স্ট্রোককে জানলে প্রতিরোধ করা যায়
০৩ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৭ এএম | আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০৭ এএম
স্ট্রোক সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রতি বছর ২৯ অক্টোবর বিশ্ব স্ট্রোক দিবস পালিত হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিশ্ব স্ট্রোক দিবস পালন করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবারের প্রতিপাদ্য দিয়েছে “টুগেদার উই আর, গ্রেটার দেন স্ট্রোক”।
মস্তিস্কে কোনো কারণে রক্ত সরবরাহ বিঘ্নিত হলে স্ট্রোক হয়। বিশেষ করে রক্তনালী বন্ধ হয়ে কিংবা রক্তনালী ছিঁড়ে মস্তিষ্কে এই রক্ত সরবরাহ বিঘ্নিত হয়। রক্তে থাকে অক্সিজেন আর পুষ্টি। ফলে অক্সিজেনের অভাবে মস্তিষ্কের টিস্যুগুলো মারা যায়। স্ট্রোকের সবচেয়ে বড় কারণ হলো উচ্চরক্তচাপ। সারাবিশ্বে মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ স্ট্রোক।
স্ট্রোক প্রতিরোধ করতে হলে লক্ষণও জানা চাই। কারণ, লক্ষণ না জানার কারণে স্ট্রোক হওয়ার পরও চিকিৎসা নিতে দেরি করে অনেকে। মুখ বেঁকে যাওয়া, হাত-পা দুর্বল অথবা অবশ হয়ে আসা, কথা জড়িয়ে যাওয়া বা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা হলেই বুঝতে হবে স্ট্রোক হয়েছে। এসময় রুগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। সারাবিশ্বে মানুষের মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ ধরা হয় স্ট্রোককে।
স্ট্রোক দুই ধরনের। রক্তনালি বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং রক্তনালি ফেটে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ। স্ট্রোকে আক্রান্ত ৫০ শতাংশ রোগীর পক্ষাঘাত ঘটে। এত দিন সবার ধারণা ছিল স্ট্রোক শুধু বয়স্ক ব্যক্তিদের হয়। তবে সেই ধারণা এখন পরিবর্তন হয়েছে। করোনার মধ্যে তরুণদের স্ট্রোকের সংখ্যা বেড়েছে। একই সঙ্গে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুও বেড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বব্যাপী যত অসংক্রামক ব্যাধি আছে, সেগুলোর মধ্যে মৃত্যুর দিক থেকে হৃদ্রোগের পরেই স্ট্রোকের অবস্থান এবং শারীরিক অক্ষমতার জন্য স্ট্রোক সবচেয়ে বেশি দায়ী। প্রতিবছর প্রায় দেড় কোটি মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। যাঁদের মধ্যে প্রায় অর্ধকোটি মৃত্যুবরণ করেন এবং প্রায় অর্ধকোটি মানুষ সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করেন। এই তথ্য থেকে বোঝা যাচ্ছে, স্ট্রোক কত ভয়ানক একটি মরণব্যাধি। প্রতি চারজনের মধ্যে একজনের জীবনের যেকোনো সময় স্ট্রোক হতে পারে। উন্নত বিশ্বের তুলনায় নিম্ন আয়ের দেশে স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। এই ঝুঁকি নিয়মিত বেড়েই যাচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০৫০ সালের মধ্যে এটা ৮০ ভাগ বাড়তে পারে।
২০১৭ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি ১ হাজারের মধ্যে প্রায় ১১ দশমিক ৩৯ জনের স্ট্রোক হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে ষাটোর্ধ্ব মানুষের সংখ্যাই বেশি এবং নারীদের তুলনায় পুরুষ প্রায় দ্বিগুণ। অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিস কিংবা হৃদ্রোগ ছিল অথবা তাঁরা ধূমপান, অ্যালকোহল বা অন্য কোনো তামাক সেবন করতেন। তবে এই সব কটি কারণই কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করা যায়। প্রায় ২০ লাখ স্ট্রোকের রোগী রয়েছে বাংলাদেশে। স্ট্রোকের ঝুঁকি ৬০ বছরের বেশি মানুষের মধ্যে ৭ গুণ বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে দেশে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৪৫ হাজার ৫০২ জন। যা বেড়ে ২০২০ সালে দাঁড়িয়েছে ৮৫ হাজার ৩৬০ জনে।
