শীতকালে থাইরয়েড সমস্যা বাড়ে
১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম | আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
দোরগোড়ায় শীত। একদিকে ওয়েদার চেঞ্জ, অন্যদিকে তাপমাত্রার পারদ নেমে যাওয়া একাধিক রোগ নিয়ে আসে। এমন সময়ে সর্দি-কাশি বা জ্বরের মতো সাধারণ অসুখগুলি থেকে বাঁচতে একাধিক পদক্ষেপ নেয়া হয়। কিন্তু শীতকালে যে রোগ বা উপসর্গ আমাদের অজান্তেই ভোগায়, সে সব থেকে বাঁচতে তেমন কোনও সুরক্ষাবিধি মেনে চলা হয় না। যেমন হাইপোথাইরয়ডিজম বা সহজ করে বললে থাইরয়েড। কারও হাইপোথাইরয়ডিজম থাকলে, শীতকালে তা ভোগাতে পারে অনেক বেশি।
সম্প্রতি কি আপনার ওজন হঠাৎ করেই অনেক বেড়ে গেছে? দীর্ঘসময় ক্লান্ত বোধ করা, ঠান্ডা অনুভব করা, ত্বকের শুষ্কতা, কোষ্ঠকাঠিন্য, দুর্বল মনোযোগের মতো ঘটনাও ঘটছে। তাহলে নিজের থাইরয়েড কার্যক্রম ঠিকঠাক আছে কিনা নিশ্চিত হয়ে নিন।
থাইরয়েড মূলত একটি প্রজাপতি আকৃতির অন্তঃস্রাবী গ্রন্থি যেটা আমাদের গলার কাছে থাকে। এটা থাইরক্সিন নামে একটি থাইরয়েড হরমোন নিঃসরণ করে শরীরের বিপাকীয় প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে।
কয়েক ধরনের থাইরয়েড সমস্যা হতে পারে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে , থাইরয়েড হরমোন কম উৎপন্ন হওয়া (হাইপোথাইরয়েড), এই হরমোন বেশি নি:সরণ হওয়া (হাইপারথাইরয়েড), থাইরয়েড ফোলা, থাইরয়েড টিউমার ও থাইরয়েড ক্যানসার। শরীরে থাকা টিস্যুগুলোর বিরুদ্ধে শরীরের অস্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য হাইপো আর হাইপার থাইরয়েডই সাধারণত বেশি হতে দেখা যায়। মূলত নারীরাই এই সমস্যায় বেশি ভুগে থাকেন।
ওজন বৃদ্ধি, ক্লান্তি, ত্বকের শুষ্কতা ছাড়াও হাইপোথাইরয়েড হলে নারীদের ঋতুচক্রে ও গর্ভধারণে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। শিশুদের বৃদ্ধিতে বাধা ও বয়ঃসন্ধি বিলম্বিত হওয়ার সমস্যাও দেখা দেয় এ কারণে।
হাইপারথাইরয়েডের সমস্যায় হঠাৎ করেই কমে যেতে পারে ওজন। দেখা দিতে পারে কাঁপুনি, উদ্বেগ, অত্যাধিক ঘাম এবং ঋতুচক্রে কম রক্তক্ষরণের মতো সমস্যা।
পরীক্ষা : তাই এসব সমস্যা দেখা দিলেই টিএসএইচ, টি৪ ও টি৩ পরীক্ষা করার করার পরামর্শ এই বিশেষজ্ঞের।
চিকিৎসা: হাইপোথাইয়েডের চিকিৎসাটা একটু দীর্ঘ। সাধারনত প্রতি ৬ মাস বা একবছর পর পর থাইরয়েডের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে হয়। নিশ্চিত থাকুন, সঠিক ডোজে দীর্ঘসময় ওষুধ গ্রহণ করলেও কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। হাইপারথাইরয়েডের ক্ষেত্রে অ্যান্টি থাইরয়েড ওষুধ দিয়ে সেটার উৎপাদন বন্ধ করা হয়। ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রেই ১৮ মাস থেকে ২ বছরের মধ্যে এই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। তাতেও সমস্যার সমাধান না হলে রেডিও আয়োডিন বিমোচন বা সার্জারি করার দরকার পড়ে। আর থাইরয়েড হরমোনের উৎপাদন স্বাভাবিক করার জন্য আয়োডিনের গুরুত্ব অনেক। খাবারে আয়োডিন কম থাকলে থাইরয়েড কম উৎপন্ন হবে অথবা থাইরয়েড ফুলে যাবে। সেই ফুলে যাওয়াকেই বলা হয় গলগন্ড রোগ। সেজন্য আয়োডিনযুক্ত লবণ খাওয়া খুব জরুরি। তবে সেক্ষেত্রে সাধারণ লবণকে ছাড়িয়ে হিমালয়ান পিংক সল্টের কোনো বাড়তি সুবিধা নেই বলেই মন্তব্য গবেষকদের।
এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে খাবার দাবার, ব্যয়াম ও যোগব্যায়ামের কোনো প্রভাব নেই। তাই এই সমস্যায় যারা ভুগছেন তাদের কোনো খাবারে বাধ্যবাধকতাও নেই।
গর্ভে ভ্রুণের মস্তিস্ক গঠনে বিশেষ করে প্রথম তিন মাসে বড় ভূমিকা রাখে থাইরক্সিন। এই সময়ে যাদের থাইরক্সিনের ঘাটতি থাকে তাদের ওষুধের ডোজ বাড়িয়ে দেয়া হয়। সেজন্য গর্ভধারণ নিশ্চিত হওয়া সাথে সাথেই এন্ডোক্রিনোলজিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার।
