ঢাকা   শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ | ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

কিংবদন্তি ভাষাসৈনিকের বিদায়

Daily Inqilab সৈয়দ ইবনে রহমত

২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৪ এএম

মহান ভাষা আন্দোলনের অকুতোভয় সৈনিক, খ্যাতিমান সাংবাদিক ও দৈনিক ইনকিলাবের ফিচার সম্পাদক অধ্যাপক আবদুল গফুর ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। ২৭ সেপ্টেম্বর শুক্রবার দুপুর ২টা ৪০ মিনিটে রাজধানীর আজগর আলী হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন এই কিংবদন্তি ভাষাসৈনিক। তাঁর মৃত্যুতে দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন গভীর শোক প্রকাশ করে বলেছেন, ‘ভাষাসৈনিক অধ্যাপক আবদুল গফুর ছিলেন আমাদের চেতনার বাতিঘর, আমাদের অভিভাবক, দৈনিক ইনকিলাবের রতœ, দেশের রতœ। তাকে হারিয়ে আমরা আমাদের অভিভাবককে হারিয়েছি। অধ্যাপক আবদুল গফুর আমাদের রোল মডেল ছিলেন। তিনি সৎ, আদর্শ এবং প্রকৃত অর্থে একটি ডিসিপ্লিন লাইফের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তার সংস্পর্শে, সহচার্যে আমরা অনেক ঋদ্ধ হয়েছি। তার চলে যাওয়া আমাদের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।’ ইনকিলাব সম্পাদকের এই মন্তব্য একমাত্র তারাই অনুধাবন করতে পারবেন, যারা ন্যূনতম সময়ের জন্য হলেও তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছেন। করোনাকাল শুরুর পর থেকে তিনি আর অফিসে আসতে পারেননি, তবে যতদিন সম্ভব হয়েছে লিখে গেছেন। ৯০ বছরের জীবন পার হয়ে যাওয়ায় বয়সের ভারে ন্যূজ্ব হয়েও জাতিকে দিকনির্দেশনা দিতে প্রতিসপ্তাহে অন্তত একটি লেখা লিখে গেছেন। আর এসব লেখা লিখে অফিসে পাঠিয়েছেন, সেসব নিয়ে নিয়মিত কথা হতো তাঁর সাথে। কথা-কাজে যেমন সরল, তেমনি সততার অনন্য দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি।

১৯২৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি বৃহত্তর ফরিদপুরের রাজবাড়ির দাদপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। ৯৫ বছর সাত মাসের জীবন অতিক্রম করে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। জীবনের শেষ কয়েকটি বছর বার্ধক্যজনিত নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত ছিলেন, হাঁটা-চলা করতে পারতেন না। স্মৃতিশক্তিও এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। ২০২২ সালে তাঁর জন্মদিনে ইনকিলাবের পক্ষ থেকে সিনিয়রদের সাথে যখন বাসায় গিয়েছিলাম, তখন শুরুতে অনেককে চিনতে পারছিলেন না। তবে একটু পর একে একে তাঁর স্মৃতিগুলো মনে পড়তে শুরু করে। নাম ধরে কাছে ডাকতে লাগলেন। নানা স্মৃতির কথা বলে গেলেন। এমনকি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন এবং ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিও আওড়ে গেলেন। সেই সময়ের অনেক সহকর্মীর নাম ধরেও নানা কথা বলেন। স্বজনদের কাছে শুনলাম, সকাল হলেই পত্রিকা এসেছে কিনা খোঁজ করেন। না পেলে রাগ করেন। ম্যাট্রিকুলেশন এবং ইন্টারমিডিয়েটে স্ট্যান্ড করা ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়ে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনের ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সেই তিনি শেষ জীবনে নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিলেন। আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনের বিশেষ সক্রিয় কর্মী ছিলেন তিনি। অথচ, রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে কেউ কোনো খোঁজ-খবরও নেননি।

২০২১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে এই নিবন্ধকারকে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মৌলিক ভিত্তি দুটি। একটি হলো ইসলাম এবং অন্যটি বাংলা ভাষা;...। এর কোনো একটিকে বাদ দিয়ে এদেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা ভবিষ্যতে কঠিন হবে। আমাদের রাজনীতিবিদ এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের এটা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে।’ বাস্তবেও তাই। কারণ, এই ভূখ-ে ইসলাম না থাকলে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হতো না। আর পাকিস্তান না হলে আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ নামের কোনো রাষ্ট্রের অস্তিত্বও পৃথিবীর মানচিত্রে থাকতো না। ছাত্র জীবন থেকেই তিনি এটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে এসেছেন এবং সেটা লালন করেছেন জীবনের প্রতিটি কাজে-কর্মে। তা বাস্তবায়নের জন্যও নিরন্তর সংগ্রাম করেছেন; কখনো সংগঠক হিসেবে, কখনো লেখনীর মাধ্যমে, কখনো বক্তৃতার মাধ্যমে এই জাতিকে তার অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে সদা জাগ্রত রাখার চেষ্টা করেছেন।

