বিজয়কে সংহত ও দেশকে এগিয়ে নিতে হবে
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৫ এএম
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেছেন এবং এখনো ভারতেই বসবাস করছেন। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগের এই শাসন ছিল চরম দুঃশাসনে ভরা। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার দুই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ইতিহাসের বর্বরতম এবং নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়। দাবি আদায় এবং বিডিআর বিদ্রোহের নামে সে বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় সেনাবাহিনীর ৫৭ জন কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার পর অনেক সেনা কর্মকর্তা চাকরি হারান। বিডিআরের কয়েক হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গেপ্তার করা হয়, যারা এ ঘটনায় শাস্তি পেয়ে এখনো কারাগারে আছেন। অনেককে চাকরিচ্যুত করা হয়। এভাবে সেনাবাহিনী এবং বিডিআরÑ দুটোরই অপূরণীয় ক্ষতি করা হয়। অর্থনীতিতে চলেছে ভয়াবহ লুটতরাজ এবং রাজনীতিতে চলেছে চরম দমন-নিপীড়ন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ঋণের নামে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করা হয়েছে। শেয়ারবাজার ধ্বংস করে লুট করা হয়েছে লক্ষ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভও চুরি হয়। দেশ থেকে পাচার হয়েছে কয়েক লক্ষ কোটি টাকা। দৈনিক বনিক বার্তায় ৭ আগস্ট প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার ১৫ লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ করেছে এবং এ সময়ে দেশ থেকে পাচার হয়েছে ১৫০ বিলিয়ন ডলার। বিরোধী মতের মালিকাধীন ব্যাংক, বীমাসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদ ক্ষমতার জোরে পরিবর্তন করে সেগুলো দখল করা হয়েছে। বিরোধী মতের লোকদের মালিকানাধীন একাধিক টিভি চ্যানেল এবং পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। দিগন্ত টেলিভিশন, ইসলামিক টেলিভিশন, চ্যানেল ওয়ান, দৈনিক আমার দেশ এবং দৈনিক দিনকাল এর মধ্যে অন্যতম। বিরোধী দলের রাজনৈতিক অফিস বছরের পর বছর বন্ধ রেখেছে। বিরোধী দলের জনসভায় অনেকবার হামলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকার সময় তত্ত্ববধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছে। তারা সব সময় বলেছে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কখনো সুষ্ঠু হয় না। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থা সংবিধানে সংযুক্ত হয়। অথচ, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থাই বাতিল করে দেয়। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। ২০১৪ এবং ২০২৪ সালে বিএনপিসহ বিরোধী দল নির্বাচন বয়কট করেছে। ২০১৮ সালে ভোটের আগের রাতে ভোট বাক্স পূরণ করা হয়েছে। ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা এবং সিটি কর্পোরেশনসহ কোনো নির্বাচনেই জনগণ ভোট দিতে পারেনি। ভোট কারচুপি, ভোট কেন্দ্র দখল এবং কথায় কথায় বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা কোথাও বৈঠক করলেও সেখানে পুলিশ হানা দিয়েছে এবং নাশকতার জন্য গোপন বৈঠকের অভিযোগ তুলে মামলা দিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করেছে। বিরোধী দলের কোনো কোনো নেতার বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা হয়েছে। শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, সারা দেশে বিএনপি জামাতের বিরুদ্ধে ৮১০৫টি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় প্রায় ৫০ লাখ মানুষ আসামী। মানুষ স্বাধীনভাবে কথা বলতে, চলাফেরা করতে এবং নিশ্চিন্তে বসবাস করতে পারেনি। সর্বত্র বিরাজ করেছে ভয়ের এক সংস্কৃতি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার কোনো পরিবেশ ছিল না। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠনসমূহের কার্যক্রম ছিল এক প্রকার নিষিদ্ধ। হলগুলিতে ছিল ছাত্রলীগের একক দখলদারিত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ। ছিট দখল, চাঁদাবাজি এবং বিরোধী মতের ছাত্রদের ওপর নির্যাতন ছিল নিত্য দিনের চিত্র। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে সাজানো মামলায় কারাদণ্ড দিয়ে জেলে নিয়েছে, চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে দেয়নি। তারেক রহমান দীর্ঘদিন থেকে নির্বাসিত এবং তাকেও বিভিন্ন মামলায় কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। কয়েক শত মানুষকে গুম করা হয়েছে এবং বিরোধী মতের অনেক নেতাকর্মীকে মিথ্যা মামলায় বছরের পর বছর জেলে আটকে রাখা হয়েছে। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীসহ বহু রাজনৈতিক নেতাকর্মী এখনো নিখোঁজ। আয়নাঘর প্রতিষ্ঠা করে অনেককে বছরের পর বছর আটকে রাথা হয়েছে। বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ ঢাকা থেকে অপহৃত হবার দীর্ঘ নয় বছর পর ভারত থেকে দেশে ফিরেছেন। ২০১৩ সালের ৫ মে রাতে শাপলা চত্বরে হেফাজতের অবস্থান কর্মসূচিতে আইনশৃংখলা বাহিনী ভয়াবহ হামলা চালিয়েছে, যাতে অনেক মানুষ মারা যায়। মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর তথ্য মতে, সেদিন ৬১ জন মানুষ মারা যায়। অধিকারের তথ্য মতে, ২০০৯-২৩ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শাসন আমলে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে মারা যায় ২৬৯৯ জন, গুম হয় ৬৭৭ জন এবং কারাগারে মৃত্যুবরণ করে ১০৪৮ জন। সবখানে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি কায়েম করা হয়েছে। দুর্নীতি ছিল লাগামহীন, সব জায়গায় চলেছে লুটপাটের খেলা।
