বিষাক্ত বর্জ্যে চরম হুমকিতে হালদার জীববৈচিত্র্য!

Daily Inqilab স্টাফ রিপোর্টার

২৬ জুন ২০২৩, ০৯:৫১ পিএম | আপডেট: ২৭ জুন ২০২৩, ১২:০১ এএম

 

দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র চট্টগ্রামের হালদা। বিশ্বের একমাত্র জোয়ারভাটার এই নদীতে থেকে কার্প জাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করেন জেলেরা। বছর তিনেক আগে হালদাকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণা করে সরকার। প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ ও পরিবেশগত মান উন্নয়নের মাধ্যমে রুই জাতীয় মাছের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও গাঙ্গেয় ডলফিনের আবাসস্থল সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে এই উদ্যোগ নেয় সরকার।
সে সময় মাছ ধরা বন্ধ, শিল্পকারখানার বর্জ্য নদীতে না ফেলা, মৎস্য ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর কাজ থেকে বিরত থাকাসহ ১৩টি শর্ত কার্যকরের কথা জানিয়েছিল মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। কিন্তু এরপর তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এখানো প্রতিনিয়ত নদীর কোথাও না কোথাও দূষণ লেগেই আছে। ফলে মিঠাপানির এই নদীর জীববৈচিত্র্য চরম হুমকিতে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে হালদার বাস্তুতন্ত্র দূষিত হচ্ছে। এর মধ্যে হালদার বিভিন্ন অংশে বাজারের ময়লা আর্বজনা, পল্টি ও গরু জবাইয়ের বর্জ্য প্রতিনিয়ত হালদায় ফেলা হচ্ছে। বিভিন্ন শাখা খালগুলোর মাধ্যমে শহরের শিল্প কারখানা ও আবাসিক বর্জ্য হাদলায় এসে পড়ছে। এসবের ফলে দিন দিন দূষিত হচ্ছে নদীটির পানি। নষ্ট হচ্ছে পানির গুণাগুণ। যা নদীতে থাকা মা মাছসহ জীবের জন্য বাড়াচ্ছে ঝুঁকি।
হালদা গবেষক ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ হালদায় মানবসৃষ্ট ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় হালদা নদীর বাস্তুতন্ত্র আজ জলজ জীবের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠছে। বাজারের আবর্জনা, পোল্ট্রি বর্জ্য, প্লাস্টিক, পলিথিন, বিষাক্ত বর্জ্য কঠিন ও অর্ধকঠিন আকারে ফেলা হচ্ছে। এসব বর্জ্য থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে ও দূষিত হচ্ছে বায়ু। তা ছাড়া জোয়ারের সময় এসব বিষাক্ত জৈব ও অজৈব পদার্থ পানির সঙ্গে মিশে দূষিত করছে হালদা নদীর বাস্তুতন্ত্রকে।
নদী দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে দেশের স্বাদুপানির অন্যতম প্রাকৃতিক এই মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রকে রক্ষায় প্রশাসনের পাশাপাশি বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন ও হালদা সংশ্লিষ্ট সবাইকে একসঙ্গে মিলে কাজ করার আহ্বান এই গবেষকের।
হালদা দূষণের কারণ তুলে ধরে তিনি বলেন, হালদার বিভিন্ন অংশে যেমন ফটিকছড়ি ও নাজিরহাট অংশে প্লাস্টিক, পলিথিন, বাজারের ময়লা আবর্জনা, প্লোল্ট্রি ও গরু জবাইয়ের বর্জ্য ইত্যাদি প্রতিনিয়ত সরাসরি হালদায় ফেলা হচ্ছে। এসব আবর্জনা হালদার পানিতে মিশে পানিকে দূষিত করছে। চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন ধরনের শিল্প কারখানা ও আবাসিক বর্জ্য কাটাখালি, খন্দকিয়া, কুয়াইশ, কৃষ্ণখালি ইত্যাদি শাখা খালের মাধ্যমে সরাসরি হালদা ফেলা হচ্ছে। হালদার বিভিন্ন শাখা খালের আশেপাশে গড়ে ওঠা পোল্ট্রি খামারের বর্জ্য হালদায় পতিত হচ্ছে। এসব পোলট্রি বর্জ্যে প্রচুর পরিমাণে আমোনিয়া রয়েছে যা জলজ পরিবেশকে মাছের জন্য বিষাক্ত করে তুলছে। হালদার বিভিন্ন অংশ ও শাখাখালে বিষ ব্যবহার করে মাছ ও চিংড়ি ধরা হয়। অবৈধভাবে নদীর বিভিন্ন অংশ থেকে বালু উত্তোলন। নদীর আশেপাশে ইটভাটার প্রভাব। হালদার উজানে ও বিভিন্ন স্প্যানিং পয়েন্ট পলি জমে কুম ভরাট হয়ে গেছে এতে নদীর নাব্যতা কমে আসছে।
