অসভ্য নগরীতে পরিণত ঢাকা
০৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:২২ এএম | আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:২২ এএম
রাজধানী ঢাকা মানুষের বসবাসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়েগেছে অনেক আগেই। এখন ক্রমাবনতিকাল চলছে। পর্যবেক্ষকদের আশঙ্কা, এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে এমন একটা সময় আসবে, যখন মানুষ আত্মরক্ষার্থে স্বেচ্ছায় এ শহর ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পরিবেশ দূষণসহ এমন কোনো দূষণ নেই, যা সর্বোচ্চ মাত্রায় উপনীত হয়নি। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে ঢাকা; এখনো তার সম্প্রসারণ চলছে যথেচ্ছভাবে। স্বাধীনতার সময় এখানে ছিল কয়েক লাখ লোকের বসবাস। ৫৪ বছরে লোকসংখ্যা বেড়ে হয়েছে প্রায় আড়াই কোটি। লোক যে হারে বেড়েছে সেই হারে সেবাসুবিধা অর্থাৎ গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, রাস্তাঘাট, পরিবহন ইত্যাদি বাড়েনি। ঢাকা দেশের মানুষের কাছে স্বপ্নের শহর। সরকারের মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন দফতর, কেন্দ্রীয় পর্যায়ের বেসরকারি অফিস, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদির কেন্দ্রভূমি হওয়ায় মানুষ বিভিন্ন প্রয়োজনে এ শহরে ছুটে আসে। এমন একটা ধারণাও মানুষের মধ্যে জন্ম হয়েছে যে, ঢাকায় এলেই কাজ পাওয়া যাবে, কিছু না কিছু করে আয়-রোজগার করা যাবে, বেঁচে থাকা যাবে। ফলে গৃহহারা, অসহায়, কর্মপ্রত্যাশী মানুষ দলে দলে এই শহর চলে আসে। আসা কমেনি বরং বেড়েছে। প্রথমে বস্তিতে ও রাস্তাঘাটে আশ্রয়। পরে কোনো না কোনো কাজে যেমন, কুলিগিরি, ঠেলাচালক, রিকশাচালক, বেবিচালক, হকারি, ফুটপাতে কিছু না কিছুর ব্যবসাপাতিতে লেগে পড়া। ব্যাস, হয়ে গেলো! ঢাকা শহরে এখন লোকে লোকারণ্য। পা ফেলার জায়গা পাওয়া যায় না। গণপরিবহনে ওঠা যায় না। ফুটপাত দিয়ে হাঁটা যায় না। এ শহরে যত লোক বাস করে তার ৪০ শতাংশ বস্তিতে বাস করে। বলা হয়, এটা অচিরেই বস্তির শহরে পরিণত হবে। মানুষ বাড়লে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ইত্যাদির চাহিদা বাড়ে। অন্যান্য সব কিছুর চাহিদাও বাড়ে। বিদ্যুতে ঘাটতি আছে। ফলে লোডশেডিং করতে হয়। গ্যাসেরও ঘাটতি আছে। অনেক সময় চুলা জ্বলে না। ঢাকা ওয়াসা প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ করতে পারে না। এসব সেবার ক্ষেত্রে মানুষের দুর্ভোগ-বিড়ম্বনার শেষ নেই। প্রকৃত গ্রাহকরা বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। মারাত্মক দূষণের পাশাপাশি এ শহর ময়লা-আবর্জনারও শহর। গৃহবর্জ্য তো বটেই, এমন কি, ড্রেনের ময়লা আবর্জনাও রাস্তার পাশে রাখা হয়। জনস্বাস্থ্যের জন্য উন্মুক্ত ময়লা-আবর্জনা অত্যন্ত ক্ষতিকর। মশার উপদ্রব প্রচ-। ডোবা-নালা, উন্মুক্ত নর্দমা মশার প্রজননক্ষেত্র। সার্বিক অপপরিবেশের কারণে এখানে বিভিন্ন রোগ ব্যাধিও বেশি।
যানজট ঢাকার একটি বড় সমস্যা। যানজটের কারণে ১০ মিনিটের রাস্তা যেতে অনেক সময় দু’ ঘণ্টাও লেগে যায়। যানজটে আর্থিক ও অন্যান্য ক্ষতির যে বিবরণ বিভিন্ন গবেষণা ও সমীক্ষায় উঠে এসেছে, তা লোমহর্ষক। রাজধানী শহর ২৪ ঘণ্টা সচল ও সক্রিয় থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে ঢাকা ব্যতিক্রম। প্রতিদিন এ শহর ঘণ্টার পর ঘণ্টা অচল হয়ে থাকে। যানজট নিরসনে অনেক কিছু করা হয়েছে; ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল ইত্যাদি। কিন্তু যানজট না কমে বরং বেড়েছে এবং বাড়ছে। এখানে যে পরিমাণ রাস্তাঘাট ও তদনুযায়ী পরিবহন থাকার কথা, তা নেই। ফলে কংক্রিটের স্তূপ বেড়েছে, যানজটের নিরসন হয়নি। রাস্তাঘাট যা আছে, তার অবস্থাও ভালো নয়। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির উৎসব চলে সারা বছর। এই সঙ্গে খানাখন্দে ভরা অধিকাংশ রাস্তা। কাটাকুটি করা ও খানাখন্দে ভরা অপ্রশস্ত রাস্তা দিয়ে চলাচল করা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, সহজেই অনুমেয়। মাঝে মধ্যেই দুর্ঘটনা ও হতাহতের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। বর্ষা ও বৃষ্টিপাতের সময় ঢাকা শহর সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নয়, দিনের পর দিন রাস্তাঘাটে পানি জমে থাকে। এই পানিজটের প্রধান কারণ অপর্যাপ্ত ও অপ্রশান্ত ড্রেন, অপরিকল্পিত ড্রেনেজ সিস্টেম এবং পানি নিকাশে প্রাকৃতিক উৎসসমূহ ধ্বংস হয়ে যাওয়া। এক সময় এই শহরে প্রচুর খাল-নালা ছিল। এগুলো ছিল সবসময় ¯্রােতময়। এদের সঙ্গে সংযোগ ছিল ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর। ফলে বর্ষা-বাদলের পানি সঙ্গে সঙ্গে নিকাশ হয়ে যেতো। ড্রেনের ময়লাও একইভাবে নিকাশ হয়ে যেতো। এখন খাল-নালা খুব কমই অবশিষ্ট আছে; দখল হয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গাসহ আশপাশের নদী দখল-দূষণে মৃতপ্রায়; বর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। খাল-নালা উদ্ধার, নদীদূষণ রোধ, অবৈধ দখল থেকে তা মুক্ত করার অনেক ঘোষণা ও উদ্যোগ অতীতে লক্ষ করা গেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি কাড়িকাড়ি অর্থের অপচয় ছাড়া। পতিত স্বৈরাচারের আমলে দুই সিটির দুই মেয়র বায়ুুদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণ থেকে শুরু করে খাল উদ্ধার, বুড়িগঙ্গাসহ অন্যান্য নদীর দূষণ রোধে, পানিজট ও যানজট নিরসনে লম্বা লম্বা অনেক কথা বলেছেন। কিন্তু কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পাঁচ মাস পূর্ণ হতে যাচ্ছে। এই সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন যিনি তিনি পরিবেশ বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত। তিনিও কথায় মাত করছেন। এখনো কাজ কিছু দেখাতে পারেননি। ঢাকার ২১টি খাল উদ্ধার এখনো কর্মপরিকল্পনার মধ্যে আবদ্ধ। নদীগুলো দূষণমুক্ত করাও একই পর্যায়ে। পলিথিনের বিরুদ্ধে অভিযান ব্যর্থ হয়েছে। এখন নাকি নতুন উদ্যোগ চলছে। ঢাকার শব্দদূষণ কমাতে বিধিমালা চূড়ান্ত হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন । বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে বায়ুদূষণ ব্যবস্থাপনা কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। দেখা যাচ্ছে, পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত আছেন উপদেষ্টা। কাজ এখনো দূর অস্ত। পরিবেশ উপদেষ্টা ঢাকাবাসীকে হাইড্রোলিক হর্ন থেকে বাঁচানোর ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু ঢাকাসহ দেশের সর্বত্র বায়ু দূষণকারী লক্কড়, ফিটনেসহীন যানবাহন বন্ধ হবে কবে? এ ব্যাপারে আরো পাঁচ মাস সময় নেয়া হয়েছে বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে।
বাসযোগ্য ও পরিবেশসম্মত ঢাকা গড়ার কাজটি মোটেই খুব সহজ নয়। গত ৫৪ বছর ধরে ঢাকাকে তিলোত্তমা নগরী রূপে গড়ে তোলার কথা অনেকেই বলেছেন। বাস্তবে সেই তিলোত্তমা নগরীর দেখা পাওয়া যায়নি। উল্টো এ নগরী বসবাসের প্রায় অযোগ্য হয়ে গেছে। এই নাজুক অবস্থা থেকে ঢাকাকে উদ্ধার করতে হলে একটি সমন্বিত মহাপরিকল্পনার বিকল্প নেই। অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক সরকার নয়। রাজনৈতিক সরকারের অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে। দলীয় স্বার্থ থাকে। ফলে যা করা দরকার তা অনেক সময় করতে পারে না। অন্তর্বর্তী