পানির সংকট বাড়ছে

Daily Inqilab আফতাব চৌধূরী

২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৬ এএম

পৃথিবীতে এমন দেশ আছে, যেখানে প্রতিদিন পানির জন্য অগনিত মানুষকে লড়তে হচ্ছে। এমন দেশও রয়েছে, যেখানে তেলের চেয়ে পানির মূল্য বেশি। বর্তমানে বিভিন্ন কারণে পানীয় পানির সংকট ক্রমাগত বাড়ছে এবং শস্যের উৎপাদন কমে আসছে। হয়তো আর কয়েক বছর পর মানুষের পানি সম্পদের জন্যে নিজেদের ওপর ধিক্কার জন্মাবে। গাছপালার মতো মানুষও শুকিয়ে মারা যাবে। বিভিন্ন কলকারখানা থেকে নির্গত দূষিত বর্জ্য পদার্থগুলো মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীরও ক্ষতি করছে। গাছপালারও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। কীটনাশক, রাসায়নিক সার নদী, খাল, বিল, পুকুর ইত্যাদিতে গিয়ে মিশেছে। এর ফলে মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে।

প্রকৃতি ও পরিবেশের কথা চিন্তা না করে আমরা যেভাবে ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠেছি, গাছ-গাছড়া কেটে, মাটি কেটে নগর তৈরি করছি, জলাশয় মাটি দিয়ে ভরাট করে অট্টলিকা নির্মাণ করছি, ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে কলকারখানা তৈরি করছি, তাতে ভবিষ্যতে আমাদের হাহাকার করতে হবে পানির জন্য। এমন দিন আর বেশি দূরে নয়, যখন কৃষককে চাতক পাখির মতো আকাশের দিকে চেয়ে থাকতে হবে বৃষ্টির জন্য। বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিকে অবজ্ঞা করে আমরা এগিয়ে চলেছি আধুনিক নাগরিক সভ্যতার দিকে। আদিম মানুষ অরণ্যে থেকে গাছ-গাছালির ফলমূল খেয়ে বেঁচে ছিল। আজকে ভাবতে অবাক লাগে, তা কী করে সম্ভব ছিল। কিন্তু এখন অরণ্য বলতে কিছুই নেই। চারিদিকে কেবল অট্টালিকার সারি। আজকের জমানার অধিকাংশ ছেলেমেয়ে অরণ্য চোখেও দেখেনি। অরণ্য কী তা ছবি দেখিয়ে বোঝাতে হয় তাদের।

সাগর, মহাসাগর, উপসাগর, নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, হ্রদ-হিমবাহ, মেরুতুষার-ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে বারিমন্ডল গঠিত। পৃথিবীর মোট পানির শতকরা ৯৭ ভাগ পানি সমুদ্রে থাকে। শতকরা দুইভাগ পানি আছে হিমবাহ ও মেরুতুষারে। মানুষের পানীয় এবং অন্যান্য ব্যববহারের উপযোগী মাত্র এক ভাগ পানির উৎস নদ-নদী, হ্রদ, পুকুর, ডোবা, কুয়ো, নলকূপ, ঝরনা ও ভূগর্ভ।

পৃথিবীতে পানির পরিমাণ ও মান হ্রাস পাচ্ছে। পরিত্যক্ত পানির শোষণ ও পানীয় পানি শুদ্ধিকরণ বিঘিœত হচ্ছে। অথচ পানি ছাড়া প্রাণী বা উদ্ভিদ বেঁচে থাকতে পারে না। পানির অপচয়ের মাত্রা দিনে দিনে বাড়ছে। তাই পানি সম্পদ ব্যবহার ও পানি সংরক্ষণের জন্য যথাযথ আইন প্রণয়ন জরুরি।

পানি বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী চার দশকের মধ্যে আমাদের দেশের ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ ভয়ঙ্করভাবে হ্রাস পাবে। ফলে পানির সঙ্কট দেখা দেবে। এমনিতেই এ দেশে সেচ সিক্ত জমির পরিমাণ খুব কম। তদুপরি পানির সঙ্কটের ফলে তা আরও কমে যাবে এবং স্বাভাবিকভাবে এর কুপ্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে না খাদ্যশস্যের উৎপাদনও। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বার বার এ ব্যাপারে সতর্কবার্তা দিয়ে আসছেন।

