স্বাধীনতা দিবস : স্বপ্ন নয় বাস্তবের কথা বলতে হবে
২৫ মার্চ ২০২৩, ০৭:৫১ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৭:৪৭ এএম
অনেকগুলো স্বাধীনতা দিবস পেরিয়ে আরও একটি স্বাধীনতা দিবস আমরা পালন করছি জাঁকজমকের সাথে। অর্র্থনৈতিক প্রগতি সম্বন্ধে মাঝেমধ্যেই আমাদের ভাল ভাল কথা শোনানো হয়। এক সময়, বলা হয়েছিল স্টক মার্কেটের অবস্থা সহসাই স্থিতিশীল হয়ে যাবে। কিন্তু হচ্ছেটা কই? এ ব্যবসায় যারা জড়িত তাদের অনেকেই ইতিমধ্যে পুঁজি হারিয়ে স্ত্রীর গহণা বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন। এমন খবরাখবর বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। সুস্থ আমাদের বিদেশী মুদ্রার ভান্ডার, ক্ষেতে খামারে উৎপাদন বাড়ছে ইত্যাদি কথাও এক সময় আমাদের শোনানো হতো। বার বার আমজনতাকে এসব গেলানোর পাশাপাশি বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে দেশের উত্থান ঘটছে। অনেকের মতে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও উন্নতি সম্ভব হয়েছে।
এসব শোনার পাশাপাশি আমরা মধ্যবিত্তরা যদি নাকের ডগার বাইরে মুখ রাখি, তবে দেখতে পাব, যেসব কথা বলা হয়, তার মধ্যে অসত্য আছে প্রচুর। তবে এ কথা ঠিক, মুক্ত বাণিজ্যের ফলে বিশ্বায়নের সুবিধা হিসেবে এমন অনেক পণ্য ও সেবা মুঠোর মধ্যে এসে হাজির হচ্ছে প্রতিনিয়ত, আজ থেকে দশক দুই আগে যা কল্পনার অতীত। যা হোক, বিশ্বায়ন, উদারীকরণ ও বেসরকারীকরণের প্রশংসা গাওয়া সুবিধাভোগী এক শ্রেণীর মানুষের বৃত্তের বাইরে পা রাখলে বাস্তব চিত্রটি কিন্তু আমাদের কাছে একেবারে পরিষ্কার হয়ে যায়। আকাশছোঁয়া ইমারতগুলোর পাশে রয়েছে দুর্গন্ধময় বস্তিবাসীর জীবনের হা-হুতাশের কাহিনী। ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে মোটর সাইকেল-টয়োটা-ফোরস্ট্রোক যেতে যেতে একটু নিচের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে এখনো অধিকাংশ মানুষের প্রবেশাধিকার ঘটেনি।
‘সার্ক’ এর ‘শিশুকন্যাবর্ষ’ উপলক্ষে কয়েক বছর আগে প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যে প্রকাশ পেয়েছে, আমাদের দেশে কন্যাশিশুর ২০ ভাগ পনের বছরের বেশি বাঁচে না। এদের বেশিরভাগ মারা যায় অপুষ্টির কারণে। অনেকে আবার বিকলাঙ্গ হয়ে যাচ্ছে। এদিকে ইউনিসেফ’র দেওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, প্রতি বছর নিউমোনিয়া রোগে দেশে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা লক্ষাধিক। পাকিস্তান, ভারত, নাইজেরিয়া, ইথিওপিয়া, কংগো, আফগানিস্তান ইত্যাদির মতো গরীব অনুন্নত দেশগুলোর অবস্থা আমাদের থেকে কিছুটা ভাল, অন্তত পরিসংখ্যান তাই বলে। বাংলাদেশে ৮৫ ভাগ পরিবারের ব্যাংক একাউন্ট নেই কেননা তাদের টাকা নেই বা তারা এসব বুঝে না। দেখা গেছে, মানুষের উপার্জনের উৎস প্রয়োজন অনুযায়ী বাড়ছে না বরং যে উৎসগুলো এতদিন পর্যন্ত বেঁচেবর্তে ছিল, সেগুলো ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। বিকল্প উপার্জনের সুযোগ তেমন করে বাড়ছে কোথায়? কৃষিক্ষেত্রগুলো ক্রমে ছোট হয়ে আসছে। ফলে কৃষি নির্ভরশীল অন্যান্য ক্ষেত্র টিকে থাকতে পারছে না। এদিকে কৃষি জমির পরিমাণও কমে যাচ্ছে। আরো একটি বাস্তব সত্য হল, বিগত বছরগুলোতে দারিদ্রসীমার নিচে বাস করা মানুষেরা যে দামে খাদ্যশস্য কিনেছে, তার চেয়ে কম দামে সরকার খাদ্যশস্য রফতানি করেছে। মাত্র ক’বছর আগে এ দেশে যে দ্রব্যের দাম ১০ টাকা ছিল সে দ্রব্য বিদেশে রফতানি হয়েছে সাড়ে ৫ বা ৬ টাকায় এমন খবরও আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন সময়ে পত্র-পত্রিকার পাতায়। এদিকে বিভিন্ন ধরনের কর আরোপের ফলে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি অধিক মূল্যে ক্রয় করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। বিত্তহীন