১৯৮৬ সালের ৪ জুনে প্রকাশিত দৈনিক ইনকিলাবের শুরু থেকেই তিনি ফিচার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ইনকিলাবে তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছি ২০০৮ সালের ৮ নভেম্বর থেকে। তখন থেকেই দেখে এসেছি, একজন মানুষের পক্ষে চিন্তা-চেতনায় যতটা সহজ-সরল-স্বচ্ছ হওয়া যায় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তিনি। নিরহঙ্কারী, নির্লোভ একজন সাদা মনের মানুষ বলতে আসলেই আমরা যা বুঝি বা চিন্তা করি, তিনি তারই বাস্তব উদাহরণ। যারা তাঁর সান্নিধ্য পাননি কিংবা তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন-সংগ্রামের ইতিহাস জানেন না, তাদের পক্ষে এটা আসলেই বুঝা কঠিন। তাঁর সহকর্মীদের ওপর তিনি কখনো রাগান্বিত হয়েছেন, সেটা কখনো দেখিনি। নিজের জীবনের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব নিয়েও কখনো চিন্তা করতে দেখিনি। নানা সময় দুশ্চিন্তা আর হতাশার বিষয় নিয়েও তাঁর পাশে বসলে সব দূর হয়ে যেত নিমিষেই।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের চূড়ান্ত সফলতা আসে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এ দিন ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধা ও সহযোগী ভারতীয় বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। এর ফলে নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের অবসান হয়, অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের। কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস শুধু এই নয় মাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর পেছনে বিস্তৃত আছে দু’শতাধিক বছরের লাগাতার আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস। ১৭৫৭ সালের পলাশীর প্রান্তরে এক প্রহসনের যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের পর থেকে উপমহাদেশের ইংরেজ শাসনের সূত্রপাত। সেই থেকে তাদের শাসন-শোষণের শিকল থেকে মুক্ত হতে ধারাবাহিকভাবে মুসলমানরা যুদ্ধ-সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে। এরই চূড়ান্ত পরিণতি আসে ১৯৪৭ সালে ভারত এবং পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন দেশের অভ্যুদয়ের মাধ্যমে। শুরু থেকে ইংরেজবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব মুসলমানরা দিয়ে এলেও এক পর্যায়ে তারা বুঝতে পারে, ইংরেজদের হটিয়ে উপমহাদেশে ভারতীয়দের শাসন প্রতিষ্ঠা করা গেলেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠি হিন্দুদের কাছে মুসলমানদের স্বাধীনতা নিরাপদ হবে না। কিছু হিন্দু নেতার উগ্রপন্থা মুসলমানদের অস্তিত্ব বিনাশের কারণ হয়ে উঠতে পারে, যার বাস্তব আলামতও তখন দেখা যাচ্ছিল বিভিন্ন স্থানে। এই অবস্থায় মুসলিম নেতৃবৃন্দ নিজেদের জন্য আলাদা স্বাধীন ভূখ-ের দাবি তোলে। সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে পাকিস্তানের জন্ম।
পাকিস্তানের জন্ম কোনো সহজ কাজ ছিল না। তার জন্য দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়েছে মুসলমানদের। সেই পাকিস্তান আন্দোলনের একজন একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন (তৎকালীন মাদরাসা ছাত্র) অধ্যাপক আবদুল গফুর। তিনি তখন ফরিদপুর ময়েজ উদ্দিন হাই মাদরাসার ছাত্র ছিলেন। সেখান থেকে পাকিস্তান আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার স্মৃতিচারণ করে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মাদরাসায় আমার সিনিয়র ছাত্র ছিলেন হাফেজ মতিউর রহমান, এনামুল হক প্রমুখ। তারা পাকিস্তান আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। তারা আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। মাদরাসার হোস্টেলে থাকতাম, ...। সেখানেই তাদের সাথে পাকিস্তান আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি। নিয়মিত মিছিল-মিটিংয়ে যোগ দিতাম। ফরিদপুরের হালিমা জুনিয়র গার্লস মাদরাসায় একবার পাকিস্তান আন্দোলনের নেতাকর্মীদের নিয়ে দুই সপ্তাহের একটা ক্যাম্প হয়েছিল। সেখানে পাকিস্তান আন্দোলন কেন প্রয়োজন সে সম্পর্কে নেতৃবৃন্দ আমাদের লেকচার দিতেন। বিশেষ করে, বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের জেনারেল সেক্রেটারি আবুল হাশিম প্রতিদিন সন্ধ্যায় বক্তৃতা করতেন। তার তীক্ষè যুক্তিযুক্ত বক্তব্য শুনে শুনেই আমরা তখন পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ি।’ ‘সিলেট রেফারেন্ডামের সময় সেখানে গিয়েছিলাম। আমার চাচাত ভাই ইসাহাক আলীর সাথে আমি গিয়েছিলাম। মুসলিম লীগের আরো অনেক নেতাকর্মীও গিয়েছিলেন। আমাদের কাজ ছিল, সেখানকার মুসলমানরা যেন পাকিস্তানের সাথে থাকার ব্যাপারে ভোট দেয় সে জন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করা।’