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানীদের নিয়ে গঠিত সমীক্ষক দল বলছেন, আগামী ৪০ বছরে ভূগর্ভস্থ পানির সঞ্চয় ৩৮ শতাংশ হ্রাস পাবে। একদিকে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যেমন কমে যাবে, অন্যদিকে বর্ষা ঋতুর সময়সীমাও কমবে। বর্ষা ছাড়া অন্য ঋতুতে বৃষ্টি প্রায় হবেই না। দীর্ঘদিন ধরে অল্প অল্প বৃষ্টিপাত না হয়ে, কম সময়ে বেশি বৃষ্টি হবে। ফলে বৃষ্টির পানি নদী-নালা-খাল বাহিত হয়ে সাগরে বয়ে যাবে। সচ্ছিদ্র মাটি সে পানিকে যথেষ্ট পরিমাণে শুষে নেওয়ার সময় পাবে না। কমে যাবে মাটির নিচে পানির সঞ্চয়, নেমে যাবে পানিস্তর। অন্যদিকে ভূমিক্ষয় বাড়বে। জনৈক বিজ্ঞানী সবচেয়ে ভয়াবহ যে তথ্যটি জানিয়েছেন তা হলো, পরিবেশগত তাপমাত্রা ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে হিমবাহ গলে শেষ হয়ে যাবে। বড় বড় নদীতে পানিপ্রবাহ কমে যাবে। তাপমাত্রা হেরফেরের ফলে খাদ্যশস্যের উৎপাদনও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশের খাদ্যশস্যের মজুত ভান্ডারে টান পড়বে।

অস্ট্রেলিয়ার এক দৈনিক পত্রিকার সংবাদে বলা হয়েছে, ২০৮০ সালের মধ্যে বিশ্বের ১১০ কোটি থেকে ৩২০ কোটি মানুষ পানির চরম অভাবের মুখে গিয়ে দাঁড়াবে। পাশাপাশি সে সময়ের মধ্যে কম করেও ২০ থেকে ৬০ কোটি লোক ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হবে। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি বর্তমানে যেভাবে ঘটছে তার পরিমাণ ২০৮০ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধি পেলে হিমবাহ তথা তুষারাঞ্চলের অবক্ষয় ঘটবে। ফলে বাড়বে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। লক্ষ লক্ষ মানুষের ঘর-বাড়ি ভেসে সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে যাবে। এমনকি বিশ্বের জৈব সম্পদের বৃহত্তম ভান্ডার হিসেবে পরিচিত অস্ট্রেলিয়ার উপকূলবর্তী গ্রেট বেরিয়ার রিফেরও অবলুপ্তি ঘটবে। জার্মানির পটসডামে ‘ন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টার ফর জিওসায়েন্স’র বিজ্ঞানীরা বলেছেন, পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির পরিণামে ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ সমগ্র বিশ্বকে গ্রাস করবে। এর ফলে ধ্বংস হতে পারে মানব সভ্যতা। জার্মানির বিজ্ঞানীরা এ ক্ষেত্রে অতীত ইতিহাসের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলেছেন, মেক্সিকোর মায়া, চীনের তাং বংশের সময়কালীন সভ্যতা মোহেনজোদাড়ো এবং সিন্ধু সভ্যতা প্রাকৃতিক কারণেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।

সংবাদটিতে অস্ট্রেলিয়ার প্রসঙ্গে জানানো হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রেট বেরিয়ার রিফের অবলুপ্তির পাশাপাশি প্রবাল প্রাচীর ধ্বংস হয়ে সাগরের পানি অধিক অম্লযুক্ত হয়ে পড়বে। প্রবাল কীট ও উদ্ভিদ জাতীয় জৈব সম্পদ ধ্বংসের ফলে সাদা চুনাপাথরের কঙ্কালের প্রাচীরে পরিণত হবে বিশ্বের এ জৈব সম্পদের বৃহত্তম ভান্ডারটি।

