ভেজালের দৌরাত্ম্য

Daily Inqilab মীর আব্দুল আলীম

১৩ এপ্রিল ২০২৫, ১২:৩০ এএম | আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ১২:৩০ এএম

এক সময় মাছ মরার পর পচতো, এখন পচে না। কারণ, মাছটা মারা তো যায়নি, তাকে মেরে জ্যান্ত রাখা হয়েছে ফরমালিনে চুবিয়ে! চিংড়ি মাছ টকটকে লাল, কিন্তু আসলে সেটা রঙিন মৃত্যু। সবজিতে রং এত উজ্জ্বল যে, প্যারিস ফ্যাশন উইকে পাঠালেও মানায়! আমরা খাচ্ছি ভাত, কিন্তু সেই ভাতে আছে ‘পটাশিয়াম ব্রোমেটে’। রন্ধন তেলে আছে র‌্যান্সিডিটি, বিজ্ঞান যেটাকে বলে অক্সিডেশন, আমরা বলি, ‘হালকা ঘ্রাণ আছে মনে হয়’। খাবারে গন্ধ থাকলেই যে ভালো কিছু, এটা তো আর সব সময় সত্যি না!

বাংলাদেশে এখন একটা নতুন বাজার তৈরি হয়েছে, ‘অর্গানিক’ বাজার। দোকানপাটে লেখা ‘অর্গানিক আম’, ‘অর্গানিক চাল’, ‘অর্গানিক কুমড়া’। শুনলে বোঝা যায়, এ যেন বিদেশি রাজপুত্রের রাজকীয় ভোজ! কিন্তু সেই অর্গানিকের উৎস জানতে গেলে দেখা যায়, সব কিছুই গাজীপুর বা নবীনগরের কোনো কোনো ‘ব্যবসায়ী চাচার’ হোমিও ল্যাব থেকে আসা। ঢাকায় বসে আমরা এখন অর্গানিক রসগোল্লা খাচ্ছি, যাতে গ্লুকোজ সিরাপের বদলে দেওয়া হয়েছে ‘প্রাকৃতিক হাইড্রোজেনেটেড সুগার সাবস্টিটিউট’, যা শোনার পরই প্রেশার ১৫০ হয়ে যায়।

খাদ্যে ভেজালবিরোধী আইন আছে। এমনকি ১৯৫৯ সালের ‘খাদ্য নিরাপত্তা আইন’ এখনও চমৎকারভাবে শোভা পাচ্ছে। খাদ্যে ভেজাল রোধে অনেক আইন রয়েছে, কিন্তু এর যথাযথ প্রয়োগ নেই। এর ব্যবহার অনেকটা সেই পুরোনো গ্রাম্য চৌকিদারের লাঠির মতো, শুধু ঝাড় দেওয়া যায়, পেটানো যায় না। ভেজাল দেওয়া বা ভেজাল খাদ্য ও পানীয় বিক্রির কারণে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। এ আইনের ২৫ (গ) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ কোনো খাদ্য বা পানীয়দ্রব্যে ভেজাল দিয়ে তা ভক্ষণ বা পান করার অযোগ্য করে ও তা খাদ্য, পানীয় হিসেবে বিক্রি করতে চায় বা তা খাদ্য বা পানীয় হিসেবে বিক্রি হবে বলে জানা সত্ত্বেও অনুরূপ ভেজাল দেয় অথবা কোনো দ্রব্য নষ্ট হয়েছে বা নষ্ট করা হয়েছে বা খাদ্য, পানীয় হিসেবে অযোগ্য হয়েছে জানা সত্ত্বেও বা তদ্রুপ বিশ্বাস করার কারণ থাকা সত্ত্বেও অনুরূপ কোনো দ্রব্য বিক্রি করে বা বিক্রির জন্য উপস্থিত করে; তবে সে ব্যক্তি মৃত্যুদ-, যাবজ্জীবন কারাদ- অথবা ১৪ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদ-ে এবং তদুপরি জরিমানাদ-ে দ-নীয় হবে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ২০০৫ সালে অর্ধশত বছরের পুরনো ১৯৫৯ সালের বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশে (পিএফও) বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনে। বিএসটিআই অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ এবং এর অধীনে প্রণীত বিধিমালায় খাদ্য ও কৃষিজাত পণ্যের প্রক্রিয়া ও পরীক্ষা পদ্ধতির জাতীয় মান প্রণয়ন এবং প্রণীত মানের ভিত্তিতে পণ্যসামগ্রীর গুণগত মান পরীক্ষা ও যাচাই করার বিধান রয়েছে।