দূষণ থেকে হালদাকে বাঁচাতে শুরুতে কর্ণফুলীকে দূষণমুক্ত ও আশেপাশের রাবার ড্যাম অপসারণসহ দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান ড. মো. শফিকুল।
তবে বর্তমানে হালদার দূষণ তুলনামূলক কমেছে বলে জানান হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়কারী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল কিবরিয়া।
তিনি বলেন, হালদা দূষণ অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। এক সময় যে পরিমাণে হাদলা দূষণ হতো সেটি আমরা বর্তমানে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছি। আগে হালদা দূষণের বড় একটি উৎস ছিল এশিয়ান পেপার মিলের বর্জ্য, যার ফলে বড় আকারের দূষণ হত এবং অনেক মাছ মারা যেত। হাটহাজারী ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পিকিং প্ল্যান্ট। এটিকেও নিয়ন্ত্রণ করা হয়ছে। এছাড়া এশিয়ান পেপার মিল তো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
তিনি জানান, হালদার বিভিন্ন পয়েন্টে ১৭টি বালুহমল ছিল যা এখন পুরোপুরিভাবে বন্ধ। সবগুলো বালুমহালের সরকার ইজারা বন্ধ করে দিয়েছে। তবে কিছু স্থানের প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে বালু তোলা হয়। সেটিও প্রশাসন তথ্য পেলে অভিযান করে জব্দ পরবর্তী শাস্তি দেয়।
মাছ শিকার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মাছ শিকাররের বিষয়টিও বলতে গেলে প্রায় শতকরা ৯৯ ভাগ বন্ধ। এক সময় মাছ শিকারের বিষয়ে প্রশাসনের ভূমিকা না থাকলেও বর্তমানের নৌ পুলিশ, হাজহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও বেসরকারি সংস্থা আইডিএফ কাজ করছে। মোটামুটি মা মাছ অনেকটা সুরক্ষিত। জাল দিয়ে মাছ শিকার কমলেও এখন বেড়েছে বিষ ছিটিয়ে মাছ নিধন। এটি জন্য প্রশাসনসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
হালদা দূষণ রোধে বড় প্রতিবন্ধকতা রাবার ড্যাম। ফটিরছড়ির ভুজপুর ও হারুয়াছড়িতে দুটি রাবার ড্যাম রয়েছে। ফলে হালদা নদীর ফটিকছড়ির থেকে নাজিরহাট অংশে প্রায় চার মাস পানি শুকিয়ে নদী মরে যায়। এটা মাছ, জীববৈচিত্র, ডলফিনসহ সবকিছুর জন্য একটা মারাত্মক হুমকি। হাদলার পরিবেশ বিপরযয়েরে জন্য অন্যতম কারণ হচ্ছে রাবার ড্যাম। আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে, রাবার ড্যাম অপসারণ করে পানির বিকল্প উৎস থেকে পানি নেয় , যাতে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
ডিম সংগ্রকারী ও পোনা উৎপাদনকারী সমিতির সভাপতি শফিউল আলম বলেন, কারখানার বর্জ্য আসা বন্ধ হলেও নদীর আশেপাশে বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা পল্টি ফার্মের বজ্যগুলোর মাধ্যমে দূষণ হচ্ছে হালদা। এছাড়ার মাছ ধরার জন্য যে বিষ দেয়া হয় সেগুলোর কারণে ছোট মাছ মারা যায়, মা মাছগুলো রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে।
হাদলা দূষণ বিষয়ে চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী বলেন, হালদায় এখন বড় কোন দূষণ নেই। তবে ছোট ছোট যে দূষণগুলো আছে যেগুলো আমরা জেলা প্রশাসনকে জানায়। দূষণ পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব না। হালদার একেবারে কমিয়ে আনতে স্থানীয়রাসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার।

