টেকনাফ অপহরণের স্বর্গরাজ্য-গেল বছরে ১৯২ জনের অপহরণ
০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৭:০৬ পিএম | আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৭:০৬ পিএম
একদিকে রোহিঙ্গার চাপ, ইয়াবাসহ মাদকে সয়লাব হওয়া সীমান্তবর্তী উপজেলা টেকনাফে নতুন করে দেখা দিয়েছে অপহরণ বাণিজ্য।অপহরণ আতঙ্কে তটস্থ এলাকাবাসী। ইতিপুর্বে এখানকার বাসিন্দারা মিয়ানমারে যুদ্ধের কারণে গোলাবারুদের বিস্ফোরণজনিত আতঙ্কে দিন কাটাত।বর্তমানে এর চেয়ে বড় আতঙ্কের নাম এই অপহরণ-মুক্তিপণ বাণিজ্য। এখন কে, কখন অপহরণের শিকার হয়, সেই চিন্তায় আতঙ্কগ্রস্ত থাকে সবাই। দিন দিন এ ধরনের ঘটনা বেড়ে চললেও কোনো স্থায়ী সমাধান মিলছে না। একের পর এক অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনায় আতঙ্ক এবং ক্ষোভ বাড়ছে স্থানীয়দের মাঝে।
পর্যটন, সীমান্ত ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা কারণে এ উপজেলা গুরুত্বপূর্ণ। তবে ২০১৭ সালে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে উখিয়া টেকনাফে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে এখানকার স্থানীয়রা এমনিতেই নানা সংকটে পড়েছেন, তার ওপর এখন যুক্ত হয়েছে অপহরণ আতঙ্ক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র বলছে, গত এক বছরে টেকনাফে অন্তত ১৯২ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৯১ জন স্থানীয় ও বাকিরা রোহিঙ্গা। এর মধ্যে অন্তত ১৫০ জনকে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেতে হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন অভিযানে অনেকে উদ্ধার হলেও, আবার অনেকে ফিরেছেন মুক্তিপণ দিয়ে। মাঝেমধ্যে অপহৃত ব্যক্তির মৃতদেহ মিলেছে পাহাড়, বন-জঙ্গল, ডোবা-নালায়। এমন প্রেক্ষাপটে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে সেনা অভিযান চালানোর দাবি করছেন স্থানীয় বাসিন্দাসহ সচেতন নাগরিক।
পুলিশ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা জানান, গত ৩০ ও ৩১ ডিসেম্বর দুই দিনে টেকনাফে ২৭ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। এর পরে টেকনাফের বাহারছড়ায় মুদির দোকানি জসিম উদ্দিনকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে নিয়ে যায় মুখোশধারীরা। ওইদিন সকালেই হ্নীলা ইউনিয়নের জাদিমুড়া এলাকায় বনে কাজ করতে যাওয়া রোহিঙ্গাসহ ১৯ জন শ্রমিক অপহরণের শিকার হন। তাদের পরিবারের কাছে ফোন করে অপহরণকারীরা জনপ্রতি এক লাখ টাকা করে মুক্তিপণ দাবি করে। তবে এ অপহৃতদের মধ্যে ১৮ শ্রমিককে হ্নীলা ইউনিয়নের লেদার রংগীখালী পশ্চিমের দুর্গম পাহাড় থেকে উদ্ধার করেছে র্যাব ও পুলিশ।
সীমান্ত এলাকা টেকনাফ এতোদিন ইয়াবা, আইস, স্বর্ণসহ অন্যান্য চোরাচালানের জন্য পরিচিত থাকলেও বর্তমানে অপহরণের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে অপহরণ বাণিজ্য। চরম অনিশ্চয়তা ও আতঙ্কে দিন অতিবাহিত করছে সাধারণ মানুষ, ছাত্র, পেশাজীবি, কৃষক, শ্রমিক, সিএনজি অটোরিকশার চালকসহ বন বিভাগের সদস্যরাও। দিনে দুপুরে দুষ্কৃতকারী, ডাকাতদল, অপহরণকারীরা টার্গেট করে খেত-খামার, বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ঢালু, পাহাড়, বন জঙ্গল থেকে অস্ত্রের মুখে লোকজনকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। এতে গেলো এক বছরে প্রায় দু’শত ব্যক্তি পাহাড়ি সশস্ত্র ডাকাতদলের হাতে অপহরণের শিকার হয়েছে।
বিশ্বস্ত সুত্রে জানা যায়, দুর্গম পাহাড় ঘিরে কয়েকটি স্বশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে। যাদের সংখ্যা ৩-৪শ’র মতো। যারা পাহাড়ে পাহাড়ে তৈরি করেছে বিশেষ আস্তানা। কিছু সংখ্যক স্থানীয়দের আশ্রয় প্রশ্রয়ে চলছে এমন অপরাধ কর্মযজ্ঞ। বিগত সরকারের সময় এই চক্রটিকে কতিপয় প্রভাবশালীর পৃষ্টপোষকতার অভিযোগ ছিল। কিন্তু জুলাই বিপ্লবোত্তর সময়ে এসেও তা বন্ধ না হওয়ায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েছে বহুগুণ। টেকনাফের মানুষ মনে করেন, সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হলে এই ভয়াবহ অপরাধ রোধ করা সম্ভব।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, টেকনাফের বাহারছড়া, জাহাজপুরা, লেদা, মুছনি, হ্নীলা, রইক্ষ্যং, জাদিমুড়া ও হোয়াইক্যংয়ে বেশি অপহরণের ঘটনা ঘটে। সবচেয়ে বেশি বাহারছড়ার নোয়াখালীপাড়া, বড় ডেইল, মাথাভাঙা, জাহাজপুড়া, ভাগগুনা, মারিশবনিয়া, হোয়াই্যকংয়ের ঢালা, চৌকিদারপাড়া, দক্ষিণ শীলখালী গ্রামের মানুষ বেশি অপহরণ ভয়ের মধ্য আছেন। মূলত পাহাড়ি এলাকাগুলোয় বেশ কয়েকটি অপহরণ চক্র সক্রিয়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, আর্থিকভাবে সচ্ছল বা প্রবাসে আত্মীয়-স্বজন রয়েছে-এমন পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। অপহরণ চক্রের হাত থেকে নিস্তার পাচ্ছে না স্থানীয় বাসিন্দা, রোহিঙ্গা নাগরিক, এমনকি ভ্রমণে আসা পর্যটক-কেউই ।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, অপহরণের অধিকাংশ ঘটনার রহস্যভেদ করতে পারছে না পুলিশ ও অন্যান্য আইন–শৃংখলাবাহিনী। তারা শুধু অপহরণের ঘটনা ঘটলে কিছুটা তৎপরতা দেখায়। ঘটনার পর তদন্তে বা অপরাধীদের গ্রেপ্তারে কোনো অগ্রগতি থাকে না।
এমনকি অপহরণের পর খোঁজ না পাওয়ার মানুষের লাশ মিলছে পাহাড়, বন বাদাড়ে। দিন দিন এ ধরনের ঘটনা বেড়ে চললেও নেই উল্লেখযোগ্য প্রতিকার। কারা এসব করছে, কেন করছে-প্রশ্নের জবাব মিলছে না কারও কাছে, সুরাহাও হচ্ছে না এসব প্রশ্নের। এদিকে, অপহরণ ও মুক্তিপণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় আতঙ্কে দিন কাটছে স্থানীয় বাসিন্দা ও রোহিঙ্গাদের। অপহরণের পর অনেকে মুক্তিপণ দিয়ে ফিরলেও আবারও একই ঘটনার শিকার হওয়ার আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটছে।
এদিকে টেকনাফের পাহাড়ে সেনা বাহিনীর নেতৃত্বে বিশেষ অভিযানের দাবিতে ইতিমধ্যে অবস্থান কর্মসূচি ও স্মারকলিপি প্রদান করেছেন স্থানীয় জন সাধারণ ও সচেতন মহল। বিভিন্ন পেশাজীবী, রাজনীতিবিদসহ অনেকেই সেই অবস্থান কর্মসুচিতে সংহতি জানিয়েছেন। অবস্থান কর্মসূচিতে বক্তারা বলেন, গত কয়েক বছর ধরে টেকনাফের পাহাড়কেন্দ্রিক রোহিঙ্গা ও স্থানীয় কতিপয় অপরাধের নেতৃত্বে স্বশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী পাহাড়ে অবস্থান নিয়েছে। তারা কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে সাধারণ স্থানীয় মানুষ ও রোহিঙ্গাদের অপহরণ করে পাহাড়ে জিম্মি করে আসছে। ওখানে নিমর্ম নির্যাতন -পরবর্তী মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা ও হত্যা ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে।
টেকনাফের বিভিন্ন পয়েন্টে প্রতিদিন অপহরণ বাণিজ্য থেকে পরিত্রান পাবার জন্য টেকনাফের হোয়াইক্যং, উখিয়া সদরসহ কক্সবাজারের বিভিন্ন পয়েন্টে এলাকাবাসী, সচেতন মহলের মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করছে। এসব মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসুচী থেকে অপহরণ, গুম, খুন বন্ধ করার জন্যে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়।