সরকারের সেই অর্থে কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। দলীয় স্বার্থ নেই। তার আছে জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা এবং এই দায়বদ্ধতা প্রতিপালনে বিস্তর স্বাধীনতা। সুতরাং, এই সরকারকে ঢাকাকে বাসযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব শহর হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া যতটা সম্ভব এগিয়ে নিতে হবে। এই শহরে জনাগম কমাতে হবে। তার জনভার বহনের ক্ষমতা নেই। ডিসেন্ট্রালাইজেশানে জোর দিতে হবে। গ্রামে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে, যাতে শহরের মানুষকে গ্রামে পাঠানো সম্ভব হয়। কর্মসংস্থান এবং মানবাধিকারের কথা বলে তাদের শহরে ধরে রাখার কোনো মানে নেই। ঢাকাকে কাম্য লোকসংখ্যায় স্থিতিশীল করা গেলে সর্ব প্রকার দূষণের মাত্রা কমবে। চাহিদা অনুসারে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ইত্যাদির সংস্থান সম্ভব হবে। খাল-নদী উদ্ধার ও দখল-দূষণ বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। দখলবাজ সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দিতে হবে। ড্রেনেজ সিস্টেমের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত ও লাগসই করতে হবে। পরিবেশে এসবের ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং পানি জটের উপশম হবে। যানজট কমাতে সড়ক ব্যবস্থপনা ও পরিবহন ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে। বাস টার্মিনালগুলো আরো দূরে সরিয়ে দিতে হবে। রিকশা, থ্রিহুইলার ও ছোট যান চলাচল কমাতে হবে। পুরানো ও ফিটনেসহীন যানবাহন উঠিয়ে দিতে হবে। অধিক সংখ্যক যাত্রীধারণক্ষম গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়াতে হবে। বলা বাহল্য, এসব ব্যবস্থা নিলে ঢাকার বাসযোগ্যতার উন্নয়ন হবে। মানুষ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে, নিরাপদ হবে। তাদের অনেক সমস্যার সুরাহা হবে।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
মোরেলগঞ্জে কৃষি অফিসে দুদকের অভিযান
কাজী জাহিদ ইকবাল খিলখিলের ইন্তেকাল
পূর্ব সুন্দরবনের শেলারচরে শীতে মৃত্যু এক শুঁটকি পল্লীর জেলে
লক্ষ্মীপুরে ফার্মেসীতে অভিযান, ২০ হাজার টাকা জরিমানা
লক্ষ্মীপুরে ফার্মেসীতে অভিযান, ২০ হাজার টাকা জরিমানা
ভূমিকম্পে লন্ডভন্ড তিব্বতে নিহত বেড়ে প্রায় ১০০
রাবি ছাত্রশিবিরের নতুন সভাপতি মোস্তাকুর, সেক্রেটারি মুজাহিদ ফয়সাল
ঢাকাকে চতুর্থ হারের স্বাদ দিয়ে রংপুরের পাঁচে পাঁচ
ইন্দোনেশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিকস জোটে যোগ দিল
সান্তাহারে মালিকানা দাবি করে ২কোটি টাকার সরকারী জায়গা দখল
কুয়াকাটায় শুরু হচ্ছে মাসব্যাপী পর্যটন মেলা
লক্ষ্মীপুরে ৩ দিনে ৮ ইটভাটায় অভিযান, জরিমানা ১২ লাখ ৮০ হাজার
আর্থিক ভীতি কাটলেও পাঁচ মাসের অর্জনে খুশি নয় বাংলাদেশ ব্যাংক: ইডি শিখা
ছাত্র হত্যা মামলার আসামী হয়েও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ান শিমুলিয়ার 'বাবুল মাস্টার'!
সাবেক মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের ছোট ভাই মৃদুল কারাগারে
সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরিফ আহমেদের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ
কুয়েটকে সেশনজট মুক্ত আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা হবে -কুয়েট ভিসি
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে স্থান পাচ্ছে জুলাই বিপ্লবের ইতিহাস
সচিবালয় গেটে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, পুলিশের ফাঁকা গুলি
দোয়ারাবাজার উপজেলা প্রেসক্লাবের আহ্বায়ক কমিটি গঠন