গত ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। এই সরকার রাষ্ট্র সংস্কার এবং একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য কাজ করছে। প্রধান উপদেষ্টা ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে রাষ্ট্র সংস্কারের পথরেখা ঘোষণা করেছেন। এজন্য তিনি ৬টি কমিশন গঠন করেছেন। ড. বদিউল আলম মজুমদারকে প্রধান করে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, সফর রাজ হোসেনকে প্রধান করে পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন, বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মুমিনুর রহমানকে প্রধান করে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, ড. ইফতেখারুজ্জামানকে প্রধান করে দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন, আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীকে প্রধান করে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন এবং অধ্যাপক আলী রিয়াজকে প্রধান করে সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। দেশ সংস্কার এবং পুনর্গঠনে প্রথমেই সব ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। সুশাসনের অভাবে দুঃশাসনের জন্ম নেয় এবং ন্যায়বিচারের অভাবে বৈষম্য সৃষ্টি হয়। পুলিশ, প্রশাসন, বিচারালয় এবং সকল নিরাপত্তা বাহিনীকে পুুনর্গঠন করতে হবে। ব্যাংক বীমাসহ সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে পুনর্গঠন করতে হবে। ব্যাংকিং সেক্টরে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠন করতে হবে। শেয়ারবাজার পুনর্গঠন করতে হবে এবং নতুন নতুন কো¤পানিকে শেয়ারবাজারে আনতে হবে। সৎ, যোগ্য এবং দেশপ্রেমিক জনবল দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানকে সাজাতে হবে। সকল কাজে পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। পাচার এবং লুটপাটের অর্থ উদ্ধার করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ছাত্র রাজনীতির নামে রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি এবং হল দখল বন্ধ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য আধুনিক, যুগোপযুগী, বিজ্ঞানসম্মত এবং নৈতিকতাসমৃদ্ধ কারিকুলাম প্রণয়ন করতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের কাজ হচ্ছে পড়াশোনা এবং গবেষণা করে নিজেকে গঠনের মাধ্যমে দেশকে গঠন করা। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক ভিন্নতার কারণে কারো কণ্ঠরোধ করা যাবে না এবং মিথ্যা মামলা দিয়ে কাউকে হয়রানি করা যাবে না। সব ধর্মের মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে এবং মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডাসহ উপসনালয় সুক্ষিত রাখতে হবে। বিভিন্ন সময়ে যারা নানা ধরনের অপরাধ করেছে তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় এনে শাস্তি দিতে হবে। অপরাধীর কোনো রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনা করা যাবে না।
এই দেশ আমার, আপনার এবং আমাদের সবার। দেশ সংস্কার করতে হলে আগে নিজেকে সংস্কার করতে হবে। সংস্কারের মাধ্যমে এদেশকে আমাদেরকেই পুনর্গঠন করতে হবে এবং সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে। এজন্য আমাদের সবাইকে মিলে মিশে একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। জাতির স্বার্থে নিজের স্বার্থকে বিসর্জন দিতে হবে। জাতিকে কিছুতেই এবং কখনোই বিভক্ত করা যাবে না। সবার আগে বিজয়কে সুসংহত করেত হবে। দেশ গঠনের এরকম সুযোগ কিন্তু কয়েক শতাব্দীতেও আসে না। আমাদের কারো ভুলের কারণে এই বিজয় যেন কেউ ছিনতাই করতে না পারে তার জন্য সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। পরাজিত শক্তি এবং তাদের দেশি-বিদেশি সহযোগী শক্তি কিন্তু বসে নাই। তারা এই বিজয়কে নস্যাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে। সুতরাং তাদের ষড়যন্ত্রকে রুখে দিয়ে বিজয়কে সুসংহত করার জন্য সকল দেশপ্রেমিক শক্তির ই¯পাত কঠিন ঐক্য অপরিহার্য। এক দেশ, এক জাতি, আমরা সবাই বাংলাদেশিÑ এই মূলনীতিতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আজকে আমরা যে দ্বিতীয় স্বাধীনতা পেয়েছি, সেই স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হবে এবং দেশকে এগিয়ে নিতে হবে।
লেখক: প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
আদানির দুর্নীতি : এবার ভারতেই বির্তকের মুখে মোদি সরকার
প্রেসিডেন্টর সঙ্গে তিন বাহিনী প্রধানের সৌজন্য সাক্ষাৎ
নিজ্জর হত্যায় মোদীর সংশ্লিষ্টতার দাবি কানাডার সংবাদমাধ্যমের ,‘হাস্যকর’ দাবি ভারতের
পাকিস্তানে যাত্রীবাহী গাড়িতে গুলি, নিহত ৪২
এক সপ্তাহে রিজার্ভ বাড়ল ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার
ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক সংঘাতে পরিণত হচ্ছে : পুতিন
মুরগি-সবজিতে কিছুটা স্বস্তি, আলু এখনো চড়া
নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা, যা বলল যুক্তরাষ্ট্র
মার্কিন শ্রম প্রতিনিধি দল ঢাকা আসছে আজ
পার্থে শুরুতেই চাপে ভারত
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা
সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়ার সঙ্গে জামায়াত আমীরের কুশল বিনিময়
সিঙ্গেল সিটের দাবিতে গভীর রাতেও হলের বাইরে ছাত্রীরা
ইসরাইলি হামলায় গাজায় নিহতের সংখ্যা ৪৪ হাজার অতিক্রম করলো
ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন অ্যার্টনি জেনারেল পাম বন্ডি
‘আ.লীগকে রাজনীতিতে সুযোগ দেওয়া মানে শহীদদের সঙ্গে গাদ্দারি করা’
বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত