উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিত করতে হবে

Daily Inqilab ইনকিলাব

০৯ জুলাই ২০২৩, ০৮:২৩ পিএম | আপডেট: ১০ জুলাই ২০২৩, ১২:০১ এএম

সরকারি-বেসরকারি মিলে দেশে এখন যতটা বিশ্ববিদ্যালয় আছে, তা কি প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে জানা প্রয়োজন, দেশে প্রকৃতপক্ষে কতটা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদা বা প্রয়োজন আছে। যতদূর জানা, বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদা কখনই যাচাই হয়নি এবং হওয়ার কোনো উদ্যোগও নেয়া হয়নি। ১৯৯২ সালের কথা, তখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল মাত্র ১১টি। কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। তখন উচ্চ শিক্ষা প্রত্যাশীদের ভর্তির জন্য ওই ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত সংখ্যক আসন ছিল না। এই প্রেক্ষাপটে সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন অনুভব করে এবং অনুমোদন প্রদান করে। উচ্চশিক্ষাদানের একটা নতুন পথ খুলে যায়। এটা ছিল সরকারের একটা যুগান্তকারি সিদ্ধান্ত। সেই থেকে এপর্যন্ত দেশে ১১৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও ৫৬টিতে উন্নীত হয়েছে। এত বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পরও দেখা গেছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসনের অভাব বা সংকট রয়েছে। ওদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কয়েকটি বাদে অধিকাংশই শিক্ষার্থী সংকটে ধুঁকছে। আবার প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে শিক্ষার জন্য। বিদ্যমান এই বাস্তবতার মধ্যেও নতুন করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষকদের মতে, দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়লেও শিক্ষার মান বাড়েনি। ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর চাপ থাকলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংকট দেখা যাচ্ছে। শিক্ষার সুযোগ কম ও মান যথাযথ না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের একাংশ বিদেশে যেতে বাধ্য হচ্ছে। তাহলে এত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিয়ে লাভ কী হলো?

রাজধানী থেকে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের হাটবাজার বসে গেছে। রাজধানীতে পাবলিক ও বেসরকারি মিলে ৬৮টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ধানমন্ডী, বনানী, মিরপুর, উত্তরা, বসুন্ধরা প্রভৃতি এলাকায় রাস্তার এ মাথায় ও মাথায় বিভিন্ন নামের বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। ওদিকে জেলা শহরগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতা চলছে। নজির হিসাবে কুষ্টিয়ার কথা উল্লেখ করা যায়। কুষ্টিয়া একটি ছোট্ট শহর। এখানে অনেক আগেই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আছে। জানা গেছে, ইতোমধ্যে লালন ও রবীন্দ্রনাথের নাম যুক্ত করে দুটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যাদের অনুমোদন হয়ে গেছে। প্রশ্ন ওঠে, নাম সর্বস্ব বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে কী হবে, যদি শিক্ষার মান না থাকে? হাতে গোনা দু’চারটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান, পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনা ভালো। অধিকাংশেরই এসবের বালাই নেই। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড ছাড়া নিজস্ব কিছু নেই। জমি নেই, বিল্ডিং নেই, স্থায়ী শিক্ষক নেই, প্রয়োজনীয় ক্লাসরুম নেই, লাইব্রেরি নেই, ল্যাবরেটরি নেই, নেই গবেষণার কোনো ব্যবস্থা ও সুযোগ। এ ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় কার্যত সার্টিফিকেট ব্যবসার জন্য করা হয়েছে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার, শিক্ষা এখন বড় ধরনের লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। ব্যাংকের মতই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এ সময় সবচেয়ে বেশি মুনাফাদায়ী। বিভিন্ন ধরনের ব্যাংকের যেমন শেষ নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের তেমনি শেষ নেই। শুরুতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা ছিলেন শিক্ষাবিদ ও শিক্ষানুরাগীরা। এখন এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের দখল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সরকারি দলের সঙ্গে রাজনৈতিক সংযোগ আছে, এমন ব্যবসায়ী বা ব্যক্তিরাই ব্যাংক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন লাভ করছেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও বলতে হচ্ছে, ব্যাংক লুটপাটের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চবেতনখোর ও সার্টিফিকেট বেচার দোকানে পরিণত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে মুনাফাশিকারি প্রতিষ্ঠানের আদৌ প্রয়োজন আছে বলে হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বিভিন্ন সময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। শিক্ষাবিদরা তুলেছেন। তাতে তেমন কোনো ফলোদয় হয়নি। যেসব শর্তপূরণ সাপেক্ষে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা, তার অধিকাংশ পূরণ না করেই বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চলছে। ইউজিসির হুমকি-ধমকি, সময় বেঁধে দেয়া কোনো কাজে আসছে না। ইউজিসি চরম কোনো সিদ্ধান্তও নিতে পারছে না অক্ষমতার কারণে। রাজনৈতিক কানেকশনে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা কি ইউজিসির আছে?

