বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ে জনদুর্ভোগ চরমে

Daily Inqilab ইনকিলাব

২৮ জুন ২০২৪, ১২:১১ এএম | আপডেট: ২৮ জুন ২০২৪, ১২:১১ এএম

বিদ্যুতখাতকে অগ্রাধিকারভিত্তিক খাত হিসেবে এগিয়ে রেখেছে সরকার। গত দেড় দশকে বিদ্যুৎ খাতে বিপুল বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে উৎপাদন সক্ষমতা তিন-চারগুণ বাড়লেও বিদ্যুতের লোডশেডিং সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। বিদ্যুৎখাতের বিনিয়োগ, চাহিদা অনুপাতে ঘাটতি, ভর্তুকি এবং লোকসান পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। রেন্টাল, কুইক-রেন্টাল বিদ্যুতকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জের নামে ক্রমবর্ধমান ভর্তুকির বোঝা শেষ পর্যন্ত জনগণের উপর চাপাচ্ছে সরকার। ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি বছর মূল্য বাড়িয়ে গ্রাহকদের উপর বাড়তি খরচের বোঝা চাপিয়ে দিলেও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাচ্ছেনা দেশের মানুষ। গত গ্রীষ্মে দেশে অসহনীয় তাপদাহ শুরু হয়ে এখনো চলছে। এ কারণে স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখাসহ পরিবর্তিত সময়সূচিও নির্ধারণ করে সরকার। বিদ্যুতের বাড়তি লোডশেডিং দাপদাহের দুর্ভোগকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে বিদ্যুতের লোডশেডিং সহনীয় মাত্রায় রাখার প্রয়াস দেখা গেলেও এর বিপরীত ফলাফল পড়ছে গ্রামাঞ্চলে। বিভাগীয় শহরের বাইরের জনপদে ক্রমবর্ধমান লোডশেডিংয়ের কারণে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় ব্যাঘাত সৃষ্টির পাশাপাশি কৃষি উৎপাদন এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান লোডশেডিংয়ের কারণে শিল্পোৎপাদনে স্থবিরতা এবং জনদুর্ভোগের চিত্র বেরিয়ে এসেছে। একই অবস্থা বৃহত্তর সিলেট, যশোর এবং রংপুর অঞ্চলেও। চট্টগ্রাম অঞ্চলের ২৬টি বিদ্যুতকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা সাড়ে ৪ হাজার মেগাওয়াটের বেশি হলেও চাহিদা অনুসারে জ্বালানি সরবরাহের সক্ষমতার অভাবে ১৯শ থেকে ২ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না।

তাপদাহ তথা হিটওয়েভের কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা এবং কর্মপ্রবাহ বিঘিœত হচ্ছে। বিদ্যুতে লোডশেডিং সেই দুর্ভোগ এবং স্থবিরতাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। দেশের বিদ্যুত খাতে এক জটিল বিদঘুটে অবস্থা বিরাজ করছে। এই মুহূর্তে দেশে ২৭ হাজার ৫১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও বিদ্যুতকেন্দ্রগুলো থেকে চাহিদা ১৫ হাজার মেগাওয়াট। গতকাল একটি ইংরেজী দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে গত বুধবার চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ২,২৪৫ মেগাওয়াট কম হওয়ায় এ পরিমান বিদ্যুতের লোডশেডিং দিতে হয়েছে। তবে মাঠের বাস্তব চিত্র আরো বেশি প্রকট বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। ঈদের ছুটি শেষে মানুষের কর্মব্যস্ততা এবং যখন ক্ষুদ্র ও বৃহৎ শিল্পকারখানাগুলো উৎপাদনে ফিরে আসতে শুরু করেছে তখন তাপদাহ বৃদ্ধির সাথে সাথে বিদ্যুতের লোডশেডিং জনজীবন ও উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় বাড়তি বিপত্তি হয়ে দেখা দিয়েছে। দেশে ডলার সংকট তথা অর্থনৈতিক সংকট বিদ্যুতের জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থাকে সরাসরি আক্রান্ত করছে। অথচ বিনিয়োগ ও শিল্পোৎপাদনের চাকা নিরবচ্ছিন্ন রাখা ছাড়া অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করা অসম্ভব। এর একটির সাথে আরেকটি নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান লোডশেডিং জনজীবনে দুর্ভোগ বৃদ্ধির সাথে সাথে দেশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের বড় অংশের শিক্ষা জীবনে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে। বিদ্যুতের অনির্ধারিত লোডশেডিং ও ভোল্টেজের ওঠানামার কারনে টিভি, ফ্রিজারসহ ঘরের ইলেট্রনিক সামগ্রী নষ্ট হয়ে যাওয়ায় অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়ছে গ্রামের সাধারণ মানুষ।

