সহজ শর্তে কর নির্ধারণ হলে আয় বাড়বে
২১ জুন ২০২৩, ০৭:৫৫ পিএম | আপডেট: ২২ জুন ২০২৩, ১২:০১ এএম
আমাদের দেশের আয়কর আইন অনুযায়ী, একজন নাগরিকের কর্মজীবন শুরু হলে পুরুষের বাৎসরিক আয় ৩ লক্ষ ৫০ হাজার, মহিলা ও ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে ৪ লক্ষ টাকার বেশি হলে, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ৪ লক্ষ ৭৫ হাজার এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ৫ লক্ষ টাকার বেশি হলে ওই নাগরিক আয়করের আওতায় আসার নিয়ম আছে। আয়কর আইন শিথিলের পর প্রথম ১ লক্ষ টাকা আয় পর্যন্ত ৫ শতাংশ, পরবর্তী ৩ লক্ষ টাকায় ১০ শতাংশ, পরবর্তী ৪ লক্ষ টাকায় ১৫ শতাংশ, পরবর্তী ৫ লক্ষ টাকায় ২০ শতাংশ এবং এর পরে অবশিষ্ট আয়ের উপর ২৫ শতাংশ হারে আয়কর দেয়ার বিধান করা ছিল। এই নিয়মে শিথিলযোগ্য আয়ের পরে পরবর্তী ১ লক্ষ টাকার জন্য ৫% হারে ৫ হাজার টাকা, পরবর্তী ৩ লক্ষ টাকার জন্য ১০% হারে ৩০ হাজার টাকা, পরবর্তী ৪ লক্ষ টাকার জন্য ১৫% হারে ৬০ হাজার টাকা, পরবর্তী ৫ লক্ষ টাকার জন্য ২০% হারে ১ লক্ষ টাকা। এ হিসাবে কারোর বাৎসরিক আয় যদি ১৬ লক্ষ টাকা হয় তবে তাকে মোট আয়কর দিতে হবে ১ লক্ষ ৯৫ হাজার টাকা। এর উপরে যদি কারো আয় আর মাত্র ৪ লক্ষ টাকা, অর্থাৎ মোট বাৎসরিক আয় যদি ২০ লক্ষ টাকা হয় তবে তাকে আয়কর দিতে হবে ২ লক্ষ ৯৫ হাজার টাকা। করের নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি বছরে ৫০ লক্ষ টাকা আয় দেখালে তাকে কর দিতে হবে গড় প্রায় ২১ শতাংশ হারে ১০ লক্ষ ৪৫ হাজার টাকা। কোম্পানির ক্ষেত্রে এই হার অনেক বেশি। ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সিগারেট, বিড়ি জর্দ্দা গুলসহ সব ধরনের তামাকজাত কোম্পানি ও মোবাইল ফোন অপারেটর কো¤পানির ক্ষেত্রে অধিক হারে কর দেওয়ার নিয়ম থাকলেও বাস্তবে অনেকেই এই নিয়ম মেনে চলে না। এই অধিক হারে আয়কর দেওয়ার নিয়মের কারণেই আয়করদাতারা বিভিন্ন পথ অবলম্বন করে আয়কর একেবারেই কম দিচ্ছে এবং বৈধপথে উপার্জন হওয়া সত্ত্বেও অপ্রদর্শনের কারণে এ টাকা বৈধতা হারাচ্ছে। আর এ সুযোগেই কিছু মধ্যসত্ত্বভোগী-সুবিধাবাদী, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সুবিধা নিচ্ছে। তাছাড়া আবাসিক বাড়ি বা এপার্টমেন্ট ক্রয়ের ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক ঢাকার গুলশান, বনানী, মতিঝিল, দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকায় প্রতি বর্গমিটার হিসাবে ৬ হাজার টাকা, সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ২ শত বর্গমিটারের অধিক আয়তন বিশিষ্ট এপার্টমেন্টের ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে ১ হাজার ৩ শত টাকা এবং জেলা সদরের পৌর এলাকার ২ শত বর্গমিটারের অধিক আয়তন বিশিষ্ট এপার্টমেন্টের ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটারে ৬ শত টাকা নির্ধারণ করা আছে। সড়ক পথে যাত্রীবাহী বাস এবং পণ্য বহনকারী ট্রাকের ক্ষেত্রে ধারণ ক্ষমতা ও মডেল ভেদে বছরে ৭ হাজার ৫ শত টাকা থেকে সাড়ে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত নির্ধারণ করা আছে। তাছাড়া প্রাইভেট গাড়ির ক্ষেত্রে ১৫০০ সিসি কার ও জিপের জন্য ২৫ হাজার, ২০০০ সিসি পর্যন্ত ৫০ হাজার টাকা, ২০০০ থেকে ২৫০০ সিসি পর্যন্ত ৭৫ হাজার টাকা, ২৫০০ সিসি থেকে ৩০০০ সিসি পর্যন্ত ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা, ৩০০০ থেকে ৩৫০০ সিসি পর্যন্ত ২ লক্ষ টাকা, ৩৫০০ সিসি থেকে যত উপরেই হোক ৩ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা নির্ধারণ আছে।
সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, একজন নাগরিক তার কর্মজীবন শুরু হওয়ার পর, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের জন্য ৫ হাজার, অন্যান্য সিটি কর্পোরেশনের জন্য ৪ হাজার টাকা আয়কর দিয়ে নথিভুক্ত হতে পারে। এছাড়া অন্যান্য এলাকার জন্য ৩ হাজার টাকা আয়কর দিয়ে শুরু করলে সর্বোচ্চ ১৫ লক্ষ টাকা তার আয়কর নথিতে সাদা টাকা হিসাবে মূলধন দেখানোর নিয়ম আছে। এছাড়াও উক্ত নথিতে পৈত্রিক সম্পত্তি যোগ হতে পারে। এরপর তার কর্মজীবনের সমস্ত আয়ের ওপর নির্ধারিত কর পরিশোধের মাধ্যমে স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি ও মূলধন বাড়ার কথা থাকলেও করদাতার আয়কর নথির সঙ্গে বাস্তব অবস্থার তেমন মিল পাওয়া যায় না। তাছাড়া দেশে লক্ষ লক্ষ যানবাহন (বাস-ট্রাক, প্রাইভেটকার, জিপ, মাইক্রো) এবং একই ব্যক্তির একাধিক গাড়ি থাকা সত্ত্বেও অনেকের আয়কর নথিতে মূলধন হিসাবে কমমূল্যের দুই-একটি গাড়ি দেখানো আছে। গাড়ির প্রকৃত সংখ্যা বা মূল্য মূলধনে দেখানো হয় না। একজন নাগরিকের বাড়ি, গাড়ি, জায়গা, জমি, সম্পদের মূল্য ৫ কোটি টাকা হলেও তার আয়কর নথিতে হিসাব লেখানো আছে হয়ত ৩০ থেকে ৪০ লক্ষ টাকা, যা প্রকৃত হিসাবের ১৫ ভাগেরও কম। এতে করে সরকার করদাতার কাছ থেকে আয়কর হারাচ্ছে। অন্যদিকে অধিক কর নির্ধারণ করায় করদাতা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে সরকারকে কর দিতে অনীহা প্রকাশ করছে। অনেক বড় বড় ব্যবসায়ীর বৈধ পথে আয় করা অপ্রদর্শিত টাকা, অধিক হারে আয়কর নির্ধারণের কারণে সাদা টাকা হিসাবে বৈধতা না পাওয়ায়, দেশে বিনিয়োগ করার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে না। এ কারণে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। এছাড়াও অবৈধভাবে আয় করা কালো টাকাও অধিকহারে বিদেশে পাচার হচ্ছে।
আমাদের জানা মতে, একটি উপজেলা শহরে পৌর এলাকাধীন একতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত ব্যবসায়িক এবং আবাসিক ভবনের সংখ্যা কমপক্ষে ৩০০টি। একেকটি ভবনের মূল্য আনুমানিক জমিসহ ১ কোটি টাকার অনেক ঊর্ধ্বে। উল্লেখিত ভবনের মূল্য আয়কর নথিতে মূলধন হিসাবে মাত্র ১ কোটি টাকা দেখালে শতকরা ৩ শতাংশ হারে আয়কর ধরা হলেও তাকে ওই ভবনটির জন্য ৩ লক্ষ টাকা আয়কর দিতে হবে। শুধু উপজেলা শহরেও ৩০০ ভবনের মধ্যে ১০০ ভবনও আয়কর দাতার নথিতে দেখানো নাই। উপজেলা শহর, জেলা