অত্যন্ত বেদনাদায়ক দেশের সরকারি-বেসরকারি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষার মান আন্তর্জাতিক মানের সমান নয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের করা র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম খুঁজে পাওয়া যায় না। দু’য়েকটির নাম পাওয়া গেলেও একেবারে নিচের দিকে। কিউএস বিষয়ভিত্তিক র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের মাত্র দুটি এবং এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিংয়ে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রয়েছে। শিক্ষার মান কোন পর্যায়ে, এথেকেই তা উপলব্ধি করা যায়। শিক্ষার অবনতমান ও সার্টিফিকেট সর্বস্বতার কারণে মেধায় বিকাশ যেমন ব্যহত হচ্ছে, তেমনি দক্ষ জনশক্তি তৈরির আকাক্সক্ষাও অপূর্ণ থেকে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা যেভাবেই হোক, সার্টিফিকেট লাভ করছে বটে, কিন্তু তা তাদের কর্মজীবনে কোনো কাজে আসছে না। বিশেষ তয়-তদবিরে কোথাও কাজ পেলেও দক্ষতার প্রমাণ দিতে পারছে না। অধিকাংশেরই বেকারত্বের অভিশাপ বহন করতে হচ্ছে। বেকার বানানোর এ শিক্ষার কী দরকার? দেশে-বিদেশে দক্ষ কর্মীর কদর বেশি। অথচ আমাদের দেশে দক্ষ কর্মী তৈরি করার শিক্ষার বড় অভাব। এ কারণে বেকারের ভারে ন্যুব্জ এদেশেকেই বিদেশ থেকে দক্ষ কর্মী আনতে হচ্ছে। ঢাকা চেম্বার অব কর্মাস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) তরফে সম্প্রতি জানানো হয়েছে, শিল্প খাতে অনেক বিদেশি কাজ করছে। তারা প্রতিবছর ৮ থেকে ১০ বিলিয়ন ডলার নিয়ে যাচ্ছে। দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার শিক্ষার ঘাটতিই যে এর কারণ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জীবনের কর্মক্ষেত্রে সুনিপুণ ও দক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা অর্জন করাই শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্যে হওয়া উচিত। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় তার শোচনীয় অভাব রয়েছে। শিক্ষাকে মূল্যবোধসম্পন্ন ও কর্মমুখী করার বিকল্প নেই। সার্টিফিকেটসর্বস্ব ও অবনতমানের শিক্ষার আমাদের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই এধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও। মানসম্পন্ন শিক্ষা ও মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আমাদের চাই এবং তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিক্ষকদের প্রস্তুতি নিতে হবে
প্রশাসন সংস্কারে কঠোর হতে হবে
অসভ্য নগরীতে পরিণত ঢাকা
শীতে পশু-পাখিদের যত্ন
মানব পাচার রোধ করতে হবে
আরও

আরও পড়ুন

শাক-সবজি উৎপদান করে এলাকায় সাড়া ফেলেছে

শাক-সবজি উৎপদান করে এলাকায় সাড়া ফেলেছে

জিরানী-আমতলা সড়কে পরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় ভোগান্তি লাখো মানুষের

জিরানী-আমতলা সড়কে পরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় ভোগান্তি লাখো মানুষের