বিদ্যুৎ খাতের এমন জটিল অবস্থা হঠাৎ করেই শুরু হয়নি। অগ্রাধিকার ভিত্তিক খাতের তকমা নিয়ে গত দেড় দশকে ধীরে ধীরে বিদ্যুৎ খাত একটি শ্বেতহস্তিতে পরিনত হয়েছে। যত দিন যাচ্ছে বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি ও লোকসান বেড়ে চলেছে। আর এই লোকসানের বোঝা শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের উপর বর্তাচ্ছে। বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সিপিডি’র সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে পিডিবি’র লোকসান ১৯৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে কমপক্ষে ১৮ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছবে। আগামি বছর তা ২৫ হাজার কোটি টাকায় পৌছাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ক্যাপাসিটি চার্জের নামে দেশি-বিদেশি বিদ্যুতকেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রেখে গত অর্থ বছরে ২৬ হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। ভর্তুকি কমানোর জন্য গ্রাহক পর্যায়ে বার বার বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানো হলেও ভর্তুকি, লোকসান এবং লোডশেডিং কমাতে পারেনি। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুতকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জের নামে দুর্নীতি, লুটপাট বন্ধের কথা বললেও সরকার এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সাথে চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করা অব্যাহত রেখেছে। কেউ কেউ একে লুটেরা মডেল বলে অভিহিত করেছেন। দেশের বিদ্যুৎখাতকে সরকারের সাথে সম্পৃক্ত একটি প্রভাবশালী মহলের লুটপাট এবং ভারত ও চীনা কোম্পানির পুনর্বাসন কেন্দ্র হিসেবে জনগণের উপর দুর্বহ বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের বিনিয়োগকারী ও ব্যবসায়ীরা বাড়তি মূল্য দিয়ে হলেও শিল্পকারখানায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা চেয়েছেন। গ্যাস-বিদ্যুৎ শুধুমাত্র উৎপাদন ব্যবস্থার নিয়ামক শক্তিই নয়, এটি জনজীবনের এক অত্যাবশ্যকীয় বিষয়ে পরিনত হয়েছে। অনিয়ন্ত্রিত ও অনিশ্চিত লোডশেডিং কৃষি উৎপাদন, খাদ্য নিরাপত্তা, শিল্পোৎপাদন, শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও জনজীবনকে চরমভাবে প্রভাবিত করছে। বিদ্যুৎখাতের সক্ষমতাকে কাজে লাগাতে হলে প্রথমেই এর অস্বচ্ছতা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। জ্বালানি খাতে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় উৎসগুলোর দিকে নজর দেয়া এখন সময়ের দাবি।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ধর্মঘটের জেরে রাতারাতি ৪০০ ফ্লাইট বাতিল করল ওয়েস্টজেট

ধর্মঘটের জেরে রাতারাতি ৪০০ ফ্লাইট বাতিল করল ওয়েস্টজেট

‘ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ’ হবে, ইরানকে কড়া হুঁশিয়ারি ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর

‘ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ’ হবে, ইরানকে কড়া হুঁশিয়ারি ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর

ঢাবির ১০৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি বর্জন শিক্ষক সমিতির