পরিবারের কাছে ‘শিক্ষা’ এখন বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। ফলে বেড়েছে স্কুলছুটের হার, নিরক্ষরের হার। কয়েক বছর ধরে সরকার মেয়েদের জন্য উপবৃত্তি চালু করেছে। স্কুলগুলোতে এমনিতে শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। ১/২ শিক্ষক চালিত স্কুলের সংখ্যা বিস্ময়ের উদ্রেক করে। এর মধ্যে জুটেছে উপবৃত্তির হিসেব। ফলে ‘শিক্ষা’ থেকে যাচ্ছে অধরা। স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে যত কম বলা যায় ততই ভাল। প্রসূতি শিশু মৃত্যুর হার দেখে দেশের স্বাস্থ্য সেবার বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় সবার কাছে। রইল আরও একটি দরকারি ব্যাপার। খাবার পানির কথা। গ্রামগঞ্জে খাবার পানির অভাবের খবর সারা বছর ধরেই সংবাদপত্রের পাতাজুড়ে থাকে। এখন শহরাঞ্চলে পানির তীব্র অভাব। প্রতিটি যুগের একটা নিজস্ব ধর্ম-আদর্শ ও চেতনা থাকে। সেটি আমরা যুগধর্ম যুগচেতনা বা যুগাদর্শ বলি। সমাজ-মানস যুগে যুগে বিবর্তিত হয়ে চলছে, কারণ মানুষের সমাজ স্থিতিশীল নয়, এটি চলিষ্ণু। আর এ চলার মধ্যে রয়েছে সমাজের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। বিভিন্ন সাহিত্যে এর প্রকাশ লক্ষণীয়। যুগে যুগে আচার-অনাচার, ভয় ও অজ্ঞতা আশ্রিত নানা বিচিত্র সংস্কার জমে উঠে ইতিহাসের পরতে পরতে। সেটি থেকে আমরা শিক্ষা নিতে চাই না। আর এখানেই আমাদের আসল সমস্যা। কোনো সমাজই এ সমস্যা থেকে মুক্ত নয়। বিজ্ঞান আমাদেরকে বৈজ্ঞানিক বানিয়ে দিয়েছে সত্যি, কিন্তু কোনো যুক্তিধর্মী চেতনার প্রকাশ ঘটায়নি। তাইতো অনেক ক্ষেত্রে অন্যের চাপানো যক্তিহীন নিয়মের মধ্যেই আমাদের চলতে হয়।
আজ সাম্রাজ্যবাদী ও স্বার্থান্বেষীদের যৌথ চক্রান্তে দেশের হাল অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতা, প্রশাসনিক দুর্নীতি, ভ্রষ্টাচার, আদর্শহীনতা, অর্থবল, বাহুবল ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সমাজকে গ্রাস করে ফেলেছে। হত্যা, লুটতরাজ, কেলেঙ্কারি, দুর্নীতি ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের পাপাচারের ফলে জনগণ ভীত ও শঙ্কিত। শিক্ষা দীক্ষা ও সংস্কৃতির প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে অসাম্য থাকায় জাতীয় জীবনে এক বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। মানবতা হারিয়ে যাচ্ছে সমাজ থেকে। যেখানে-সেখানে মারা যাচ্ছে মানুষ। অর্ন্তঘাতী হিংসায় মানুষ অন্যান্যও জীবকেও ছাড়িয়ে গেছে। সহানুভূতির আদর্শ চেতনা থেকে আমরা বিচ্যুত হয়ে পড়েছি। মহৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য আমরা এগিয়ে চলতে চাই না। কারণ সবসময়ই আমাদের মনে একটা অসৎ উদ্দেশ্য কাজ করে, তা সজ্ঞানে হোক আর নির্জ্ঞানে হোক। আর তখনই অন্তরে সৎ ও অসতের এক দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত পারিপার্শি¦কতার চাপে অসৎ উদ্দেশ্যটাই প্রকট হয়ে উঠে। দারিদ্র অনেক সময় সে অসৎ চরিত্র সৃষ্টিতে সহায়তা করে। সমস্তটাই যেন এক কালবাধ্যিরূপে সর্বগ্রাসী পরিবর্তনের মাধ্যমে এগিয়ে চলছে। আমরা ধ্বংসও হচ্ছি না, অথচ সুষ্ঠু ভাবে বেঁচে থাকতেও পারছিনা। আর এ ব্যাধি থেকে মুক্তির উপায় আদর্শের শিক্ষা। কিন্তু বর্তমান যুগে কে দেবে এ শিক্ষা? কারণ আমরা সবাইতো আদর্শহীন ও স্বার্থপর। স্বার্থের বশে অন্যের আঁকা পথে আমরা সবাই চলতে আগ্রহী, আবার অনেক সময় বাধ্যও হয়ে যাই বটে।