আবহাওয়ার পরিবর্তন নিয়ে কাজ করা আন্তঃরাষ্ট্রীয় গবেষণা সংস্থা (আইপিসিসি)’র মতে, (১) পানির স্তর নামার ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে এশিয়া অঞ্চলে তীব্র পানিসঙ্কট দেখা দেবে। বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে এশিয়া অঞ্চলে। (২) ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের উপকূলবর্তী এলাকায় সমুদ্রপানির তাপমাত্রা বাড়বে। (৩) ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, কলেরার জীবাণু আরো সক্রিয় হবে। (৪) তিব্বতে অন্তত চার কিলোমিটার হিমবাহ নিশ্চিহ্ন হবে। (৫) সমুদ্রের পানিস্তর বেড়ে ম্যানগ্রোভ অরণ্য তলিয়ে যাবে। (৬) ত্রিশ বছরে এশিয়ার ৩০ শতাংশ প্রবাল প্রাচীর নষ্ট হবে। (৭) বিপর্যয় ঘটবে সমুদ্র তলের টেকটনিক প্লেটে।

পরিবেশের বিপন্নতার সমার্থক হলো মানুষের বিপন্নতা। আমাদের এ বিপন্নতা কোনো বিদেশি সাহায্য অথবা সরকারি বদান্যতা রোধ করতে পারবে না। আমাদের দেশের পরিবেশকে বাঁচাতে পারে আমাদের মধ্যে অর্জিত সচেতনতা। ‘এ ক্ষেত্রে আমাদের যে সমস্ত ‘সাকসেস স্টোরি’ তা হোক আমাদের বেঁচে থাকার অভিযানের পাথেয়, অনুপ্রেরণা। মনে রাখতে হবে, পরিবেশ রক্ষার জন্য যে সচেতনতার কথা বলছি তা যেন শ্লোগানধর্মী অভিযানে পরিণত না হয়। এ সচেতনতাকে বাস্তবায়িত করতে পারে ছোট ছোট বাস্তব কর্মসূচি। নিজেকে দিয়ে শুরু করতে হবে। নিজে পানি অপচয় না করে পরিবারের আরও দু’জন সদস্যকে সচেতন করতে পারার মাধ্যমে প্রাথমিক কাজটি শুরু করা যায়। আমাদের লক্ষ রাখতে হবে যে, এসব পদ্ধতি অবলম্বন করলে পানির প্রচুর সাশ্রয় হবে। সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে পাশাপাশি সরকারকে এ কঠিন সমস্যা সমাধানে আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আসতে হবে। সমস্যা আছে, থাকবে তার সমাধানও আছে। বসে থাকলে হবে না। দীর্ঘদিন আগে এডমন্ড হিলারী বলেছিলেন, পরিবেশজনিত সমস্যা আসলে একটি সামাজিক সমস্যা, এ সমস্যা সৃষ্টির কারণ ও শিকার দুই-ই মানুষ। আর মানুষই পারে এ সমস্যা সমাধান করতে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

দুবছর ধরেই ভারতে বন্ধ কোভিশিল্ড, বিতর্কের মধ্যে দাবি সিরামের

দুবছর ধরেই ভারতে বন্ধ কোভিশিল্ড, বিতর্কের মধ্যে দাবি সিরামের

ফের জেলেনস্কিকে খুনের ছক, ষড়যন্ত্রে শামিল ইউক্রেনেরই দুই কর্নেল!

ফের জেলেনস্কিকে খুনের ছক, ষড়যন্ত্রে শামিল ইউক্রেনেরই দুই কর্নেল!