কক্সবাজারে পালিত মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি শেষে প্রধান উপদেষ্টা ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বরাবরে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্মারকলিপি দেয়া হয়। স্মারকলিপিটি গ্রহণ করে জেলা প্রশাসকের পক্ষে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) নিজাম উদ্দিন আহমদ।
এসময় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) নিজাম উদ্দিন আহমদ বলেন, টেকনাফের অপহরণের বিষয় অবহিত রয়েছে। যেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান অব্যাহত রাখলেও রোধ করা যাচ্ছে না। স্মারকলিপি যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে।
এ বিষয়ে টেকনাফ মডেল থানার ওসি মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বলেন, প্রযুক্তির সহায়তায় অপহৃতদের অবস্থান জানার চেষ্টা করে পুলিশ। আমরা গত জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩৮ জন অপহৃতকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি। ২০টি মামলায় বেশ কয়েকজন অপরাধীকে আটক করা হয়েছে।
কক্সবাজার র্যাব–১৫–এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন গনমাধ্যমকে বলেন, দুুর্গম পাহাড়ে র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি অভিযানে অনেককে গ্রেপ্তারও করেছে র্যাবের আভিযানিক দল। সর্বশেষ ৩১ ডিসেম্বর দীর্ঘ অভিযানে বনে অপহৃত ১৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি অপহৃতদের উদ্ধারের অভিযান চলছে।
বিভাগ : বাংলাদেশ
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
আশুলিয়া থানায় নতুন ওসি হিসেবে যোগ দিলেন নুরে আলম সিদ্দিক
আগুন দেওয়া হয়েছে আলিয়ার অস্থায়ী আদালতে, বকশীবাজার সড়ক অবরোধ
জকিগঞ্জে ক্রসফায়ারের চার বছর পর ওসির বিরুদ্ধে মামলা
আজকের মধ্যে ন্যায় বিচারের ইঙ্গিত না পেলে শাহবাগ ব্লকেডে যাবেন বিডিআর পরিবারের সদস্যরা
চুয়াডাঙ্গায় সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ৯ দশমিক ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস;স্বাভাবিক জনজীবন আড়ষ্ট
কুষ্টিয়ায় ইটভাটায় অভিযান, জরিমানা ১২ লাখ টাকা
পদ্মা নদীতে অবৈধ বালি উত্তোলনের দায়ে ৯ জনকে কারাদণ্ড
মা-ছেলের মিলনে আবেগাপ্লুত ভক্ত-সমর্থক; অরুণা বিশ্বাসের তেলবাজি, কটাক্ষের শিকার
শেরপুরে শপিংমলে ভেসে উঠল ‘ছাত্রলীগ' ও জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান: আটক-২
বিমানবন্দরে নরওয়ের নাগরিকদের হেনস্থা, একজনকে বেধরক মারধর
বিডিআর বিদ্রোহের বিচার: বকশীবাজারে শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ, ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনী
এ দেশে অন্য কোনো দেশের দাদাগিরি চলবে না : হাসনাত
গ্রিনল্যান্ড স্বাধীন হতে পারে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের রাজ্য হবে না ডেনমার্ক
যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে প্রচণ্ড দাবানল, মৃত্যু ৫
চার দেশের ভূখণ্ড নিয়ে ‘বৃহত্তর ইসরায়েলের’ মানচিত্র প্রকাশ, প্রতিবাদের ঝড়
ইবিতে শহীদ জিয়াউর রহমান স্মৃতি সংগ্রহশালা স্থাপনে কমিটি গঠন
টিউলিপ মিথ্যা বলেছেন কি না, তদন্ত করবে ব্রিটিশ সরকার
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা আজহারের রিভিউ শুনানি ২৩ জানুয়ারি
দাঁড়িয়ে থাকা বালুবাহী ট্রাকে মোটরসাইকেলের ধাক্কা, নিহত ২
চীনের অবিশ্বাস্য সামরিক উত্থানে টনক নড়েছে ভারতের!