শিক্ষা বোর্ডগুলো থেকে বছরে শত শত কোটি টাকা লুট
২০ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৪১ পিএম | আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫৮ পিএম
শিক্ষার্থীদের টাকায় পরিচালিত দেশের সাতটি শিক্ষা বোর্ড, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে খাতা সরবরাহের নামে শত শত কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। আওয়ামী ফ্যাসিষ্ট সরকারের মদদপুষ্ট মাত্র ৫ টি প্রতিষ্ঠান হরিলুটের রাজত্ব কায়েম করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তা ও শিক্ষা বোর্ড কর্মকর্তাদের যোগসাজসে কিছু শর্ত জুড়ে দিয়ে ২০১৭ সাল থেকে এই ৫টি প্রতিষ্ঠানকে খাতা সরবরাহের এককছত্র ক্ষমতা প্রদান করে। যার বদৌলতে প্রতিষ্ঠান ৫টি দেশের ৭টি শিক্ষা বোর্ড ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক পরীক্ষার খাতা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগির মাধ্যমে গলাকাটা দর দিয়ে সরবরাহ করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ২০১৭ সালের আগে কাগজ, ওএমআর সিট আলাদাভাবে ক্রয় করে টেন্ডারের মাধ্যমে সহজ শর্তে মুদ্রন ও তৈরী’র করে আসছিল। এর ফলে কোটি কোটি টাকা কমে খাতা তৈরী করে আসছিল বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। জুলাই-আগষ্ট বিল্পবের পর ঘাপটি মেরে থাকা আওয়ামী ফ্যাসিষ্ট সরকারের দোসরেরা আবারও আসন্ন এসএসসি ও এইএসসি পরীক্ষার খাতা সরবরাহের জন্য আগের নিয়মেই টেন্ডার (ইজিপি) করানোর মাধ্যমে ভাগাভাগির পাঁয়তারা শুরু করেছে। উল্লেখ্য করে শিক্ষা বোর্ডগুলি সরকারী বরাদ্দ ছাড়াই পরীক্ষার ফরম পূরণসহ বিভিন্ন খাতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেয়া টাকায় পরিচালিত হয়ে থাকে।
দেশের বিভিন্ন বোর্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, শিক্ষা বোর্ড এর হর্তা কর্তা হলো চেয়ারম্যান ও সচিব। শিক্ষা মন্ত্রণালয় পেষনে দেশের বিভিন্ন সরকারী কলেজের প্রফেসর ও প্রভাষকদের পেষনে শিক্ষা বোর্ডগুলির চেয়ারম্যান সচিবসহ অন্তত ৭টি পদে পদায়ন করে থাকে। পদায়নের ক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ টাকার ঘুষ বানিজ্যের অভিযোগ একপ্রকার রীতিতে পরিণত হয়েছে। পেষনে আসার পর বছরের পর বছর এক জায়গায় থেকে অধিকাংশ কর্মকর্তাই শিক্ষকতাই ভুলে যায়। হাতিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা। বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যে থেকে জানা গেছে, মূলত ২০১৭ সাল পর্যন্ত পাবলিক পরীক্ষার খাতা তৈরীতে টেন্ডারের মাধ্যমে পৃথকভাবে কাগজ ও ওএমআর শিট ক্রয় করা হতো। পরবর্তীতে খাতার কভার মুদ্রণসহ তৈরীর জন্য টেন্ডার আহবান করা হতো। মুদ্রণ ও খাতা তৈরীর জন্য সাধারনত মুদ্রণালয় ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান অংশ নিত। ফলে প্রতিযোগিতামূলক দর পড়তো। পাবলিক পরীক্ষা যেহেতু এই স্পর্শকাতর বিষয় তাই অনেক শিক্ষা বোর্ড নিজস্ব অর্থায়নে মুদ্রন যন্ত্র বোর্ড চত্বরে বসিয়ে মুদ্রণ কাজ করে সেখানেই ওএমআর (বোর্ডের সরবরাহ করা) দিয়ে খাতা তৈরী করে দিত। ঢাকা বোর্ডসহ কয়েকটি বোর্ড তাদের নিজস্ব ভবনেই টেন্ডার প্রাপ্তদের মুদ্রন যন্ত্র বসিয়ে খাতা তৈরীর কাজটি সম্পন্ন করতো। ২০১৭ সাল পর্যন্ত একটি মূল খাতা তৈরীতে খরচ হতো সর্বোচ্চ ১১ টাকা। অতিরিক্ত ও ব্যাবহারিক খাতা তৈরীতে খরচ পড়তো দুই ও দেড় টাকা।
২০১৭ সালে আওয়ামী ফ্যাসিষ্ট সরকারের মদদপুষ্ট ৫টি প্রতিষ্ঠান মোটা অংকের অর্থ দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি প্রজ্ঞাপন জারীর মাধ্যমে প্রতিযোগিতা মূলকভাবে খাতা তৈরীর পথ রুদ্ধ করে দেয়। ওএমআর মুদ্রণ মেশিন থাকা আবশ্যকিয় করে জামানতের অংক বাড়িয়ে ২০১৭ সাল পর্যন্ত খাতা সরবরাহের কাজ করে আসা অপেক্ষাকৃত ছোট প্রতিষ্ঠানগুলিকে টেন্ডারে অংশগ্রহনের সুযোগ কেড়ে নেয়। রাজত্ব কায়েম হয় আওয়ামী ফ্যাসিষ্ট সরকারের মদদপুষ্ট মাষ্টার সিমেক্স, মনস্পুল, ইষ্ট ওয়েজ ও এলিট ও এশিয়া প্রিন্টার্স নামে ৫টি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে এশিয়া প্রিন্টাস আইনি লড়াই করে এক থেকে দুটি প্রতিষ্ঠানের সরবরাহের কাজ পায়। এরপরও বাকি ৪টি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বেধে দেয়া গলাকাটা দর দিতে বাধ্য হয়। যদিও এশিয়া প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার উল্লেখিত ৪টি প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেটের সাথে কোন সম্পৃক্ততা নাই বলে জানান। তবে তিনি এও বলেন, পত্রিকায় রিপোর্ট করে কি হবে এর আগে দুদকে অভিযোগ করেও কোন ফল হয়নি।
