পাহাড় ধসে মৃত্যুর মিছিল বাড়ছেই

Daily Inqilab অলিউর রহমান ফিরোজ

২৪ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম | আপডেট: ২৪ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম

ফের মাটি চাপা পড়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১০ জনের করুণ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। যারা মারা গেছে তাদের মধ্যে নারী ও শিশু রয়েছে। মৌসুমী বায়ু প্রবাহে পাহাড়ের পরিস্থিতি আরো নাজুক করে দিতে পারে। রয়েছে আরো পাহাড় ধসের শঙ্কা। এতে বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারে। এমন অভাবনীয় মৃত্যু মানুষ মেনে নিতে পারে না।। কয়েকদিন আগে সিলেটে একই পরিবারের ৩ জন মাটি চাপা পড়ে মারা গিয়েছিল। তার রেশ কাটতে না কাটতেই আবারও মর্মান্তিক দুর্ঘটার শিকার হলো মানুষ। সাধারণ বৃষ্টিপাত হলেই এখন পাহাড় ধসের অবতারণা হচ্ছে। প্রশাসনিকভাবে কার্যকর এবং বলিষ্ঠ পদক্ষেপের অভাবেই একের পর ঘটে চলেছে দুর্ঘটনা। পাহাড়ের কোন অঞ্চল মারাত্মক ঝুঁিকপূর্ণ, তা প্রশাসন চিহ্নিত করেছে। তার পরও কেন পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হচ্ছে না? এ সরল প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না অনেক সময়। একটি ঘটনার পর আমাদের টনক নড়ে। কিছুদিন তা বহাল থাকে। আবার সব কিছু আগের নিয়মে চলতে থাকে। এভাবে আমরা পাহাড়ের অনেক বোবা কান্নার সাক্ষী হয়েছি। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কি আমরা এভাবেই পাহাড় চাপা পড়ে মরবো?

পাহাড় ধসের অন্যতম কারণ হলো, পাহাড় কেটে আমরা নগ্ন করে ফেলেছি। তার ফলে পাহাড় এখন দাঁড়াতে পারছে না। পাহাড়ের অবকাঠামোগত বৈশিষ্ট্য বিনষ্ট করায় প্রবল ঝড় বৃষ্টিতে মাটি ধরে রাখা পাহাড়ের পক্ষে আর সম্ভব নয়। আমরা নির্বিচারে গাছ কেটে পাহাড় উজাড় করে ফেলেছি। গাছের শিকড় মাটি শক্ত করে ধরে রাখার কাজটি করে যেতো। গাছ কেটে ফতুর করায় পাহাড় তার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। একেকটি পাহাড় ধরিত্রীর জন্য খিলান স্বরূপ। পাহাড়ের মাটি এবং গাছ কাটার ফলে বৃষ্টিপাত এবং ভূমিকম্পে মাটি নড়বড়ে হয়ে যাওয়ায় এবং প্রবল ভূমি ধসে পাহাড়ের মাটি গলে নিচের দিকে নামতে থাকে। কিছু লোভী মানুষ পাহাড়ের পাদদেশের জায়গা দখল করে সেখানে নি¤œ আয়ের মানুষের কাছে ঘর ভাড়া দিয়ে থাকে। এভাবে একসময় খেটে খাওয়া মানুষগুলো মৃত্যুর মুখে পতিত হতে হয়। ২০০-৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতই ভূমি ধসের জন্য যথেষ্ট। সেখানে ৪০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ২০০৭ সালে ৯৫০ মিলি মিটার পর্যস্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যে মৃত্যু হলো তাতে সেখানকার পরিস্তিতি যে আরো ভয়ানক তা কারো বুঝতে বাকি নেই। আরো বড় ঘটনার জন্য কি আমরা এখন প্রহর গুনবো, নাকি প্রশাসনিকভাবে কোনো প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে? দেশের উত্তর ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের সিলেট এলাকা এবং দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজারে পাহাড় রয়েছে। তবে বৃহত্তম চট্টগ্রামে ১৫ হাজার ৮০৯ বর্গমাইল বিস্তৃত এলাকাতেই মূলত পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে থাকে। এসব পাহাড়ের যেসব অঞ্চলে ঘনবসতি এবং মানুষের বিচরণ বেশি সেসব পাহাড় টিলাতেই দুর্যোগ-দুর্বিপাক বেশি ঘটছে। এ এলাকার বান্দরবান ও আলীকদম উপজেলায় দুর্যোগপূর্ণ বেশি। এর মধ্যে লামা উপজেলার হরিণমারা, চিউসিমারা, ফাইতং, তেলুনিয়া, জামালিয়া, কামিয়াখালী ও রূপসী এলাকা। লামা পৌর এলাকার হাসপাতাল পাড়া, লুনারবিল, কুড়ালিয়ার টেক, টিএনটি পাহাড় এবং আলীকদম উপজেলার ক্রপ পাতা, পোয়ামহরী, আমতলী ও বাবুপাড়া সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।

