‘বরিশাল-ভাঙ্গা-ফরিদপুর মহাসড়ক ৬ লেন প্রকল্প’ এখনো সুদুর পরাহত
০৫ আগস্ট ২০২৩, ১০:১০ পিএম | আপডেট: ০৬ আগস্ট ২০২৩, ১২:০১ এএম
বরিশাল অঞ্চলের অপ্রশস্ত জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়ক সমূহে ক্ষমতার অতিরিক্ত যানবাহনের পাশাপাশি বেপরোয়া গতি এবং মানসম্মত যানবাহনের অভাবের সাথে চালকদের বিবেকহীন বেআইনি পরিচালন ব্যবস্থায় ভয়াবহ দুর্ঘটনার সাথে দীর্ঘত হতাহতের মিছিল। পদ্মা সেতু চালু হবার পরে পরিবহন সংস্থাগুলো ‘কে কত আগে যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারে’, এ মরণ প্রতিযোগিতায় বরিশাল-ভাঙ্গা-ঢাকা জাতীয় মহাসড়ক ছাড়াও এ অঞ্চলের সবগুলো জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কেই দুর্ঘটনা এখন নিয়মিত ঘটনা। এমনকি বেশিরভাগ পরিবহন সংস্থাগুলো যে পরিমাণ গাড়ির রুট পারমিট গ্রহণ করেছে তার কয়েকগুন বেশি যানবাহন পরিচালনা করছে বলে অভিযোগ থাকলেও বিআরটিএসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অজ্ঞাত কারণে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে।
গত ২১ জুলাই পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া থেকে বরিশালমুখী একটি যাত্রীবাহী বাসের সামনের চাকা ফেটে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাশ^বর্তী পুকুরে পড়ে গেলে ১৭ জনের মৃত্যু ছাড়াও আরো ১৮ যাত্রী আহত হয়। এর তিনদিন পরেই বরিশাল-ফরিদপুর-ঢাকা জাতীয় মহাসড়কের গৌরনদীতে দুটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ইলিশ পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস পাশ্ববর্তী ডোবায় পড়ে গেলে অন্তত ১৮ জন আহত হয়। অপর বাসটি রাস্তার পাশের গাছে আটকে রক্ষা পায়। একই দিন বরিশাল-ভাঙ্গা-ফরিদপুর মহাসড়কের গৌরনদীতে আরো দুটি দুর্ঘটনা ঘটে।
গত বুধবার একই মহাসড়কের আশোকাঠীতে এনা পরিবহনের বেপরোয়া গতির একটি যাত্রীবাহী বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি মোটরবাইককে চাপা দিয়ে দিঘীর পানিতে পড়ে গেলে মোটরসাইকেলটির চালক ঘটনাস্থলেই নিহত হন। দিঘীর পানিতে পড়ে যাওয়া বাসটির ভেতরে থাকা নারী ও শিশুসহ অন্তত ১৫ যাত্রী আহত হয়েছেন।
এ ধরনের দুর্ঘটনা ছাড়াও ছোটবড় অঘটন বরিশাল-ভাঙ্গা-ফরিদপুর-ঢাকা জাতীয় মহাসড়কসহ দক্ষিণাঞ্চলের সবগুলো জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে নিয়মিত অঘটনে পরিণত হয়েছে। মহাসড়কগুলোতে চলাচলকারী যানবাহনের সক্ষমতা পরিক্ষা ছাড়াও চালকদের দক্ষতা ও আন্তরিকতার বিষয়টি এখন আর যাচাই করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। হাইওয়ে পুলিশ এবং বিআরটিএ’র কর্মকা- নিয়ে অনেক অভিযোগের পরেও পরিস্থিতির উন্নতি লক্ষণীয় নয়। ফরিদপুরের ভাঙ্গা, মাদারীপুরের মোস্তফাপুর ও বরিশালের গৌরনদীর হাইওয়ে থানা পুলিশ প্রায়ই মহাসড়কের বিভিন্নস্থানে চৌকি বসালেও বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণসহ যানবাহন ও চালকদের সক্ষমতা নিশ্চিত করতে পারেনি এখনো। উপরন্তু বরিশালের দক্ষিণে কোনো মহাসড়কেই হাইওয়ে পুলিশের কর্মকা- নেই।
ইতিহাসে সর্বাধিক ব্যয়বহুল পদ্মা সেতুসহ সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকার ৫৫ কিলোমিটার ভাঙ্গা-মাওয়া-ঢাকা এক্সপ্রেসওয়ে ধরে রাজধানী থেকে দুটি সার্ভিস লেনসহ ভাঙ্গায় পৌঁছার পরে বরিশাল অঞ্চলের সরু মহাসড়কগুলোর অবস্থা এখন আর মোটেই মানসম্মত নয়।