শহর, বিভাগীয় শহর, রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোয় লক্ষ লক্ষ বাণিজ্যিক ও আবাসিক বাড়ির মূল্যকে মূলধন হিসাবে সর্বনিম্ন হারেও আয়কর নির্ধারণ করে আদায়ের সুযোগ সৃষ্টি করলে সরকারের আয় হবে হাজার হাজার গুণ বেশি অর্থাৎ লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা। দেশের উপার্জনক্ষম (কর্মজীবনে) ব্যক্তির জন্য আয়কর নথি একটি আয়না স্বরূপ। প্রত্যেকের আয়কর নথি বিশ্লেষণ করলে, ওই ব্যক্তির অর্থনৈতিক, সামাজিক মর্যাদা আয়না স্বরূপ বোঝার দরকার ছিল। বর্তমানে অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসা শুরু হওয়ায় সাধারণ ও মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ীদের লাভের হার অত্যন্ত কম। তাছাড়া অনেকের বাৎসরিক আয় থেকে খরচও অনেক বেশি। করদাতার কাছে করের হার অত্যন্ত বেশি হওয়ার কারণে সে কর দিতে আগ্রহ হারাচ্ছে। এছাড়াও ব্যবসায়ীদের উৎপাদন ও বিক্রয়ের উপরে অধিক হারে ভ্যাট নির্ধারণ করায় ব্যবসায়ীরা দিশেহারা হয়ে পড়ছে। অনেক করদাতার সঙ্গে আলাপে জানা যায়, সরকার সর্বনি¤œ হারে কর দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করলে, তারা বৈধপথে অপ্রদর্শিত আয়ের আয়কর দিয়ে সমস্ত স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি, নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার প্রদর্শন করে দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত হতে চায়। সরকার স্বল্প হারে কর নির্ধারণ করলে আয় প্রদর্শনের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং সরকারের রাজস্ব আয় অনেক বেড়ে যাবে। অন্যদিকে বৈধ পথে অপ্রদর্শিত আয় প্রদর্শন করার সুযোগ পেলে দেশে বিনিয়োগের অনেক সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং বিদেশে অর্থ পাচার অনেকাংশে বন্ধ হবে। তাছাড়া করদাতা স্ব-ইচ্ছায় কর দিলে পরামর্শদাতা, মধ্যসত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমবে। এতে করদাতাদের ভোগান্তি বন্ধ হবে এবং সবাই স্ব-ইচ্ছায় কর দিতে উৎসাহিত হবে।
দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য রাজস্ব আয়ের বিকল্প নাই। কাজেই বর্তমান হার থেকে করের হার শিথিল করে সাধারণ ব্যবসায়ীদের নিকট হতে সর্বনিম্নহারে অর্থাৎ মাত্র ৩% থেকে ৪% হারে কর নির্ধারণ করলে বৈধ পথে উপার্জিত অপ্রদর্শিত সম্পদ, টাকা-পয়সা ধারাবাহিক প্রমাণ সাপেক্ষে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রদর্শন করার সুযোগ দিলে সরকারের আয় যেমনি বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে, তেমনি অপ্রদির্শত আয় প্রদর্শনে বৈধতা পাবে এবং সরকারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে। এতে করে করদাতা প্রতি বছরই স্ব-ইচ্ছায় তার সঠিক আয় প্রদর্শন করে কর দেয়ার জন্য উৎসাহিত হবে। এছাড়াও সহজ শর্তে সর্বনিম্ন হারে কর কমিয়ে আনলে নতুন করদাতার সংখ্যাও অনেক বেড়ে যাবে। ফলে সরকারের রাজস্ব আয়ও বেড়ে যাবে। তাছাড়া অস্বাস্থ্যকর নেশা জাতীয় দ্রব্য ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার জন্য ১০০ শতাংশ কর নির্ধারণ করা যেতে পারে। তবে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, অবৈধ পথে আয়, ধারাবাহিকতা না থাকা, আয়ের উৎস না থাকা, অধিক হারে অপ্রত্যাশিত আয় দেখানো বা ইতিপূর্বে আয়কর নথি না থাকা, এদের এ সুযোগের আওতায় আনা যাবে না। দুর্নীতিবাজরা এ সুযোগের আওতায় আসলে অতি উৎসাহিত হয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ নিতে পারে। প্রায় প্রতি অর্থবছরেই অধিক কর নির্ধারণ করে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়ে থাকে। কিছু সংখ্যক লোক ছাড়া সাধারণ জনগণ এ সুযোগ নিতে পারে না। সহজ ও সর্বনিম্ন কর নির্ধারণের বিষয়টি অভিজ্ঞজনের বিচার বিশ্লেষণে এনে, জটিলতা এড়িয়ে স্বচ্ছ আইনের মাধ্যমে কর নির্ধারণের সুযোগ সৃষ্টি হলে, দেশের সচেতন নাগরিক নিজ ইচ্ছায় প্রতি বছর তার সঠিক আয় প্রদর্শন করে কর দিতে উৎসাহিত হবে। ফলে দেশের নাগরিকদের মাথাপিছু আয় বাড়ার সাথে সাথে দেশের প্রবৃদ্ধিও অনেক হারে বৃদ্ধি পাবে। অধিক হারে সরকারের উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টি হলে, উন্নত বিশ্বের ন্যায় দ্রুত দেশের উন্নয়ন তরান্বিত হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিষ্ট
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
নিবন্ধন চূড়ান্ত: হজযাত্রী ৮৩ হাজার ২৪২ জন
হল্যান্ডের পেনাল্টি মিস,বিবর্ণ সিটি ফের হারাল পয়েন্ট
শরীফ থেকে শরীফার গল্প বাতিল করতে হবে: ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ
বিসিএ নির্বাচন সম্পন্ন: মিজান সভাপতি, মতিন সম্পাদক
ডেঙ্গুতে আরও ৪ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১৫৩
বিএনপি মুক্ত সাংবাদিকতায় বিশ্বাসী: শাহজাহান চৌধুরী
সচিবালয়ে আগুন: গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতাকে দায়ী করলো এবি পার্টি
পরকীয়া প্রেমের ঘটনায় গৌরনদীতে উপ-সহকারী ২ কৃষি কর্মকর্তা এলাকাবাসীর হাতে আটক
‘প্রতিবন্ধীদের সংগঠন ও সম্পদ দখল করে পতিত সরকারের শিল্পমন্ত্রীর কন্যা’
আশিয়ান সিটির স্টলে বুকিং দিলেই মিলছে ল্যাপটপ
সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি পরিকল্পিত নাশকতা: ইসলামী আইনজীবী পরিষদ
গাজীপুরে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাকে ছাড়িয়ে আনতে থানায় বিএনপি নেতাদের ভিড়
মাদ্রাসার ছাদ থেকে পাইপ বেয়ে নামার সময় পড়ে গিয়ে শিশুর মৃত্যু
জকিগঞ্জে প্রাক্সিসের ৭ দিনব্যাপী ইংলিশ স্পিকিং চ্যালেঞ্জ কম্পিটিশনের পুরস্কার বিতরণী
লামায় ১৭টি ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বসতঘর পুড়ে ছাই হওয়ার ঘটনায় ৪জন গ্রেপ্তার
বিজয় দিবস টেনিস শুক্রবার শুরু
আশুলিয়ায় ভাড়াটিয়া তাড়িয়ে জোরপূর্বক জমি দখলের অভিযোগ
আজানের জবাব দেওয়া প্রসঙ্গে।
লক্ষ্মীপুরে চুরির অপবাদে নাকে খত দেওয়ার ঘটনায় মামলা
শরীয়তপুরে শ্রমিক দলের বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