আমরা মুখে বারবারই উচ্চারণ করি-আমরা নিয়মের শাসন চাই, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চাই। কথাটা শুধু বলার জন্যই বলা। কারণ সমস্ত নিয়মই তো শাসনযন্ত্রের অধীন। শাসনযন্ত্র নিয়মের অধীন নয়। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সে কথাই বলে। নিয়ম সৃষ্টি হয়, কিন্তু এর পিছনে কোনো নির্দিষ্ট জীবন্ত যুক্তি থাকে না। সে সুযোগই চতুর নেতারা কাজে লাগান। এখানে তাদের মধ্যে কোনো আদর্শের সংঘাত নেই। শুধু রয়েছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক অথচ দলীয় সংঘাত, রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সংঘাত। এটাই যেন বর্তমানে রাজনীতির আদর্শ। কিন্তু সেটি কখনো মঙ্গলদায়ক হতে পারে না। এ থেকে মুক্তির একমাত্র পথ জাতীয় ঐক্যবোধের জাগরণ ও আদর্শের শিক্ষা ও জাতীয় আয়ের বিকেন্দ্রীকরণ।
এক কথায়, জাতীয় আয়ের বৃহত্তম অংশ অল্প কয়েকজনের হাতে ভীষণভাবে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। ধনী-দরিদ্রদের বৈষম্য মারাত্মক আকার নিচ্ছে। ফলে জাতীয় ও জেলা, বিভাগীয় স্তরে স্বাস্থ্য, আবাসন, শিক্ষা, নিকাশি ব্যবস্থা ইত্যাদি ক্ষেত্রে এক নৈরাশ্যময় অবস্থা-এতদিনের স্বাধীনতা দিবস পালনের এটাই নিটফল। আগামী ভোরের বাতাসে আরও একটি ‘স্বাধীনতা দিবস’ যুক্ত হবে। আশার কথা, স্বপ্নের কথা, আদর্শের-প্রেমের-সুস্থতার কথা আমাদের শোনানো হবে। গালভরা প্রতিশ্রুতি দেয়া হবে। কিন্তু বছর শেষে, আরও একটা এমন সময়ে আমরা দেখতে পাব, দারিদ্রের হার বেড়েছে, শিক্ষা, খাদ্য, স্বাস্থ্য, পানি, শৌচারগারহীন মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। বেকারত্ব, পরিবেশ দূষণ, শিশুমৃত্যু, নিরক্ষরতা, বনাঞ্চল উজাড়, আর্থিক বৈষম্য ইত্যাদি সবকিছু আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকবে। রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতদের কাছে অনুরোধ, প্রতিশ্রুতির জোয়ারে আর ভাসাবেন না। অনেক হয়েছে, এবার সত্যিসত্যি বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে কিছু কথা পারলে বলুন, যা আমাদের আশ্বস্ত করতে পারে। স্বপ্ন দেখাতে চাইবেন না প্লিজ,যে সমস্ত কাজ করতে পারবেন সে সব হাতে নিন আর বাস্তবে প্রয়োগ করে যোগ্যতা প্রমাণ করুন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
গণমাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচারের ওপর গুরুত্বারোপ করলেন উপদেষ্টা
বগুড়ার ধুনট পল্লীতে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে ব্যবসায়ীর ৩৫ হাজার টাকা ছিনতাই
দীর্ঘ ১৩ বছর পর দেশে ফিরছেন কায়কোবাদ
সিদ্দিরগঞ্জে নির্মাণাধীন ভবনের ছাদ থেকে পড়ে বিদ্যুতায়িত, দুই শ্রমিকের মৃত্যু
নাচোলে পিয়ারাবাগানে এক গৃহবধূ খুন
৫ জানুয়ারি থেকে ৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা শুরু
নোয়াখালীর সুবর্ণচরে মোটর থেকে বৈদ্যুতিক তার খুলতে প্রাণ গেল যুবকের
কারখানায় আগুন, পরিদর্শনে হাতেম
নির্বাচনের তারিখ নিয়ে যা জানালেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার
কবি জসীমউদ্দিনের মেজ ছেলে ড. জামাল আনোয়ার আর নেই
ভাঙ্গায় দুই গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষে নারী-পুরুষসহ আহত- ১০
আমাদের সংস্কৃতির অংশ হলো সব ধর্মের মাঝে সম্প্রীতি ও সহাবস্থান: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
রাতের আধারে অসহায় ব্যাক্তিদের বাড়ির দরজায় গিয়ে কম্বল দিলেন ইউএনও
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রশংসা করলেন রাহাত, জানালেন নিজ অনুভূতি
সাবেক দুদক কমিশনার জহরুল হকের পাসপোর্ট বাতিল, দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
শ্রীপুরে ভুয়া মেজর আটক
প্রশ্ন: কিসব কারণে বিয়ের বরকত নষ্ট হয়ে যায়?
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অনুপম দৃষ্টান্ত মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সা:)
আল-কুরআন তাজকেরায়ে মীলাদ নামায়ে আম্বিয়া (আ:)
ভারত উপমহাদেশে মুসলিম সভ্যতার জাগরণে আবুল হাসান আলী নদভির শিক্ষাচিন্তা