দীর্ঘ সময়ের চিকিৎসা হওয়ায় একটু ধৈর্য নিয়েই রাশ টানতে হবে থাইরয়েড সমস্যার।
> থাইরয়েড সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে কিছু ঘরোয়া পরামর্শ -
শরীরের প্রতিটি উপাদানেরই নির্দিষ্ট একটা মাত্রা থাকা চাই। মানুষের শরীরের জন্য থাইরয়েড হরমোনেরও একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় থাকা জরুরি। প্রয়োজনের কম বা বেশি হরমোন উৎপাদিত হলে শরীরের ওপর বিভিন্ন রকম বিরূপ প্রভাব দেখা দিতে থাকে।
কিছু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন এবং জীবনযাত্রা ঠিক রাখার মাধ্যমে থাইরয়েড সমস্যার উপশম হতে পারে।
১. প্রথমেই বাইরের প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং জাঙ্ক ফুড (এক ধরনের কৃত্রিম খাবার যাতে চর্বি, লবণ, কার্বনেটসহ ক্ষতিকারক উপাদান বেশি থাকে) পরিহার করতে হবে। এগুলো স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর এবং নিয়মিত এগুলো খাওয়ার ফলে শরীরে অনেক খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে।
২. অগোছালো জীবনযাপন পরিহার জীবনযাত্রা ঠিক করতে হবে। বর্তমানে এত এত শারীরিক ও মানসিক সমস্যা হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে এটি। স্বাস্থ্য ভালো রাখতে নিয়মিত ব্যায়াম করা অত্যন্ত জরুরি। শরীরের অতিরিক্ত ক্যালোরি কমাতে ও শরীর সুস্থ রাখতে নিয়মিত ব্যায়ামের বিকল্প নেই।
৩. খাওয়ার সময় মনোযোগ দিয়ে ভালো করে চিবিয়ে খেলে তা থাইরয়েড এবং মনের মধ্যে সংযোগ গড়ে তালে। তাই খাওয়ার সময় কখনও তাড়াহুড়ো না করে, সময় নিয়ে ভালো করে চিবিয়ে খতে হবে। শরীরের বিপাক নিয়ন্ত্রণে থাইরয়েড গ্রন্থি বিশেষ ভূমিকা পালন করে, সে জন্য সময় নিয়ে খাবার চিবিয়ে খেলে তা বিপাক ক্রিয়া বাড়াতে বিশেষভাবে সাহায্য করে।
৪. গবেষকেরা বলেন, কিছু শাকসবজি আছে যেমন, বাঁধাকপি, ব্রকলি, ব্রাসেলস স্প্রাউট, ফুলকপি ইত্যাদি এগুলো কাঁচা অবস্থায় খাওয়া ঠিক নয়। এগুলো কাচা খেলে থাইরয়েড গ্রন্থির কাজ ব্যাহত হয় এবং থাইরয়েড গ্রন্থির ভারসাম্য নষ্ট হয়। একারনে এ সবজি গুলো কাঁচা অবস্থায় বা স্যালাদ হিসেবে না খেয়ে রান্না করে খেতে হবে।
৫. নারকেল তেল গরম না করে ব্যবহার করলে তা ওজন কমাতে এবং বিপাকীয় ক্রিয়া বাড়াতে সাহায্য করে। নারকেল তেলে যে ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে তা থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়া শরীরের তাপমাত্রা ঠিক রাখতেও এই তেল অনেক কার্যকরি।
৬. হরমোন উৎপাদনের ভারসাম্যতা বজায় রাখতে অ্যাপেল সিডার ভিনেগার অনেক উপকারী। এতে বিপাক ক্রিয়ার উন্নতি হয়। এ ছাড়া এটি শরীরের ফ্যাট নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং শরীর থেকে বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ বের করে পুষ্টি শোষণে সহায়তা করে।
৭. আদায় বিভিন্ন রকম খনিজ যেমন- পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম থাকে। তাই এটি থাইরয়েড সমস্যার জন্য অনেক কার্যকর। থাইরয়েডের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত আদা চা পান করা অনেক উপকারী।
৮. থাইরয়েড সমস্যা নিয়ন্ত্রণে ভিটামিন বি খুবই সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে ভিটামিন বি১২ হাইপোথাইয়েডিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য অত্যন্ত উপকারী। তাই যেসব খাবারে এই ভিটামিন বেশি থাকে যেমন, ডিম, মাছ, মাংস, দুধ, বাদাম এগুলো প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে যাতে এগুলি শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন বি সরবরাহ করতে পারে।