বিরলে অতিরিক্তি সচিব ড. নুরুন নাহারের কৃষি প্রকল্প পরিদর্শন

বিরলে অতিরিক্তি সচিব ড. নুরুন নাহারের কৃষি প্রকল্প পরিদর্শন

মহেশপুর ভারতের কবল থাকা কোদলা নদীর ৫ কিলোমিটার উদ্ধার করলো বিবিজি

মহেশপুর ভারতের কবল থাকা কোদলা নদীর ৫ কিলোমিটার উদ্ধার করলো বিবিজি

বিআরডিবিকে অধিদফতরে রূপান্তর করা হবে :  আসিফ মাহমুদ

বিআরডিবিকে অধিদফতরে রূপান্তর করা হবে : আসিফ মাহমুদ

মুসলিম দেশগুলোকে খণ্ড-বিখণ্ড করার ঘৃণ্য পরিকল্পনা ইসরাইলের

মুসলিম দেশগুলোকে খণ্ড-বিখণ্ড করার ঘৃণ্য পরিকল্পনা ইসরাইলের

যখনই নির্বাচন হোক বিএনপিই ক্ষমতায় আসবে ইনশাআল্লাহ

যখনই নির্বাচন হোক বিএনপিই ক্ষমতায় আসবে ইনশাআল্লাহ

কুমিল্লায় তিন ফসলি কৃষিজমি রক্ষায় মতবিনিময় সভা

কুমিল্লায় তিন ফসলি কৃষিজমি রক্ষায় মতবিনিময় সভা

স্নাতকধারীদের জন্য বিনামূল্যে আইটি প্রশিক্ষণ দেবে আইএসডিবি-আইএসইডব্লিউ, থাকছে কর্মসংস্থানের সুযোগ

স্নাতকধারীদের জন্য বিনামূল্যে আইটি প্রশিক্ষণ দেবে আইএসডিবি-আইএসইডব্লিউ, থাকছে কর্মসংস্থানের সুযোগ

নরসিংদীতে তাঁত বোর্ড চেয়ারম্যানসহ ১৪ কর্মকর্তা অবরুদ্ধ

নরসিংদীতে তাঁত বোর্ড চেয়ারম্যানসহ ১৪ কর্মকর্তা অবরুদ্ধ

বিএনপি মহাসচিবের সাথে ইলিয়াস কাঞ্চনের সাক্ষাৎ

বিএনপি মহাসচিবের সাথে ইলিয়াস কাঞ্চনের সাক্ষাৎ

অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে মতামত দিতে বেলা ও দুই আইনজীবীর নাম ঘোষণা

অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে মতামত দিতে বেলা ও দুই আইনজীবীর নাম ঘোষণা

বিক্ষোভের মুখে মোংলায় বিএনপির কমিটি গঠন স্থগিত

বিক্ষোভের মুখে মোংলায় বিএনপির কমিটি গঠন স্থগিত

নোয়াখালীতে অবৈধ বালু মহাল বন্ধের দাবিতে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ

নোয়াখালীতে অবৈধ বালু মহাল বন্ধের দাবিতে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ

নোবিপ্রবিতে ‘বাংলাদেশে বয়স্কদের স্বাস্থ্য ও পরিচর্যা’ বিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠিত

নোবিপ্রবিতে ‘বাংলাদেশে বয়স্কদের স্বাস্থ্য ও পরিচর্যা’ বিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠিত

জুনে নির্বাচন দিয়ে দেশের মানুষকে ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দিন : দুলু

জুনে নির্বাচন দিয়ে দেশের মানুষকে ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দিন : দুলু

তালেবানের পাশে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের সমালোচনা করল ভারত

তালেবানের পাশে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের সমালোচনা করল ভারত

মাগুরায় শহীদ রাব্বির কন্যা শিশুর দায়িত্ব নিলেন তারেক রহমান

মাগুরায় শহীদ রাব্বির কন্যা শিশুর দায়িত্ব নিলেন তারেক রহমান

মৌলভীবাজার জেলা বিএনপি নেতা গাজী মারুফ আর নেই

মৌলভীবাজার জেলা বিএনপি নেতা গাজী মারুফ আর নেই

আরও কয়েকজন বিচারপতির বিরুদ্ধে তদন্তের অনুমতি দিলেন প্রেসিডেন্ট

আরও কয়েকজন বিচারপতির বিরুদ্ধে তদন্তের অনুমতি দিলেন প্রেসিডেন্ট