> স্ট্রোকের ইতিহাস:
খ্রিস্টপূর্ব ২য় সহস্রাব্দ থেকে প্রাচীন মেসোপটেমিয়া ও পারস্য সভ্যতা পর্যন্ত স্ট্রোক ও পারিবারিক স্ট্রোকের বর্ণনা পাওয়া যায়। হিপোক্রেটিস (৪৬০ থেকে ৩৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি আকস্মিক পক্ষাঘাতের বর্ণনা দিয়েছিলেন যা ইস্কিমিক স্ট্রোকের সাথে সম্পর্কিত। এই বিষয়টিকে বর্ণনা করতে হিপোক্রেটিস তাঁর লেখায় গ্রিক ভাষার শব্দ অ্যাপোপ্লেক্সি বা সন্ন্যাস রোগ শব্দ ব্যবহার করেছিলেন যার অর্থ হলো ্রমস্তিষ্কের রক্তনালিতে আঘাতের ফলে চেতনাশক্তি ও চলার ক্ষমতার লোপগ্ধ।
-সেরিব্রোভাস্কুলার দুর্ঘটনা শব্দটি ১৯২৭ সালে ব্যবহার করা হয়েছিল, এটি যে ধারণার প্রতিফলন করছিল তা হলো ্রনালি সম্বন্ধীয় তত্ত্বসমূহ সম্পর্কে একটি বর্ধনশীল সচেতনতা ও গ্রহনযোগ্যতা এবং মস্তিষ্কের রক্ত সরবরাহের আকস্মিক বিঘø ঘটার পরিণতির স্বীকৃতিগ্ধ।
স্ট্রোকের তীব্র প্রকৃতি বুঝাতে আমেরিকান স্ট্রোক অ্যাসোসিয়েশন ব্রেইন অ্যাটাক বা মস্তিষ্ক আক্রমণ পরিভাষাটির প্রচলন করেছিল, যা ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ব্যবহার করা হতোএবং বর্তমানে ইস্কিমিক ও হেমোরেজিক উভয় প্রকার স্ট্রোক বুঝাতেই কথ্যরূপে ব্যবহৃত হয়।
> স্ট্রোকের প্রধান কারণ ও করণীয়: স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ।
> আরও কয়েকটি কারণে স্ট্রোক হতে পারে, সেগুলো হল:
- ধূমপান, তামাক-জর্দা বা অন্যান্য মাদক সেবন করলে।
- রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইড ও কোলেস্টোরেলের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হলে।
- ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় থাকলে।
- হৃদরোগ থাকলে।
- মানসিক চাপ, অতিরিক্ত টেনশন, অবসাদের মতো মানসিক সমস্যা থাকলে।
- সারাদিন শুয়ে বসে থাকলে, কায়িক পরিশ্রম না করলে, ওজন অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে।
- অস্বাস্থ্যকর অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস। বিশেষত অতিরিক্ত তেল ও চিনিযুক্ত, ভাজাপোড়া খাবার ও পানীয় খেলে।
- মদপান করলে।
নিয়মিত স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠলে স্ট্রোকের ঝুঁকি পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
> স্ট্রোক দুই ধরনের
- ইস্কিমিক স্ট্রোক: এ ধরনের স্ট্রোকে রক্তনালির পথে ক্লট বা রক্তপিন্ড জমে রক্ত চলাচলের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। তখন মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ৮৭ শতাংশ স্ট্রোক হলো ইস্কিমিক স্ট্রোক।
- হেমোরেজিক স্ট্রোক: মগজে রক্ত পৌঁছে দেয় এমন রক্তনালি দুর্বল হয়ে ফেটে বা ছিঁড়ে রক্তক্ষরণ হলে এ ধরনের স্ট্রোক হতে পারে। এর মূল কারণ অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ।
এ ছাড়া মিনি স্ট্রোক হয় অনেক সময়। একে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে ট্রাঞ্জিয়েন্ট ইস্কিমিক অ্যাটাক। এতে মগজে সাময়িকভাবে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