এমনকি পদ্মা সেতু চালু হবার পরে ১৯৬০ থেকে ’৬৫ সালে নির্মিত বরিশাল-ফরিদপুর মহাসড়কটি বাড়তি যানবাহনের চাপ সামাল দিতে পারছে না বলেও মনে করছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞগণ। অথচ ভাঙ্গা থেকে বরিশাল বিভাগের ৬টি জেলার গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কগুলোর উন্নয়ন গত প্রায় এক দশক ধরে নানা পরিকল্পনায় আবদ্ধ। এমনকি এসব মহাসড়কের উন্নয়নে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আন্তরিকতারও কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু এখন পর্যন্ত সবকিছুই পরিকল্পনার ফাইলে এবং কতিপয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বক্তৃতায় আবদ্ধ বলে অভিযোগ রয়েছে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতে, ভাঙ্গা থেকে ৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণে বরিশাল, ১৯০ কিলোমিটার দক্ষিণে পায়রা বন্দর ও ২১০ কিলোমিটার দক্ষিণে কুয়াকাটার সাথে সংযুক্ত মহাসড়কগুলো বাড়তি যানবাহনের চাপ সামাল দেয়ার ক্ষমতা নেই। সড়ক অধিদফতরের প্রকৌশলীগণও -এর সাথে দ্বিমত পোষণ করছেন না। এসব মহাসড়ক এখনো মাত্র ১৮ ফুট থেকে ২৪ ফুট প্রস্থ। এমনকি এরমধ্যে ফরিদপুর-ভাঙ্গা-বরিশাল মহাসড়কটি নির্মিত হয় ১৯৬০ থেকে ‘৬৫ সালের মধ্যে। ১৯৭৮ থেকে ’৮২ সালের মধ্যে নির্মিত হয় বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়ক। ’৯০ সালের পরে তা কুয়াকাটা পর্যন্ত সম্প্রসারণ ঘটলেও পদ্মা সেতু চালু পরবর্তি বাড়তি যানবাহন পরিবহনের সক্ষমতা নেই এ অঞ্চলের কোনো জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কেরই। বরিশাল-ঝালকাঠী-পিরোজপুর-খুলনা মহাসড়ক ছাড়াও ঐ মহাসড়কেরই ঝালকাঠীর রাজাপুর থেকে ভান্ডারিয়া হয়ে পাথরঘাটা, বাকেরগঞ্জ থেকে বরগুনার মহাসড়কগুলোর অবস্থা আরো নাজুক। এসব মহাড়কের প্রায় সবটাই মাত্র ১৮ ফুট প্রস্থ। বহন ক্ষমতা ১০ টনেরও কম।
অথচ পদ্মা সেতু চালু হবার পরে প্রতিটি জেলার সাথেই সংযুক্ত মহাসড়গুলোতে যানবাহনের সংখ্যা তিনগুনেরও বেশী বেড়েছে। এমনকি সড়ক পরিবহন বৃদ্ধির কারণে ইতোমধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী নৌযোগাযোগ ব্যবস্থার জবনিকা কম্পমান। ফলে সড়কপথে যাত্রী ও যানবাহন ক্রমশ বাড়লেও তা বহনের সক্ষমতা নেই বরিশাল অঞ্চলের জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কগুলোর। সাথে নানা অনিয়ম ও বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রসে উদাসীনতায় প্রতিনিয়ত জানমালের ক্ষতির সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে বলে মনে করছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞগণ।
বরিশাল থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত মহাসড়কটির টেকেরহাট, মোস্তফাপুর, ভুরঘাটা, গৌরনদী, বাটাজোড় হয়ে সর্বশেষে বরিশাল মহানগরীর নথুল্লাবাদে কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, নবগ্রাম রোড-চৌমহনী, আমতলা মোড়, সাগরদী বাজার ও রূপাতলী বাস টার্মিনাল এলাকায় বিশৃঙ্খলা আর যানজট এখন নিত্যকার ঘটনা। এসব স্থানের দুধারেই ক্যারেজওয়ে পর্যন্ত অবৈধ দোকানপাটের সাথে নানা অবৈধ অবকাঠামো মহাসড়কটির গলা টিপে ধরে আছে। ফলে সুষ্ঠু, নিরাপদ ও নির্বিঘœ পরিবহন ব্যবস্থা এখন কল্পনারও অতীত। এসব অনিয়ম-অব্যবস্থার হাত ধরেই প্রতিনিয়ত বাড়ছে দুর্ঘটনার সংখ্যাও।
ফরিদপুর-ভাঙ্গা-বরিশাল-কুয়াকাটা/পায়রা মহাসড়কটি সার্ভিস লেনসহ ৬ লেনে উন্নয়নের লক্ষ্যে এশিয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় ২০১৫ সাল থেকে সম্ভাব্যতা সমিক্ষাসহ বিস্তারিত নকশা প্রনয়ণ সম্পন্ন হলেও প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষ প্রকল্পটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। মহাসড়কটি উন্নয়নে দেশীয় অর্থে ভূমি অধিগ্রহণে ১৮শ’ কোটি টাকার প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে একনেক-এর অনুমোদনসহ অর্থ বরাদ্দ হলেও প্রকল্প মেয়াদ শেষ হবার এক বছর পরেও অর্ধেক জমিও অধিগ্রহণ হয়নি। এমনকি অর্থের সংস্থান না হওয়ায় মহাসড়কটি প্রাথমিক পর্যায়ে ফরিদপুর থেকে বরিশাল পর্যন্ত ১২৪ কিলোমিটার ৬ লেনে উন্নীত করণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু এখন এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক ২০১৫ সালে সম্ভাব্যতা সমিক্ষা ও নকশার পরিবর্তে নতুন করে সব কিছু করতে বলেছে।