পালনীয় বিধানাবলী ভঙ্গের জন্য চার বছর পর্যন্ত কারাদ- এবং ১ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার ব্যবস্থা রয়েছে। খাদ্যে ভেজাল রোধ ও ভেজালকারীদের শাস্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে সিটি কর্পোরেশন অধ্যাদেশগুলোয়। দেখা যাচ্ছে, দেশে খাদ্যদ্রব্যে ভেজালবিরোধী আইনের কমতি নেই। শাস্তির বিধানও রয়েছে এসব আইনে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে, শাস্তির বিধানসংবলিত এসব আইন বলবত থাকা সত্ত্বেও খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের এত দৌরাত্ম্য কেন? কারাদন্ডের বিধান থাকলেও এ পর্যন্ত তা প্রয়োগের কোনো নজির নেই। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য, খাদ্যে ভেজাল রোধে পর্যাপ্ত আইন থাকলেও এর যথাযথ প্রয়োগ নেই। মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর কোনো কিছুই খাদ্যে মিশ্রণ করা যাবে না, এটাই বিধান। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা এ আইন মানছে না। এ জন্য চলমান ভেজালবিরোধী আইনকে কঠোর করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের জনবল ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। এদেশে খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে ‘দি পিওর ফুড অর্ডিন্যান্স’ ১৯৫৯ বর্তমান ব্যবস্থায় কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না। এই আইন যখন হয়েছে তখন মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর অনেক রাসায়নিক দ্রব্য সৃষ্টিই হয়নি। আর খাদ্যে ভেজাল মেশানোর প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে আশির দশকের পর। ফলে জনস্বার্থে আইন সংশোধন না করে নতুন করে কঠোর আইন তৈরি করতে হবে। এতে খাদ্যে ভেজালকারীর বিরুদ্ধে সরাসরি ২০২ ধারা অনুসরণ করা দরকার। কারণ খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে মানুষ মারা এবং সরাসরি মানুষ মারাকে এই অপরাধের আওতায় আনা না হলে ভেজাল মেশানো প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না।

বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা দেখার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর হাতে যে পরিমাণ যন্ত্রপাতি আছে, তা দিয়ে তারা আসলে তেলাপোকার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতেও হিমশিম খায়। পরীক্ষাগার নেই, যন্ত্রপাতি নেই, লোকবল নেই, অথচ দায়িত্ব বিশাল। ক্যাব (ভোক্তা অধিকার সংগঠন) মাঝে মাঝে রিপোর্ট দেয়, ঢাকার ৭০% হোটেল-রেস্তোরাঁয় খাবারে ভেজাল! শুনে আমরা কাঁধ ঝাঁকি দেই, তারপর বাসার নিচের ওই হোটেলেই পরোটা-ভাজি খাই। কারণ, খিদে আর অভ্যাস, দুইটা জিনিসই পেটের পক্ষে ভীষণ আপোসকারী।

আজকাল শহর কিংবা গ্রামে বাচ্চাদের যে হারে অ্যাজমা, অ্যালার্জি, লিভার ডিজঅর্ডার হচ্ছে, তাতে ডাক্তাররা বলছেন: ‘ওদের শরীরে প্রাকৃতিক কিছু কম, কৃত্রিম জিনিস বেশি!’ শিশুর দুধে হাইড্রোজেনেটেড ফ্যাট, নুডলসে ক্ষতিকর প্রিজারভেটিভ, চিপসে সোডিয়াম গ্লুটামেট! তারা খেলছে, খাচ্ছে, বড় হচ্ছে, কিন্তু শরীর যেন তৈরি হচ্ছে ‘নরম পলিথিন দিয়ে’। শিশুকালেই গোটা দেহটায় যেন বিষের রাজত্ব।

‘প্রতি জনে, প্রতি ক্ষণে, জেনে-শুনে করেছি বিষ পান।’ আরও এক লেখক লিখেছেন, ‘কত কিছু খাই, ভস্ম আর ছাই।’ জাতীয় দৈনিকে হেডলাইন, ‘মাছের বাজারে মাছি নেই!’ এগুলো নিছক রসিকতা নয়, এগুলো বাস্তবতা। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যে কোনো না কোনো মাত্রায় বিষ মেশানো হচ্ছে, এ আর অজানা কিছু নয়। আর এই বিষই আমাদের নিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর দিকে, ধীরে ধীরে নীরব ঘাতকের মতো।

আমরা যদি হাত গুটিয়ে বসে থাকি, তবে এক সময় হয়তো এই দেশে শোকবার্তা লেখা হবে এমনভাবে: ‘তিনি মাত্র ৪০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন, মৃত্যুর কারণ ছিল সকালে খাওয়া এক প্লেট খিচুড়ি।’
খাদ্যে ভেজাল বন্ধ করতে চাইলে কঠোর আইন ও তার কার্যকর প্রয়োগ, স্বতঃস্ফূর্ত গণসচেতনতা ভোক্তা আন্দোলন, মিডিয়া নজরদারি খাদ্য পরীক্ষার জন্য আধুনিক ল্যাব ও সক্ষম জনবল এবং বিশেষ আদালত চালু করে দ্রুত বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও সমাজ গবেষক।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