> স্ট্রোকের আক্রান্ত থেকে মুক্ত থাকতে কয়েকটি পরামর্শ:-
উচ্চ রক্তচাপ, ডায়বেটিস ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখা।
অতিরিক্ত তেলচর্বি ও চিনি-লবনযুক্ত খাবার, ভাজাপোড়া, ফাস্টফুড এড়িয়ে পুষ্টিকর ডায়েট মেনে চলা।
ধূমপান, জর্দা-তামাক, মাদক সেবন, মদপান এড়িয়ে চলা।
প্রতিদিন ৬-৮ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন ঘুম।
শরীরচর্চা বা নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম করা। ওজন ঠিক রাখা।
প্রতি ছয়মাস অন্তর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা।
> পরিশেষে বলতে চাই- স্ট্রোক থেকে মুক্ত থাকতে নিয়মিত ব্যায়াম, সকাল-বিকাল হাঁটাচলা করতে হবে এবং অলস জীবনযাপন পরিহার করতে হবে। দুশ্চিন্তা বা টেনশনমুক্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে। নিয়মিত ধর্মচর্চা এ ব্যাপারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আর স্ট্রোক অবশ্যই একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। একবার আক্রান্ত হয়ে গেলে চিকিৎসা অত্যন্ত জটিল, ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য। আক্রান্ত রোগী নিজে মানসিক ও শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, পরিবারের জন্য অনেক সময় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তাই প্রতিরোধ করাই সর্বোত্তম। প্রান্তিক জনগণকে চিকিৎসাসেবার আওতায় আনার জন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ এবং জনসচেতনতা।
মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
কলাম লেখক ও গবেষক
বিভাগ : স্বাস্থ্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
৭ রানে অলআউট হয়ে বিশ্বরেকর্ড
পিটিআইয়ের বিক্ষোভ : ইসলামাবাদ ও রাওয়ালপিন্ডির সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ
হেফাজতের সমাবেশে গণহত্যা: শেখ হাসিনাসহ ৪৪ জনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ
আদানির বিরুদ্ধে এবার ভারতের সুপ্রিম কোর্টে মামলা
নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেন যে ৩ বিচারক
ইসরায়েলে হামলা চালানোর সব প্রস্তুতি নিচ্ছে ইরান
বড় জয়ে বার্সার সঙ্গে ব্যবধান কমাল রিয়াল
ইসরায়েলে একদিনে ৩৪০ মিসাইল হামলা হিজবুল্লাহর, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি
ইসরায়েলি বর্বর হামলায় নিহত আরও ৩৫ ফিলিস্তিনি
কষ্টে ফলো-অন এড়ালো বাংলাদেশ
এবার তেল আবিবে হিজবুল্লাহর ২৫০ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা
পিটিআইয়ের বিক্ষোভের ডাক,লকডাউন ইসলামাবাদে
জাবিতে অটোরিকশার ধাক্কায় শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় সন্দেহভাজন রিকশা চালক আটক
আজ কিশোরগঞ্জের দানবীর, শিক্ষানুরাগী ওয়ালী নেওয়াজ খান এর ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী
'দুর্বল' দলের বিপক্ষে পয়েন্ট হারাল ইউনাইটেড
সালাহর জোড়া গোলে লিভারপুলের জয়
গুমের দায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২২ সদস্য চাকরিচ্যুত
কুরস্ক অঞ্চলের ৪০ ভাগ খোয়ানোর স্বীকারোক্তি ইউক্রেনের
মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ চীনের সাথে কাজ করতে আগ্রহী: বাণিজ্য উপদেষ্টা
হাজীদের সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষায় সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ধর্ম উপদেষ্টা ড. খালিদ হোসেন