নদীভাঙনে লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে
১২ আগস্ট ২০২৩, ০৯:৪৮ পিএম | আপডেট: ১৩ আগস্ট ২০২৩, ১২:০১ এএম
প্রতি বছর আনুমানিক ১০ হাজার হেক্টর জমি ভাঙনের কবলে পড়ে, যার প্রভাব পড়ছে এক লাখেরও বেশি মানুষের ওপর। নদীভাঙনে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে লাখো মানুষ। এ বছর পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, তিস্তা ও আড়িয়াল খাঁ নদীর ভাঙনে কুড়িগ্রাম, বগুড়া, জামালপুর, লালমনিরহাট, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, টাঙ্গাইল, শরীয়তপুর ও মাদারীপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলার মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। বাংলাদেশের মতো নদীভাঙনের শিকার দেশ বিশ্বে আর নেই। যমুনা নদী প্রায়শই তার চ্যানেল পরিবর্তন করে, যার ফলেই নদীভাঙন ঘটে বলে জানিয়েছেনর বিশেষজ্ঞরা।
টাঙ্গাইলের মাটিকাটা গ্রামে নদীভাঙনের স্থানে দাঁড়িয়ে ৯০ বছর বয়সী হাশেম আলী মুন্সি জানান, যমুনার তীর আগের মতোই বদলে যাচ্ছে। এই নদী তার যে অপূরণীয় ক্ষতি করেছে, সেই আক্ষেপ তার চোখে-মুখে তখন স্পষ্ট। এক সময় কৃষক হাশেম আলীর ভালো পরিমাণ জমিই ছিল। কিন্তু নদীভাঙন তার বসতবাড়ি ও আবাদি জমি—উভয়ই গ্রাস করেছে। ১২ বছর আগে নদীটি আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে ছিল। আর এখন নদীটি আমাদের গ্রামের বৃহৎ অংশ গ্রাস করে ফেলেছে। জমি হারানোর পর গ্রামের কৃষকরা পেশা বদলে দিনমজুরি বা রিকশা চালানো শুরু করে। গত ১২ বছরে যমুনা নদীর ভাঙনের শিকার ভূঞাপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম। বাংলাদেশে প্রতি বছর হাজারো হেক্টর জমি নদীতে বিলীন হয়ে যায়। এতে নদীতীরে বসবাসকারী মানুষ গৃহ-ভূমিহীন হয় এবং তারা নিকটবর্তী বাঁধ এলাকা, চর কিংবা শহুরে বস্তিতে গিয়ে বসবাস করতে বাধ্য হন। গত ২২ বছরে শুধু পদ্মা ও যমুনার ভাঙনে ৫০ হাজার ৯৫৫ হেক্টর জমি বিলীন হয়েছে, যা সেন্টমার্টিন দ্বীপের চেয়ে ৬ গুণ বড়। সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসের (সিইজিআইএস) তথ্য অনুযায়ী, যমুনায় ২৫ হাজার ২৯০ হেক্টর ও পদ্মায় ২৫ হাজার ৬৬৫ হেক্টর জমি বিলীন হয়েছে। সিইজিআইএস বলছে, গত ২২ বছরে এই দুই নদীর ভাঙনে ৫ লাখেরও বেশি মানুষ গৃহহীন হয়েছে। বাংলাদেশ একটি সক্রিয় বদ্বীপ। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫০ লাখ মানুষ প্রধান নদীগুলোর প্লাবনভূমিতে বাস করে, যা ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে। তাদের মধ্যে ২০ লাখ মানুষ চরাঞ্চলে বসবাস করে বলে বিভিন্ন গবেষণার বরাত দিয়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। যমুনা-মেঘনা নদী ভাঙন নিরসন প্রকল্প› শীর্ষক এডিবির আরেকটি নথিতে বলা হয়েছে, প্রধান নদীগুলোর তীরবর্তী আনুমানিক ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার জায়গা ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতি বছর আনুমানিক ১০ হাজার হেক্টর জমি ভাঙনের কবলে পড়ে, যার প্রভাব পড়ছে এক লাখেরও বেশি মানুষের ওপর। এ বছর পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, তিস্তা ও আড়িয়াল খাঁ নদীর ভাঙনে কুড়িগ্রাম, বগুড়া, জামালপুর, লালমনিরহাট, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, টাঙ্গাইল, শরীয়তপুর ও মাদারীপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলার মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।