ঢাবির ১০৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি বর্জন শিক্ষক সমিতির

বিভিন্ন আদালতে ৪১ লাখ ৯ হাজার মামলা জট : সংসদে আইনমন্ত্রী

বিভিন্ন আদালতে ৪১ লাখ ৯ হাজার মামলা জট : সংসদে আইনমন্ত্রী

পঞ্চগড়ে মেয়েকে ধর্ষণের অপরাধে বাবার আমৃত্যু কারাদণ্ড

পঞ্চগড়ে মেয়েকে ধর্ষণের অপরাধে বাবার আমৃত্যু কারাদণ্ড

গোদাগাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় ২ নিহিত, ১০ জন আহত।

গোদাগাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় ২ নিহিত, ১০ জন আহত।

শিবগঞ্জে স্ত্রীকে কুপিয়ে হত্যা, স্বামী আটক

শিবগঞ্জে স্ত্রীকে কুপিয়ে হত্যা, স্বামী আটক

টিকিট নাই, অথচ বিমানের সিট ফাঁকা— এই পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হতে চাই : বিমানের নতুন এমডি

টিকিট নাই, অথচ বিমানের সিট ফাঁকা— এই পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হতে চাই : বিমানের নতুন এমডি

ফতুল্লায় দুই ছেলেকে বাঁচাতে গিয়েই খুন হন সুরুজ, মূল আসামিসহ গ্রেপ্তার ৪

ফতুল্লায় দুই ছেলেকে বাঁচাতে গিয়েই খুন হন সুরুজ, মূল আসামিসহ গ্রেপ্তার ৪

মালয়েশিয়া ৩০ হাজার শ্রমিক পাঠানোর নামে অর্থ লুট : কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে জানতে চান হাইকোর্ট

মালয়েশিয়া ৩০ হাজার শ্রমিক পাঠানোর নামে অর্থ লুট : কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে জানতে চান হাইকোর্ট

সাবেক এমপি বিএনপি নেতা নাদিম মোস্তফা মারা গেছেন

সাবেক এমপি বিএনপি নেতা নাদিম মোস্তফা মারা গেছেন

জাতীয় সংসদে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট পাস

জাতীয় সংসদে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট পাস

গুলশানে বেনজীরের ৪ ফ্ল্যাটে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ

গুলশানে বেনজীরের ৪ ফ্ল্যাটে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ

গাজাযুদ্ধ উত্তেজনার মধ্যেই নাগরিকদের লেবানন ছাড়ার নির্দেশনা বিভিন্ন দেশের

গাজাযুদ্ধ উত্তেজনার মধ্যেই নাগরিকদের লেবানন ছাড়ার নির্দেশনা বিভিন্ন দেশের

সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পাস

সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পাস

অনলাইন জুয়া বেড়েছে, নিয়ন্ত্রণে দরকার সমন্বিত প্রচেষ্টা

অনলাইন জুয়া বেড়েছে, নিয়ন্ত্রণে দরকার সমন্বিত প্রচেষ্টা

ফ্রান্সে জাতীয় পরিষদের প্রথম ধাপে ভোটগ্রহণ আজ

ফ্রান্সে জাতীয় পরিষদের প্রথম ধাপে ভোটগ্রহণ আজ

৩০ তম ভারতীয় সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নিলেন উপেন্দ্র দ্বিবেদী

৩০ তম ভারতীয় সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নিলেন উপেন্দ্র দ্বিবেদী

দৌলতপুর গার্লস কলেজ কেন্দ্রে ৪ শিক্ষককে বহিস্কার

দৌলতপুর গার্লস কলেজ কেন্দ্রে ৪ শিক্ষককে বহিস্কার

ভাঙা দাঁতই চেনাল হারানো ভাইকে! ১৮ বছর পর দেখা বোনের সঙ্গে

ভাঙা দাঁতই চেনাল হারানো ভাইকে! ১৮ বছর পর দেখা বোনের সঙ্গে