪টি নদীর পানির কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ অধিক গুরুত্বপূর্ণ তিস্তা চুক্তিকে কম গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলোর সমস্যার সাথে একীভূত করা হয়েছে। ফলে তিস্তার পানি চুক্তির গুরুত্ব কমে গেছে। অথচ, তিস্তা নদীর পানির অভাবে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের কৃষি খাত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। উপরন্তু অঞ্চলটি প্রায় মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। বর্ষার সময়ে ভারত তার অঞ্চলকে ভয়াবহ বন্যার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য গজলডোবা বাঁধের সব গেট একবারে খুলে দেয়। তাতে তিস্তা পাড়ের সব কিছু অথৈ পানিতে তলিয়ে যায়। এমনি পরিস্থিতিতে তিস্তা পাড়ের মানুষের ঘোর অন্ধকার দূর করে ভাগ্যোন্নয়নের জন্য এগিয়ে আসে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধুদেশ চীন। দেশটি তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করে দেওয়ার প্রস্তাব দেয় ২০২২ সালে। প্রকল্প বাস্তবায়নের নির্ধারিত ব্যয় (প্রায় ৮.৫ হাজার কোটি টাকা); তারও সমুদয় অর্থ ঋণ হিসেবে দেওয়ার আনুষ্ঠানিক সম্মতি দেয় চীনের একটি ব্যাংক। চীনের প্রস্তাবিত তিস্তা মহাপরিকল্পনা হচ্ছে: বাংলাদেশ অংশে তিস্তা নদীর ডান-বাম উভয় তীর ঘেঁষে ২২০ কিলোমিটার উঁচু গাইড বাঁধ, রিভার ড্রাইভ, হোটেল-মোটেল-রেস্তরাঁ, পর্যটন কেন্দ্র, ১৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিল্প-কারখানা, ইপিজেড, ইকোনমিক জোন, কয়েক লাখ হেক্টর কৃষি জমি উদ্ধার, বনায়ন ইত্যাদি। তাতে প্রায় ২০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। পাল্টে যাবে তিস্তা পাড়ের মানুষজনের জীবনমান। দ্বিতীয়ত: তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ভারতের অতিরিক্ত পানির আর প্রয়োজন পড়বে না বাংলাদেশের। কারণ, তিস্তা নদীর গভীরতা প্রায় ১০ মিটার বৃদ্ধি পাবে। ফলে বন্যায় ভাসবে না গ্রাম-গঞ্জ-জনপদ। উপরন্তু সারা বছর নৌ-চলাচলের মতো পানি সংরক্ষিত থাকবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এলাকায় বহু কল-কারখানা তৈরি হবে এবং ৫০ হাজার মানুষ নদী ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা পাবে। চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং ৯-১০ অক্টোবর, ২০২২ নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্ট এলাকার তিস্তা নদীর অববাহিকা ও দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারেজ পরিদর্শন করে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষ, প্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেন। সাংবাদিকদের জানান, ‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন দ্রুত আলোর মুখ দেখবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সবদিক দিয়ে পরিবর্তন ঘটবে এই এলাকার। মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, অর্থনীতি, প্রকৃতি, পরিবেশ, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ মানুষের প্রতিটি ক্ষেত্রে এটি অবদান রাখবে।’ তিনি আরও জানান, ‘তিস্তাকে ঘিরে মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির আদলে তিস্তার দুই পাড়ে পরিকল্পিত স্যাটেলাইট শহর গড়ে তোলার কথা ভাবা হচ্ছে। নদী খনন ও শাসন, ভাঙন প্রতিরোধ ব্যবস্থা, আধুনিক কৃষি-সেচ ব্যবস্থা, মাছচাষ প্রকল্প, পর্যটনকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এতে ৭ থেকে ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। ফলে উত্তরের জেলা লালমনিরহাট, রংপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম জেলার আর্থিক সমৃদ্ধি হবে।’
পদ্মাসেতু চালু হওয়ার প্রেক্ষিতে দেশের সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের যেমন যাত্রা শুরু হয়েছে, তেমনি হবে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে বৃহত্তর রংপুরবাসীর। কারণ, সেখানে ব্যাপক উন্নতির পথ সৃষ্টি হবে। ফলে দারিদ্র্য, মঙ্গা, বেকারত্ব ও মরু বিস্তার প্রক্রিয়া স্থায়ীভাবে দূর হবে। দেশের আঞ্চলিক বৈষম্যও দূর হবে। তাই প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার অসংখ্য মানুষ বহু মিছিল-মিটিং, মানববন্ধন করেছে। দেশের প্রখ্যাত পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাতও বিবিসিতে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ভারতের যা নেওয়ার দরকার তার সব কিছুই নিয়েছে। আমরা তা দিয়ে দিয়েছি অবলীলাক্রমে। ফলে ভারতের এখন আর কোনো গরজ নেই তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে। এ অবস্থায় চীনের প্রস্তাবিত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।’ বাংলাদেশের জন্য অতীব কল্যাণকর এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ভারত বহুদিন ধরে বাগড়া দিয়ে আসছে। দেশটির মানসিকতা হচ্ছে, বাংলাদেশের জন্য নিজেও কিছু করবে না। আবার অন্য দেশ, বিশেষ করে চীনকেও কিছু করতে দেবে না। এটা সে প্রকাশ্যে বলেও থাকে, যা চরম অন্যায়, অবন্ধুসূলভ ও আধিপত্যবাদী মনোভাবের প্রকাশ। এ দেশের ভারতপ্রেমীদের সে দিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। তারা সদা মশগুল বন্ধুর বন্দনায়!
বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি দরিদ্র অঞ্চল হচ্ছে বৃহত্তর রংপুর জেলা। এ অঞ্চলটি ‘মঙ্গা এলাকা’ বলে খ্যাত। শিল্প প্রতিষ্ঠান তেমন নেই এখানে। কৃষিভিত্তিক এলাকা। তাও এক বছর ফসল হয়তো কয়েক বছর হয় না। ফসল হলেও তার ন্যায্যমূল্য পায় না কৃষক। তাই এলাকার অধিকাংশ মানুষ গরিব। সে কারণে সেখানের শিক্ষার হারও খুব কম! এলাকার ফসল হানির প্রধান কারণ হচ্ছে তিস্তা নদী। ভারত সেই নদীর পানি ইচ্ছা মতো নিয়ন্ত্রণ করে আভ্যন্তরীণভাবে ব্যবহার করে। শুষ্ক মওসুমে পানি না দিয়ে শুকিয়ে মারে। আবার বর্ষা মওসুমে গজলডোবা ব্যারাজের সব গেট একবারে খুলে দিয়ে পানিতে ডুবিয়ে দেয়। এই মরণফাঁদ তিস্তা থেকে বাঁচার লক্ষ্যে বাংলাদেশ তিস্তা নদীর ন্যায্য পানিবণ্টন চুক্তি করার জন্য বহুদিন থেকে দাবি করে আসছে। ভারত তা দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছে অনেকবার। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি কেন্দ্র ও পশ্চিমবঙ্গের লুকোচুরি খেলায়! তবুও বাংলাদেশ এই আন্তর্জাতিক নদীর ন্যায্য পানি পাওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে যায়নি কিংবা তিস্তার উৎস চীন, তাকেও সংশ্লিষ্ট করে আঞ্চলিকভাবে ন্যায্য পানি বণ্টনের চুক্তির ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি! ফলে, তিস্তার সর্বনাশা কর্ম অব্যাহত রয়েছে!
এই অবস্থায় ২০২২ সালের শেষ দিকে চীন তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। ভারত তাতে প্রবল আপত্তি জানায় ‘চীন ভীতি’র কারণে। শেষাবধি উক্ত প্রকল্প বাস্তবায়নে ভারত তদারকি করবে এমন সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর পরও অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়নি। পতিত স্বৈরাচারের সঙ্গে ভারতের স¤পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মতো মধুর থাকা সত্ত্বেও কাজ হয়নি।
দেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রোডাক্ট। তাই এই সরকারের প্রধান কাজ হচ্ছে দেশে সৃষ্ট সব বৈষম্য দূর করা। যদিও সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ নিয়ে রয়েছে বৈষম্য বলে মানুষের অভিমত। কারণ, উপদেষ্টা পরিষদের অধিকাংশই একটি অঞ্চলের। আর রাজশাহী বিভাগ ও রংপুর বিভাগের একজনও নেই উপদেষ্টা পরিষদে! দ্বিতীয়ত: অবহেলিত মঙ্গা এলাকার উন্নয়ন করে আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করার কোনো পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়নি এখনো। এই অবস্থায় অনতিবিলম্বে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা আবশ্যক।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
মির্জাপুর উপজেলা কৃষক দলের আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর মৃধার পদ স্থগিত
বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকালে বিজিবি হেফাজতে ৩৬ মিয়ানমার নাগরিক
খালেদা জিয়ার সঙ্গে কর্নেল অলির সাক্ষাৎ
বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশনের সভাপতি নাসির মহাসচিব নেওয়াজ
আইনজীবীদের জুরিসপ্রুডেন্সের ওপর বই লেখার আহ্বান প্রধান বিচারপতির
রোমানিয়ায় কূটনীতিক মহসিনকে শাস্তির দাবিতে ৭ দিনের আলটিমেটাম
লক্ষ্মীপুরে ফিটনেস বিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান, ৩৯ হাজার টাকা জরিমানা
দক্ষিণ এশিয়ান টেনিস বল ক্রিকেট চ্যাম্পিয়ানশীপে রানার্স-আপ সৈয়দপুর দলকে সংবর্ধনা
সাভার হাইওয়ে থানার ইনচার্জ শ্রেষ্ঠ অফিসার ইনচার্জ নির্বাচিত
ভাড়াটিয়াসহ মালিককে বের করে বসত বাড়ি দখল
যে মামলায় আটক লতিফ বিশ্বাস
নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিক্ষকদের প্রস্তুতি নিতে হবে
প্রশাসন সংস্কারে কঠোর হতে হবে
অসভ্য নগরীতে পরিণত ঢাকা
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে চীনের পাল্টা নিষেধাজ্ঞা
সমুদ্রে ক্ষয়যোগ্য শক্ত প্লাস্টিক ব্যবহার করা যাবে গাড়িতেও
উৎসবে আতশবাজি নিষিদ্ধে হাজারও মানুষের আবেদন
বাথরুমের নাম করে গয়না নিয়ে পালালেন কনে
অর্থ, রসিদ বই নিয়ে পালিয়ে গেল ইসকনের কর্মী
পণবন্দীর ভিডিও প্রকাশ হামাসের ইসরাইলে মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