 


বিভাগ : বাংলাদেশ


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

গোলরক্ষক বীরত্বে ১০ জনের ইউনাইটেড হারাল আর্সেনালকে

গোলরক্ষক বীরত্বে ১০ জনের ইউনাইটেড হারাল আর্সেনালকে

৯ দফা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ কতদূর?

৯ দফা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ কতদূর?

মর্গের দুই লাশের দাবিদার দুই পরিবার,

মর্গের দুই লাশের দাবিদার দুই পরিবার,

আইনজীবীকে হত্যার হত্যাচেষ্টা: শেখ হাসিনা-জয়সহ ৯৩ জনের মামলা এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ

আইনজীবীকে হত্যার হত্যাচেষ্টা: শেখ হাসিনা-জয়সহ ৯৩ জনের মামলা এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ

তথ্য থাকলেও সন্দেহজনক লেনদেনে দেরিতে ব্যবস্থা নিচ্ছে বিএফআইইউ!

তথ্য থাকলেও সন্দেহজনক লেনদেনে দেরিতে ব্যবস্থা নিচ্ছে বিএফআইইউ!

সাবেক এমপি হেনরীর ৫৬ কোটি টাকার সম্পত্তি জব্দের নির্দেশ,

সাবেক এমপি হেনরীর ৫৬ কোটি টাকার সম্পত্তি জব্দের নির্দেশ,

গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগে উৎকণ্ঠায় নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ীরা

গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগে উৎকণ্ঠায় নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ীরা

দেশে এইচএমপি ভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত

দেশে এইচএমপি ভাইরাস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত

শাহজালাল বিমানবন্দরে বিমান বাহিনীর সদস্যদের অপসারণে আইনি নোটিশ

শাহজালাল বিমানবন্দরে বিমান বাহিনীর সদস্যদের অপসারণে আইনি নোটিশ

চকরিয়ায় পুলিশ-সন্ত্রাসীদের মধ্যে গোলাগুলি: বসতবাতিতে আগুন, ওয়ার্ড মেম্বারসহ আহত ২

চকরিয়ায় পুলিশ-সন্ত্রাসীদের মধ্যে গোলাগুলি: বসতবাতিতে আগুন, ওয়ার্ড মেম্বারসহ আহত ২

স্বাধীন সামরিক বাহিনী সংস্কার কমিশন গঠনের প্রস্তাব

স্বাধীন সামরিক বাহিনী সংস্কার কমিশন গঠনের প্রস্তাব

শেখ হাসিনার চোখ ছিল শুধু ঢাকা থেকে টুঙ্গীপাড়া পর্যন্ত : সারজিস

শেখ হাসিনার চোখ ছিল শুধু ঢাকা থেকে টুঙ্গীপাড়া পর্যন্ত : সারজিস

শেখ হাসিনা ভারতের সাথে বৈষম্যমৃলক চূক্তি করেছিলেন-মৌলভীবাজারে সারজিস আলম

শেখ হাসিনা ভারতের সাথে বৈষম্যমৃলক চূক্তি করেছিলেন-মৌলভীবাজারে সারজিস আলম

ব্র্যাক ব্যাংকের টপ টেন রেমিটেন্স অ্যাওয়ার্ড জয় ২০২৪ সালে ১.৬ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স সংগ্রহ

ব্র্যাক ব্যাংকের টপ টেন রেমিটেন্স অ্যাওয়ার্ড জয় ২০২৪ সালে ১.৬ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স সংগ্রহ

ওসি মুহিবুল্লাহকে বাঁচাতে স্বজনদের মানববন্ধন

ওসি মুহিবুল্লাহকে বাঁচাতে স্বজনদের মানববন্ধন

পাটগ্রাম সীমান্তে বাংলাদেশিকে লক্ষ্য করে বিএসএফের গুলি, আহত ১

পাটগ্রাম সীমান্তে বাংলাদেশিকে লক্ষ্য করে বিএসএফের গুলি, আহত ১

ওয়ান টাইম প্লাস্টিক বন্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ৬ হাজার প্রতিষ্ঠান: বিপিজিএমইএ

ওয়ান টাইম প্লাস্টিক বন্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ৬ হাজার প্রতিষ্ঠান: বিপিজিএমইএ

চলমান সংস্কার গতিশীল করতে হবে, যাতে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে : মান্না

চলমান সংস্কার গতিশীল করতে হবে, যাতে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে : মান্না

ফরিদপুরে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় তিন দিনে মোট ১১ জন নিহত, আহত ৩৫

ফরিদপুরে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় তিন দিনে মোট ১১ জন নিহত, আহত ৩৫

বিধ্বংসী শতকে লিটনের জবাব, ঝড়ো সেঞ্চুরি তানজিদেরও, বিপিএলে রেকর্ড

বিধ্বংসী শতকে লিটনের জবাব, ঝড়ো সেঞ্চুরি তানজিদেরও, বিপিএলে রেকর্ড