সুন্দরবন রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধি করা হোক
ইউনূস-মোদি বৈঠক : একটি পর্যালোচনা
গণঅভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশে সংক্ষুব্ধ ‘আমরা’ কারা?
জেনারেল এসির নামে প্রতারণা
সন্তানকে নৈতিক শিক্ষা দিন
আরও
X

আরও পড়ুন

সড়ক বিহীন সেতু,কাজে আসছেনা এলাকাবাসীর

সড়ক বিহীন সেতু,কাজে আসছেনা এলাকাবাসীর

দুর্নীতির অভিযোগে নওগাঁ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দুদকের অভিযান

দুর্নীতির অভিযোগে নওগাঁ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দুদকের অভিযান

কলাপাড়ায় একটি ছাগলকে কেন্দ্র করে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সংঘর্ষে, আহত-৪

কলাপাড়ায় একটি ছাগলকে কেন্দ্র করে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সংঘর্ষে, আহত-৪

ফ্যাসিস্টের পতন হয়েছে কিন্তু বিএনপি  নিয়ে ষড়যন্ত্র এখনো অব্যাহত রয়েছে  -মিজান চৌধুরী

ফ্যাসিস্টের পতন হয়েছে কিন্তু বিএনপি  নিয়ে ষড়যন্ত্র এখনো অব্যাহত রয়েছে  -মিজান চৌধুরী

উইন্ডিজকে হারালেই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ

উইন্ডিজকে হারালেই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ

গাজায় মানবিক সহায়তা নিষিদ্ধ ঘোষণা ইসরায়েলের, সংকট তীব্র

গাজায় মানবিক সহায়তা নিষিদ্ধ ঘোষণা ইসরায়েলের, সংকট তীব্র

টাইম ম্যাগাজিনের ১০০ প্রভাবশালীর তালিকায় ড. ইউনূস

টাইম ম্যাগাজিনের ১০০ প্রভাবশালীর তালিকায় ড. ইউনূস

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে প্রজ্ঞাপন জারি

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে প্রজ্ঞাপন জারি

সুন্নত নামাজে ভুল করে নামাজ শেষ করে ফেলা প্রসঙ্গে?

সুন্নত নামাজে ভুল করে নামাজ শেষ করে ফেলা প্রসঙ্গে?

কূট-কৌশলে ‌ভিআইপিদের টার্গেট করতেন মেঘনা আলম চক্র

কূট-কৌশলে ‌ভিআইপিদের টার্গেট করতেন মেঘনা আলম চক্র

সুন্দরবন রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধি করা হোক

সুন্দরবন রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধি করা হোক

ইউনূস-মোদি বৈঠক : একটি পর্যালোচনা

ইউনূস-মোদি বৈঠক : একটি পর্যালোচনা

উইন্ডিজের বিপক্ষে সেরাটা দিতে প্রস্তুত বাংলাদেশ: নিগার

উইন্ডিজের বিপক্ষে সেরাটা দিতে প্রস্তুত বাংলাদেশ: নিগার

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশে সংক্ষুব্ধ ‘আমরা’ কারা?

গণঅভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশে সংক্ষুব্ধ ‘আমরা’ কারা?

জেনারেল এসির নামে প্রতারণা

জেনারেল এসির নামে প্রতারণা

ইমরান খান-বুশরা বিবির বিয়ের অজানা অধ্যায় প্রকাশ

ইমরান খান-বুশরা বিবির বিয়ের অজানা অধ্যায় প্রকাশ

নোয়াখালীতে ব্রা‌ন্ডের নকল বস্তায় চাউল প‌্যা‌কেট ক‌রে বি‌ক্রি ;ভোক্তা অ‌ধিকা‌রের ১ লক্ষ টাকা জরিমানা

নোয়াখালীতে ব্রা‌ন্ডের নকল বস্তায় চাউল প‌্যা‌কেট ক‌রে বি‌ক্রি ;ভোক্তা অ‌ধিকা‌রের ১ লক্ষ টাকা জরিমানা

মঞ্চে অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট

মঞ্চে অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট

মুক্তির অপেক্ষায় মিজানুর রহমান লাবুর সিনেমা আতরবিবিলেন

মুক্তির অপেক্ষায় মিজানুর রহমান লাবুর সিনেমা আতরবিবিলেন

সোস্যাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকা আমাকে শান্তি দিয়েছে :বাঁধন

সোস্যাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকা আমাকে শান্তি দিয়েছে :বাঁধন