বোর্ডগুলি থেকে প্রাপ্ত এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে সিন্ডিকেট সৃষ্টির পর থেকে একটু রয়ে সয়ে দর বৃদ্ধি বা লুটপাট শুরু করা হয়। ছাত্র জনতার বিল্পপে আওয়ামী ফ্যাসিষ্ট সরকারের পতনের আগে ২০২৩ সাথে ডাকাতি’র মত একেকটি খাতার দর প্রায় দ্বিগুন করে দর দেয়া হয় এবং সরবরাহ করে বিলও উত্তোলন করা হয়। সুত্রটির মতে ২০২১ সালে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে একটি অতিরিক্ত ও ব্যবহারিক উত্তরপত্র এক দশমিক ৪৪৯ পয়সা, ২০২২ সালে একটি মূল উত্তরপত্র ১৪দশমিক ৭৯১ পয়সায় সরবরাহ করে সিন্ডিকেটধারী প্রতিষ্ঠানগুলি। ২০২৩ সালে এই উত্তরপত্র সরবরাহ করা হয় ২২ দশমিক ৯৭১ পয়সা। কুমিল্লা বোর্ডে প্রতিটি ২৩ টাকা এবং ঢাকাসহ অন্যান্য বোর্ডেও ২২টাকার বেশী দরে সরবরাহ করা হয়। সর্বকনিষ্ট শিক্ষা বোর্ড হিসাবে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডে গত বছর (২০২৩) মূল উত্তরপত্র তৈরী করা হয় ৫০ লক্ষ টি। অন্যান্য বোর্ডে এর পরিমাণ আরো বেশী। দেশের ৭ টি বোর্ড ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে কম করে হলেও ৮ থেকে ১০ কোটি মূল উত্তরপত্র তৈরী করা হয়। প্রতিটি উত্তরপত্রে ১০ টাকা করে বেশী দর দেয়ায় কত কোটি টাকা লুট করা হয়েছে তা দূর্ণীতি দমন কমিশনের পক্ষেই হিসাব করে বের করা সম্ভব। যদি বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের দূর্ণীতি দমন কমিশন মনোযোগী হয়। একইভাবে ২০২১ সালে অতিরিক্ত উত্তরপত্র তৈরী করা হয় মাত্র এক দশমিক ৪৪৯ পয়সা অর্থাৎ দেড় টাকারও কম। এই উত্তরপত্র ২০২৩ সালে শিক্ষা বোর্ডগুলি গ্রহন করেছে ৮ দশমিক ৪৯১ পয়সা অর্থাৎ সাড়ে আট টাকার সামান্ন কম। অর্থাৎ প্রতিটি খাতায় বেশী দর দেয়া হয়েছে ৮ টাকারও বেশী। যদিও বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড আলাদাভাবে কাগজ ও ওএমআর শিট ক্রয় করে নিজেদের মুদ্রন যন্ত্রে কভার মুদ্রন করে বহিরাগত বাইন্ডারদের দিয়ে একেকটি উত্তরপত্র মাত্র ১১ টাকায় তৈরী করে নজির স্থাপন করেছেন।
মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয় ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ও দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড এর সদস্য সচিবের সাথে। দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড সচিব জানান টেন্ডার প্রক্রিয়া হয়েছে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক আর ঢাকা বোর্ড সচিব এ এব্যারে কথা বলতেই অপারগতা প্রকাশ করেন।
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে এক পর্যায়ে ছাত্র-জনতার বিল্পপের মুখে লুটপাটের রাজত্ব কায়েমকারী আওয়ামী সরকারের বিদায় ঘন্টা বাজলেও ছাত্র-ছাত্রীদের টাকায় পরিচালিত বোর্ড এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দোসরদের অধিকাংশই এখন বহাল তবিয়তে রয়েছে। শুধু তাই আসন্ন এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার উত্তরপত্র (খাতা) তৈরীর মাধ্যমে লুটের রাজত্ব অব্যাহত রাখার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। লুটপাট বন্ধ করা হলে শিক্ষার্থীদের পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহনের জন্য ফরম পূরন ফিসহ অন্যান্য খরচ অনেক কমে আসবে। উপকৃত হবে দেশের কোটি কোটি অভিভাবক।
বিভাগ : বাংলাদেশ
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র বৈঠক, হাসিনাকে ফেরানো নিয়ে আলোচনা থাকবে
রামু সেনানিবাসে সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালিত
এক সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ল ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার
প্রবাসীদের যে জন্য সুখবর দিলো মালয়েশিয়া
জাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, তদন্ত কমিটি গঠন, ফটকে তালা, মশাল মিছিল
মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল
"নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরছেন গ্লোবাল তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি"
ড. ইউনূসকে নিয়ে খালেদা জিয়ার পুরোনো যে বক্তব্য ভাইরাল
নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের শুভ কামনা
আলোচনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার ‘টুস করে ফেলে দেয়ার’ হুমকি
দীর্ঘ ১৫ বছর সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি: খোকন
'ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে অভিনেতা তারিক আনাম খানের নাটক'
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