ফলে প্রকল্পটি নিয়ে অনিশ্চয়তা আরো বেড়েছে। এশিয় উন্নয়ন ব্যাংকের পরামর্শ অনুযায়ী পুনরায় সবকিছু তৈরি করতে চলতি অর্থ বছর শেষ হয়ে যাবারই সম্ভাবনা রয়েছে। এ ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালকের সাথে তার দাফতরিক সেলফোনে গত পনের দিন ধরে যোগোযোগের বহু চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি।
তবে বরিশাল সড়ক জোনের দায়িত্বশীল সূত্রের মতে, ‘আগামী ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি-এডিপিতে বরিশাল-ফরিদপুর মহাসড়ক ৬ লেনে উন্নয়ন প্রকল্পটি অন্তর্ভূক্তির চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে প্রকল্প-সারপত্রটি পরিরকল্পনা কমিশনে পেস করারও সম্ভব হবে। তবে ডিপিপি একনেক-এর অনুমোদন লাভ করলেও দাতা সংগ্রহের বিষয়টি নিয়ে সূত্রটি কিছু বলতে পারেন নি। প্রকল্পের কাজ শুরু আরো বহু দুরে।
পাশাপাশি এ মহাসড়কটি বরিশাল থেকে পায়রা বন্দর হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত উন্নয়ন না হলে পদ্মা সেতুসহ এক্সপ্রেসওয়ের পরিপূর্ণ সুফল দক্ষিণাঞ্চলে পৌঁছবে না বলেও মনে করছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিবহন বিশেজ্ঞগণ। এমনকি বরিশালসহ সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কগুলোতে নিত্যকার দুর্ঘটনা প্রতিরোধও দূঃস্বাধ্য হয়ে পরবে বলেও মনে করছেন মহলটি। তাদের মতে প্রতিনিয়তই এ অঞ্চলের মহাসড়কে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের সাথে যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছেই। কিন্তু সে তুলনায় মহাসড়ক সমূহের সক্ষমতা বৃদ্ধি না পাওয়াসহ চালকদের সতর্কতার অভাব পুরো দক্ষিণাঞ্চলের পথে পথে হতাহতের মিছিল ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।
বিভাগ : বাংলাদেশ
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
সার্চ কমিটি করে গ্রহণযোগ্যদের স্থানীয় সরকারে প্রশাসক নিয়োগ করার দাবি
পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের শীর্ষ নেতাদের বৈঠক
অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের অভিযোগে ভারতে ১৬ বাংলাদেশি গ্রেপ্তার
গণহত্যার পূর্ণাঙ্গ তথ্য জাতিসংঘকে দিতে নাগরিক কমিটির দাবি
ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় অন্তত ৮ ফিলিস্তিনি নিহত, পশ্চিম তীরে সংঘর্ষ অব্যাহত
এনসিটিবি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সব ছুটি বাতিল
বড়দিনে ভারতকে ‘দুঃসংবাদ’ শোনালো অস্ট্রেলিয়া
প্রেমিকের মৃত্যুর খবরে প্রাণ দিলেন প্রেমিকা
ব্রাজিলে সেতু ধস: নিহত ৪, নিখোঁজ ১০
যুদ্ধকালীন ইউক্রেনের ডাকটিকিট, সাহসিকতার ভাষায় দেশপ্রেম ও প্রতিবাদের প্রতীক
বিচ্ছেদ হতে না হতেই আবারও একসাথে তারকা জুটি বেন-লোপেজ
হাইতির হাসপাতালে বন্দুকধারীদের হামলায় নিহত তিনজন
ছাত্রদলের কমিটি : ঢাকা কলেজের সামনে ৭টি ককটেল বিস্ফোরণ
আফগানিস্তানে পাকিস্তানের বিমান হামলা, নারী-শিশুসহ নিহত ১৫
গুম হন কেন্দ্রীয় সহ-সমন্বয়ক খালেদ হাসান
বিদেশি ভুল তথ্য ঠেকানোর মার্কিন সংস্থার কার্যক্রম বন্ধ
চাঁদপুরে জাহাজে সেভেন মার্ডারের ঘটনায় মামলা
গাজায় বড়দিনে শান্তির জন্য প্রার্থনা, নিহতের সংখ্যা ছাড়লো ৪৫ হাজার
স্ত্রী-সন্তানসহ শাহরিয়ার আলমের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
মোজাম্বিকে বাংলাদেশিদের ৩শ' ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লুটপাট ও ভাঙচুর