‘গণছুটি’ নেয়া কেবিন ক্রুদের একসঙ্গে বরখাস্ত করল এয়ার ইন্ডিয়া

‘গণছুটি’ নেয়া কেবিন ক্রুদের একসঙ্গে বরখাস্ত করল এয়ার ইন্ডিয়া

রেফারিং নিয়ে ক্ষোভে ফুঁসছে বায়ার্ন

রেফারিং নিয়ে ক্ষোভে ফুঁসছে বায়ার্ন

হিজবুল্লাহর হামলায় উত্তর ইসরাইলে এক ইহুদিবাদী সেনা নিহত

হিজবুল্লাহর হামলায় উত্তর ইসরাইলে এক ইহুদিবাদী সেনা নিহত

বাইডেনের স্বীকারোক্তি, মার্কিন বোমায় মারা গেছেন ফিলিস্তিনিরা

বাইডেনের স্বীকারোক্তি, মার্কিন বোমায় মারা গেছেন ফিলিস্তিনিরা

কর্ণফুলীতে বিধ্বস্ত বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান, অক্ষত ২ পাইলট, চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজ চলাচল বন্ধ

কর্ণফুলীতে বিধ্বস্ত বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান, অক্ষত ২ পাইলট, চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজ চলাচল বন্ধ

ইসরাইলকে তথ্য দিতে গাজায় ব্রিটেনের ২০০ গোয়েন্দা ফ্লাইটের ১০০০ ঘণ্টা নজরদারি

ইসরাইলকে তথ্য দিতে গাজায় ব্রিটেনের ২০০ গোয়েন্দা ফ্লাইটের ১০০০ ঘণ্টা নজরদারি

এবার রাষ্ট্রীয় খরচে হজে যাচ্ছেন ৬৩ জন

এবার রাষ্ট্রীয় খরচে হজে যাচ্ছেন ৬৩ জন

রাজধানীতে জামায়াতের বিক্ষোভ

রাজধানীতে জামায়াতের বিক্ষোভ

ব্রাজিলে ভয়াবহ বন্যায় মৃত্যু ১০০ ছাড়িয়ে গেছে

ব্রাজিলে ভয়াবহ বন্যায় মৃত্যু ১০০ ছাড়িয়ে গেছে

একই গ্রাম থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান ও দুই ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত

একই গ্রাম থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান ও দুই ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত

ট্রাম্প নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেবেন না : বাইডেন

ট্রাম্প নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেবেন না : বাইডেন

ঝিনাইদহ সদর উপজেলায় তৃতীয় লিঙ্গের প্রার্থী হলেন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান

ঝিনাইদহ সদর উপজেলায় তৃতীয় লিঙ্গের প্রার্থী হলেন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান

“ইউক্রেনের কারাবন্দিরা যোগ দিতে পারবেন সেনাবাহিনীতে”

“ইউক্রেনের কারাবন্দিরা যোগ দিতে পারবেন সেনাবাহিনীতে”

গাজার আল-শিফা হাসপাতালে তৃতীয় গণকবরের সন্ধান, ৪৯ মৃতদেহ উদ্ধার

গাজার আল-শিফা হাসপাতালে তৃতীয় গণকবরের সন্ধান, ৪৯ মৃতদেহ উদ্ধার

২৫ বছর আগে খুন হওয়া চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীর মামলার রায় আজ

২৫ বছর আগে খুন হওয়া চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীর মামলার রায় আজ

জোট গঠনের সম্ভাবনা, কেন ইরানকে গুরুত্ব দিচ্ছে উত্তর কোরিয়া?

জোট গঠনের সম্ভাবনা, কেন ইরানকে গুরুত্ব দিচ্ছে উত্তর কোরিয়া?

ঈশ্বরদী-ঢাকা রেলরুটে বুড়িমারী এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত, পাঁচ ঘণ্টা পর ট্রেন চলাচল শুরু

ঈশ্বরদী-ঢাকা রেলরুটে বুড়িমারী এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত, পাঁচ ঘণ্টা পর ট্রেন চলাচল শুরু

ইচ্ছাকৃতভাবে এইচআইভি ছড়ানোর অপরাধে ৩০ বছরের কারাদণ্ড মার্কিন যুবকের

ইচ্ছাকৃতভাবে এইচআইভি ছড়ানোর অপরাধে ৩০ বছরের কারাদণ্ড মার্কিন যুবকের