মেঘনার উপনদী জয়ন্তীর তীরে বসেছিলেন শরীয়তপুরের গোসাইরহাট এলাকার গ্রামের ইয়ারুন্নেছা বেগম (৬৫)। তার বেশিরভাগ ফসলি জমি ও বাড়ি নদীগর্ভে হারিয়ে গেলেও হাশেম আলীর মতো স্থির থেকে অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারেননি। তার চোখে-মুখে স্পষ্ট ছিল হতাশা। বর্তমানে ইয়ারুন্নেসা বিধবা, তার ৫ মেয়ে রয়েছে। গত বছর নদী আমার ২৬ শতক ফসলি জমি গ্রাস করেছে। এখন আবার নদীভাঙন শুরু হয়েছে। শরীয়তপুরের স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন স্বপন জানান, তার পুরো ইউনিয়ন নদীবেষ্টিত এবং ইতোমধ্যে তার ইউনিয়নের ২০২ হেক্টর জমি জয়ন্তী নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী ও শরীয়তপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম এনামুল হক শামীম পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে ২ বছর আগে তার জেলার ভাঙনপ্রবণ এলাকা পরিদর্শন করেন। এরপর থেকে ভাঙনের সময় পাউবো নদীতীরে কিছু জিও ব্যাগ ফেলে। তবে জিও ব্যাগ ফেলে কার্যকরী কোনো ফল পাওয়া যায়নি বরে জানান নাসির উদ্দিন স্বপন। যেহেতু সরকারি এই উদ্যোগ গ্রামবাসীদের জন্য তেমন আশার আলো দেখাচ্ছে না, তাই ইয়ারুন্নেসার মতো মানুষের কাছে তাদের ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়া দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। বসতবাড়ির অবশিষ্ট অংশটুকুও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেলে পথে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না বলে জানান ইয়ারুন্নেসা।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কৃষক শংকর কুমার বৈদ্য কয়েক বছর আগে খোলপেটুয়া নদীর ভাঙনে তার বসতবাড়ি হারিয়েছেন। বর্তমানে তিনি স্ত্রীকে নিয়ে রাজধানীর মিরপুর-১১ নম্বরের একটি বস্তিতে থাকেন এবং ভ্যানে করে সবজি বিক্রি করেন। ‹বসতভিটা হারানোর পর আমি আমার বাড়ি ভেঙে অন্য গ্রামে চলে যাই। সেখানে বসতি স্থাপনের চেষ্টা করেছি এবং ইজারা নেওয়া এক টুকরো জমিতে চিংড়ি চাষ করে আমার ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার খামারে ভাইরাস সংক্রমণ দেখা দিলে ক্ষতির সম্মুখীন হই। তাই ঢাকায় চলে আসা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না বলেন শংকর। মেঘনা নদী থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে হাতিয়া উপজেলার নবনির্মিত কেয়ারিংচরে ২০০৭ সালে ঘর নির্মাণ করেন হাতিয়ার আব্দুল জলিল। ‹কিন্তু মেঘনার ভাঙন শুরু হলে ২০১০, ২০১৩ ও ২০১৮ সালে ৩ বার আমি বাড়ি ভেঙে ফেলি। অবশেষে ২০২০ সালে কেয়ারিংচর ছেড়ে হাতিয়া শহরে চলে আসি›, বলছিলেন জলিল। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পাউবোর মনিটরিং সেলের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫০টিরও বেশি জেলায় প্রতিবছর নিয়মিত নদীভাঙনের ঘটনা ঘটছে। চলতি বছরের ১১ আগস্ট পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন নদ-নদীর তীরবর্তী এক হাজার ৫৩টি স্থানে মোট ২৩১ কিলোমিটার জায়গা নদীভাঙনে বিলীন হয়েছে। তবে পাউবো বলছে, তারা দেশের সব ভাঙনকবলিত এলাকা পর্যবেক্ষণ করে না।