৯. ভিটামিন ডি এর অভাবেও অনেক সময় থাইরয়েডের সমস্যা হয়ে থাকে। আর একমাত্র সূর্যেও আলোই শরীর ভিটামিন ডি প্রস্তত করতে পারে। তাই দিনে অন্তত পক্ষে ১৫ মিনিট সূর্যেও আলোয় থাকতে হবে। এতে শরীরে ভিটামিন ডি প্রস্ততসহ ভালোভাবে ক্যালসিয়ামের শোষণ হবে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়বে। ভিটামিন ডি বেশি পরিমাণে থাকে এমন কিছু খাবার হচ্ছে- স্যালমন, ম্যাকারেল, দুগ্ধজাতীয় দ্রব্য, কমলালেবুর রস, ডিমের কুসুম ইত্যাদি। এর পরেও শরীরে ভিটামিন ডির মাত্রা অনেক কম থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ভিটামিন-ডি সাপ্লিমেন্ট নেওয়া যেতে পারে।
১০. আয়োডিন ও খনিজসমৃদ্ধ খাবার থাইরয়েডের জন্য অনেক বেশি উপকারী। তাই যে খাবারে এই উপাদানগুলো বেশি থাকে যেমন, দুধ, পনির, দই এই ধরনের দুগ্ধজাতীয় খাবার থাইরয়েডের জন্য অনেক বেশি উপকারী। আয়োডিন সাপ্লিমেন্টও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
পরিশেষে বলতে চাই, একাধিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন বা টিএসএইচ শীতকালে বেড়ে যায়। অর্থাৎ শরীরে যে পরিমাণ হরমোনের প্রয়োজন থাইরয়েড গ্ল্যান্ড তা সরবরাহ করে না। তাছাড়াও উৎসবের মরশুম শেষে শীতকাল এলে মন খারাপ হওয়া স্বাভাবিক বিষয়। ডিপ্রেশনেও চলে যেতে পারেন অনেকে। যার ফল টিএইচএস বেড়ে যাওয়া। তাই শীতকাল পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সুস্থ থাকতে কিছু নিয়ম মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি।
মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
কলাম লেখক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
ন্যাশনাল হোমিও রিসার্চ সেন্টার চট্টগ্রাম শাখা
অলংকার শপিং কমপ্লেক্স চট্টগ্রাম
ইমেইল: [email protected]
মোবাইল: ০১৮২২-৮৬৯৩৮৯
বিভাগ : স্বাস্থ্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
খুলনায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে রংমিস্ত্রী নিহত
বাংলাদেশের মানুষ ভারতের দাদাগিরি পছন্দ করে না - শেখ নুরুল্লাহ বাহার
ভৈরবে যুবকের ফাঁসিতে ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার
প্রতিশোধ না নিয়ে হামলাকারীর প্রতি উদারতা দেখালেন বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন
ফের দরপতনে শেয়ারবাজার
বগুড়া সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি সফিক ঢাকায় সস্ত্রিক গ্রেপ্তার
বাণিজ্য মেলা আয়োজনের কাজ পেলো ফ্যাসিস্ট সরকারের অনুগত ও সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠান, উপদেষ্টার কাছে অভিযোগ
হজযাত্রী কোটা সর্বনিম্ন ১০০ জন নির্ধারণের দাবি বৈষম্য বিরোধী হজ এজেন্সি মালিকবৃন্দের
চকরিয়ায় ব্লক ইট তৈরির কারখানায় দুর্ঘটনায় দুই শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আইনজীবী নেতার বিরুদ্ধে নাগরিক কমিটির নেতার মামলা
ইসলামি অর্থনীতির স্বরূপইসলামি অর্থনীতির স্বরূপ
পুঠিয়া পৌরসভা সাবেক মেয়র মামুনের বাবার দাফন সম্পন্ন
বিজয় দিবস উপলক্ষে মানিকগঞ্জে জাসাসের উদ্যোগে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা
আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে 'পুতুলনাচের ইতিকথা'
মেঘনা সেতুতে ট্রাক-মোটরসাইকেল সংঘর্ষ, নিহত-২
নোবিপ্রবিতে ১৮০ কৃতী শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে ‘মিট আপ উইথ ভাইস-চ্যান্সেলর’ অনুষ্ঠিত
নির্যাতনের জবাব হিংসায় নয়, ৩১ দফা বাস্তবায়নের মাধ্যমে অন্যায়ের জবাব দিতে হবে: তারেক রহমান
কয়েকদিনের মধ্যেই শিক্ষা কমিশন ঘোষণা করা হবে
কায়রোতে প্রধান উপদেষ্টার সাথে মালয়েশিয়ার মন্ত্রীর সাক্ষাৎ
চার দাবিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে শিশু বিশেষজ্ঞদের অবস্থান কর্মসূচি