তাছাড়া চট্টগ্রাম মহানগরীর ১৩টি পাহাড়কে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অপরদিকে চট্টগ্রাম জেলার মধ্যে জালালাবাদ পাহাড়, নবীনগর পাহাড়, হামজারবাগ, দেব পাহাড়, কুমবাগ পাহাড়, গোল পাহাড়, কৈবল্য পাহাড়, খুলশী পাহাড়, বার্মা কলোনী পাহাড়, হিলভিউ পাহাড়, জামতলা পাহাড়, এনায়েত বাজার পাহাড় ও বাটালী হিল পাহাড় অন্যতম। তাছাড়া কক্সবাজার শহরে পাহাড় কেটে অবৈধ বাড়ি তৈরি করা হয়েছে। পরিবেশবাদী সংগঠন এ বিষয়ে সোচ্চার হয়েছে। তাদের হিসেবে মতে, জেলার ১১ কিলোমিটার আয়তনের ছোট বড় ৫১টি সরকারি পাহাড় কেটে তৈরি হয়েছে ৬৬ হাজারের বেশি বাড়িঘর। কয়েকতলা বিশিষ্ট রয়েছে ৫ হাজারের বেশি। আধাপাকা রয়েছে ৮ হাজার, বাকিগুলো সব বাঁশের বেড়া, ত্রিপল দিয়ে তৈরি বাড়িঘর। এসব ঘরবাড়িতে ৩ লাখেরও বেশি মানুষ বসবাস করছে। এর মধ্যে ৮০ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছে। এসব এলাকায় গত ১৫ বছরে শতাধিক পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। উচ্চ আদালতে নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও ঝুঁিকপূর্ণ বসবাস থেকে মানুষকে সরানো সম্ভব হচ্ছে না। তার কারণ, খেটে খাওয়া গরিব মানুষ শহরে ভাড়া দিয়ে কুলাতে পারে না। অল্প আয়ের মানুষই মূলত পাড়ারের পাদদেশের ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকছে।

পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগে মেরং রেঞ্জের ৫ হাজার ৮ শত ৯৯ দশমিক ৬২ একর, হাজাছড়া রেঞ্জের ১২ হাজার ৩ শত ৫০ একর ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের নাড়াইছড়ি রেঞ্জের ৫৪ হাজার ১ শত ১২ একর বনাঞ্চলে গাছ নেই বললেই চলে। ১৯৮৬ সালে বিশেষ পরিস্থিতির কারণে বনাঞ্চল থেকে রেঞ্জ কার্যালয় গুটিয়ে নেওয়ায় এসব বনের অধিকাংশ গাছ দুর্র্বৃত্তরা লুট করে নিয়ে যায়। বাংলাদেশে পাহাড় ধসের সবেচেয় বড় কারণ বোধকরি পাহাড় কর্তন। বিগত তিন দশকে কেবল চট্টগ্রামে তিন শতাধিক পাহাড় কাটা পড়েছে। পাহাড় কাটা হচ্ছে পার্বত্য চটগ্রাম ও কক্সবাজারে। শুধু দুটো কারণে পাহাড় কাটা হচ্ছে। প্রথম, মাটি কেটে ইট ভাটায় ব্যবহার। দ্বিতীয়, প্লট তৈরি করে বসত বাড়ি নির্মাণ। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে বড় বড় ডেভেলপার কোম্পানি জড়িত। আর এই প্লট ও ফ্লাট ব্যবসায় নির্বিচারে অনুমোদন দিয়ে কর্তৃপক্ষ সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। চট্টগ্রামে পাহাড় কাটার মহোৎসব চলছে মূলত খুলশী, লাল খান বাজার, পাঁচলইশ, বায়েজীদ বোস্তামী, ফয়সলেক, পাহাড়তলী, কাটলী ও ভাটিয়ারীকে ঘিরে থাকা পাহাড়ে। অপরিকল্পিতভাবে এসব পাহাড়ের পাদদেশ কেটে ফেলার কারণে তা দুর্বল হয়ে যায়। বর্ষার পানি উপরে আটকে যায়। এসময় শো শো শব্দে প্রবলবেগে তাতে ধস নামে।

২০০৭ সালে পাহাড়ে মহাবিপর্যয়ের পর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে ২৮টি কারণ এবং ৩৬ দফা সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়েছিল। তার বাস্তবায়নের অগ্রগতি নেই। সেটি কার্যকর করা হলে পাহাড় ধসের পরিমাণ অনেক কমে যেতো। পাহাড় ধসের ২৮টি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো: ভারী বর্ষণ, বালুর আধিক্য, পাহাড়ের উপরি ভাগে গাছ না থাকা। গাছ কেটে ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলা, পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকির্পূণ বসবাস, বৃষ্টিপাতের পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না করা ইত্যাদি। অপরদিকে ৩৬টি সুপারিশ বাস্তবায়নের মধ্যে ছিল: জরুরি ভিত্তিতে বনায়ন, গাইড ওয়াল নির্মাণ, নিষ্কাশন ও শক্ত করে সীমানা প্রাচীর তৈরি করা, পাহাড়ের পানি ও বালু অপসারণের ব্যবস্থা গ্রহণ, বসতি স্থাপন টেকসই করা, যত্রতত্র পাহাড়ী বালু উত্তোলন না করা, পাহাড় এলাকার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ইট ভাটা নিষিদ্ধ করা, পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে হাউজিং প্রকল্প করতে না দেওয়া, মতিঝর্না এবং বাটালী হিলের পাদদেশে থাকা বসতি উচ্ছেদ করে পর্যটন স্পট করা, পাহাড় কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা ইত্যাদি।

এসব সুপারিশসের বাস্তবায়ন ঘটেনি। একারণে মৃত্যুর মিছিল বেড়েই চলেছে। গত কয়েক দশকে হাজারের মতো মানুষের প্রাণ গেছে পাহাড় ধসের ঘটনায়। এ মধ্যে ১৯৯৬ সাণে ৭ জন, ১৯৯৭ সালে ৭ জন, ১৯৯৯ সালে ৩ জন, ২০০৩ সালে ১০, ২০০৪ সালে ৫ জন, ২০০৫ সালে ৩ জন, ২০০৬ সালে ২ জন, , ২০০৭ সালে ১২৭ জন, ২০০৮ সালে ১৩ জন, ২০০৯ এবং সালে ৩ জন, ২০১০ সালে ৫৬ জন, ২০১১ সালে ১৩ জন, ২০১২ সালে ৯০ জন, ২০১৫ সালে ১৯ জন,২০১৭ সালে ১৮০ জন, ২০২৩ সালে মারা গেছে ৪ জন। এ পরিসংখ্যান বলছে, পাহাড় ধস হবে আর তাতে মৃত্যুর মিছিল বাড়বে। প্রশাসনিক কোনো দায় ও দায়িত্ব যেন এক্ষেত্রে নেই। সত্যি কি নেই?

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া জোট বেঁধে কাজ করার প্রতিশ্রুতি

যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া জোট বেঁধে কাজ করার প্রতিশ্রুতি

অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ, প্রতিশ্রুতিতে শেষ হলো বাইডেন-ট্রাম্প বিতর্ক

অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ, প্রতিশ্রুতিতে শেষ হলো বাইডেন-ট্রাম্প বিতর্ক

তরুণদের আ.লীগে যোগদানের আহ্বান ওবায়দুল কাদেরের

তরুণদের আ.লীগে যোগদানের আহ্বান ওবায়দুল কাদেরের

হেলিকপ্টার থেকে নেমেই টাকার ‘কার্পেটে’ হাঁটলেন প্রভাবশালীর প্রেমিকা, তারপর…

হেলিকপ্টার থেকে নেমেই টাকার ‘কার্পেটে’ হাঁটলেন প্রভাবশালীর প্রেমিকা, তারপর…

মার্কিন হুমকিতে চীন ভীত নয়: মুখপাত্র

মার্কিন হুমকিতে চীন ভীত নয়: মুখপাত্র

বলিভিয়াকে উড়িয়ে শেষ আটে উরুগুয়ে

বলিভিয়াকে উড়িয়ে শেষ আটে উরুগুয়ে

বরিশালে উপনির্বাচনে ‘ঘুষ’ নেওয়ায় আটক ৩ কর্মকর্তার জামিন

বরিশালে উপনির্বাচনে ‘ঘুষ’ নেওয়ায় আটক ৩ কর্মকর্তার জামিন

রাজধানীর খিলক্ষেতে পিকআপ উল্টে যুবক নিহত

রাজধানীর খিলক্ষেতে পিকআপ উল্টে যুবক নিহত

রেললাইন কেটে নাশকতার ঘটনায় গাজীপুর সিটি করপোরেশন এক কাউন্সিলরকে আটক

রেললাইন কেটে নাশকতার ঘটনায় গাজীপুর সিটি করপোরেশন এক কাউন্সিলরকে আটক

রাশিয়ার হুমকির মুখে ইউরোপে সামরিক তৎপরতা

রাশিয়ার হুমকির মুখে ইউরোপে সামরিক তৎপরতা

‘ফাইনাল খেলতে নয়, জিততে এসেছি’

‘ফাইনাল খেলতে নয়, জিততে এসেছি’

১০ মিনিটে জুমার নামাজ ও খুতবা শেষ করার নির্দেশনা আমিরাতে

১০ মিনিটে জুমার নামাজ ও খুতবা শেষ করার নির্দেশনা আমিরাতে

প্রবল বৃষ্টিতে ধসে পড়ল দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দরের ছাদ

প্রবল বৃষ্টিতে ধসে পড়ল দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দরের ছাদ

ভারতে পান্নুনের হত্যা ষড়যন্ত্র মামলার তদন্ত কতদূর, উত্তরের অপেক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র

ভারতে পান্নুনের হত্যা ষড়যন্ত্র মামলার তদন্ত কতদূর, উত্তরের অপেক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র

শুরুর আগেই ইংল্যান্ড সিরিজ শেষ রোচের

শুরুর আগেই ইংল্যান্ড সিরিজ শেষ রোচের

যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ফিলিপাইন বন্ধু নয় বরং দাবার ঘুঁটি

যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ফিলিপাইন বন্ধু নয় বরং দাবার ঘুঁটি

চট্টগ্রামে মার্কেটে আগুন ৩ জনের মৃত্যু

চট্টগ্রামে মার্কেটে আগুন ৩ জনের মৃত্যু

ইতালিতে হাত কেটে মৃত্যু ভারতীয় শ্রমিকের, শাস্তির আশ্বাস মেলোনির

ইতালিতে হাত কেটে মৃত্যু ভারতীয় শ্রমিকের, শাস্তির আশ্বাস মেলোনির

সালথায় ট্রলি উল্টে প্রাণ গেল যুবকের

সালথায় ট্রলি উল্টে প্রাণ গেল যুবকের

‘ছাংএ্য মিশন নতুন বিশ্ব রেকর্ড গড়েছে’

‘ছাংএ্য মিশন নতুন বিশ্ব রেকর্ড গড়েছে’