পাউবোর প্রকৌশলী রাশিদুল কবির ইনকিলাবকে বলেন, নদীতীরে কী পরিমাণ জমি বিলীন হয়েছে, তা আমরা পর্যবেক্ষণ করি না। তবে ভাঙনকবলিত ওইসব নদীতীরের দৈর্ঘ্য আমরা পর্যবেক্ষণ করি। ভাঙনরোধে যেসব এলাকায় উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন, সেখানে আমরা প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিই।› বর্তমানে পাউবো ২৪৬টি স্থানের ভাঙনরোধে উদ্যোগ নিয়েছে বা কাজ চলমান। সিইজিআইএসের উপদেষ্টা ড. মমিনুল হক সরকার বলেন, বাংলাদেশের নদীগুলোর একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কারণ এগুলো হিমালয় থেকে নেমে আসার সময় বিপুল পরিমাণ পলি নিয়ে আসছে, নতুন চরভূমি তৈরি করছে এবং ভাঙন সৃষ্টি করছে। বিশ্বের আর কোনো দেশে এমন বৈশিষ্ট্যযুক্ত নদী নেই। তিনি বলেন, কিছু কিছু এলাকায় আমরা দেখতে পাই যমুনার অনেকগুলো চ্যানেল রয়েছে এবং এটি গড়ে ১১-১২ কিলোমিটার চওড়া। ভাঙনরোধে ভাঙনপ্রবণ নদীগুলোতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নেওয়া পর্যন্ত ভাঙনরোধ সম্ভব নয়।›
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার অ্যান্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ অঞ্চলে বার্ষিক বৃষ্টিপাত বেশি হচ্ছে এবং এর ফলে বন্যা ও নদী প্রবাহের বেগ বাড়ছে। এর ফলে বাড়ছে নদী ভাঙনও। তিনি বলেন, আমি যতদূর জানি, সরকারের কোনো সংস্থা সারাদেশে নদীভাঙনের কোনো রেকর্ড রাখছে না। আমাদের ৪০০টিরও বেশি নদী রয়েছে এবং সব নদীর ভাঙনের ওপর নজর রাখা সত্যিই খুব বড় একটি কাজ।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ড. এনামুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, নদীভাঙন বাংলাদেশে একটি প্রচলিত সমস্যা এবং প্রতি বছর হাজারো মানুষ এর কারণে গৃহহীন হয়ে পড়ে। সরকারের কাছে টিন ও শুকনো খাবারের মজুত আছে। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের আমরা শুকনো খাবার ও টিন সরবরাহ করি, যাতে তারা অবিলম্বে অস্থায়ী বাড়ি তৈরি করে সেখানে বসবাস করতে পারে।
বিভাগ : বাংলাদেশ
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
কালকিনিতে ইউপি সদস্য নিহত, আহত ১০
রাজধানীতে শীতের ছোঁয়ায় শীতল সবজির বাজার
উত্তরা ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হলেন ফয়সাল তাহের
মাদারীপুরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ২ গ্রুপের সংঘর্ষ, ইউপি সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা
সংস্কার ও নির্বাচনী প্রস্তুতি একই সঙ্গে চলবে: প্রধান উপদেষ্টা
ইংরেজি নববর্ষে আতশবাজি ও পটকা ফোটানো থেকে বিরত থাকার নির্দেশ
ইন্টারপোলের তালিকায় হাসিনার নাম যুক্ত হওয়া নিয়ে যা জানা গেল, খোঁজা হচ্ছে আরও যেসব বাংলাদেশিকে
দক্ষিণ কোরিয়ার অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অভিশংসন ভোট, মুদ্রার মান পতন
কটিয়াদীতে তুচ্ছ ঘটনায় শিক্ষার্থীকে কুপিয়ে জখম
জাহাজে ছেলে হত্যা: শোকে মারা গেলেন বাবা
ভারত থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকালে বিজিবি’র হাতে ১৬ বাংলাদেশি আটক
সৈয়দপুরে রাস্তা সংস্কারে নিম্নমানের কার্পেটিংয়ের অভিযোগে কাজ বন্ধ করে দিলো ছাত্ররা
শার্শায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ২ গ্রুপে সংঘর্ষ
ইউক্রেনে আহত উত্তর কোরীয় এক সেনা আটক
টাকা খেয়ে আ.লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে ভারতের মিডিয়া : সারজিস
বাংলাদেশের সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র : জাতীয় নাগরিক কমিটি
সিরিয়ার সাবেক বিচারপতিকে গ্রেপ্তার করেছে প্রশাসন
ফেসবুকে কাকে ননসেন্স বললেন শবনম বুবলী
বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীর তালিকায় আবারো প্রবাসী বাংলাদেশি অধ্যাপক সাইদুর
পানির ট্যাংকে লুকিয়ে ছিলেন আ. লীগের ‘ভাইরাল নেত্রী’ কাবেরী