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট স্বাধীন হলো পাকিস্তান। পাকিস্তান একটি রাষ্ট্র হলেও এর ভূখ- ছিল দুটি। একটি পশ্চিম পাকিস্তান, অন্যটি পূর্ব পাকিস্তান (যা আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ)। পাকিস্তান আন্দোলন সফল করার পেছনে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অবদান বেশি হলেও পাকিস্তান রাষ্ট্রে তারা হয়ে পড়ে অবহেলিত। রাজধানী, সেনা-নৌ-বিমান বাহিনীর সদর দপ্তরসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সকল অফিস-আদালত স্থাপিত হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। তখন পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস ছিল পূর্ব পাকিস্তানে উৎপাদিত পাট। কিন্তু এই পাটের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থের অধিকাংশ ব্যয় হতে লাগল পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে। শিক্ষা, চাকরিসহ অন্যান্য মাধ্যমেও পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রাধান্য ছিল। ফলে তারা সার্বিকভাবেই পূর্ব পাকিস্তানি বাঙালিদের দাবিয়ে রাখতে চেষ্টা করত। আর প্রথম ধাক্কাটা আসে আমাদের মাতৃভাষার ওপর। পাকিস্তানের বৃহত্তর জনগোষ্ঠির মাতৃভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে তারা উর্দুকে একমাত্র রাষ্টা ভাষা করার পাঁয়তারা চালায়। শিক্ষিত বাঙালিরা বুঝতে পারে, মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করা না গেলে তাদের মুক্তি কোনো দিনই সম্ভব হবে না।

শুরু হয় বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন। সেই আন্দোলনের সূচনা করে তমদ্দুন মজলিস নামের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। তমদ্দুন মজলিস প্রতিষ্ঠার অল্পদিনের মধ্যেই এতে যোগ দেন অধ্যাপক আবদুল গফুর। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র। এক পর্যায়ে ভাষার আন্দোলনের মুখপাত্র হিসেবে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকা। সেই পত্রিকার শুরুতে সম্পাদক ছিলেন কথাসাহিত্যিক শাহেদ আলী আর সহকারী সম্পাদক ছিলেন অধ্যাপক আবদুল গফুর। পরে শাহেদ আলী সরকারি চাকরি নিয়ে ঢাকার বাইরে চলে গেলে পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব নেন অধ্যাপক আবদুল গফুর। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে তিনি সৈনিক পত্রিকার সম্পাদকের গুরুদায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া আন্দোলনের নানা পর্যায়ে সাংগঠনিক কার্যে ব্যস্ততার কারণে স্নাতক পরীক্ষার কয়েক মাস আগে পড়াশোনা ছেড়ে দেন। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে সার্বক্ষণিক সম্পৃক্ত থাকেন ভাষা আন্দোলনে।

’৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা নিয়ে পরের দিন সৈনিক পত্রিকার তিনটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর সম্পাদনাতেই। এসব কারণে তৎকালীন সরকার তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করে। তাঁকে এবং তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবুল কাসেমকে গ্রেফতার করার জন্য আজিমপুরের সৈনিক পত্রিকার অফিস ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে পুলিশ ঘেরাও করে। অধ্যাপক আবুল কাসেমের বাসা কাম মজলিসের অফিস থেকে তাঁরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। এর পর বেশ কয়েক মাস দেশের বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে থাকতে হয়। ভাষা আন্দোলনের সফলতার পথ ধরেই পরবর্তীতে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয় এবং বাংলা ভাষা রাষ্ট্রাভাষার মর্যাদা পায়। পরবর্তী প্রতিটি আন্দোলনই ছিল এই ভাষা আন্দোলনের সফলতা থেকে উৎসারিত প্রেরণা-শক্তি দ্বারা সঞ্চালিত, যার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি ঘটে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে।

ভাষা আন্দোলনের পরে রাজনৈতিক কর্মকা- থেকে সরে গিয়ে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন অধ্যাপক আবদুল গফুর। এক পর্যায়ে ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করে করে নতুন করে কর্মজীবন শুরু করেন। এমএ পাস করার পর প্রথমে চট্টগ্রাম জেলা সমাজ কল্যাণ কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি নেন। কিন্তু সরকারি চাকরির পরিবর্তে স্বাধীন অধ্যাপনা পেশাকে বেশি সম্মানের মনে করতেন তিনি। সে কারণেই সরকারি চাকরি ছেড়ে প্রথমে যোগ দেন ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে (১৯৬৩-১৯৭০) ও পরে ঢাকার আবুজর গিফারী কলেজে (১৯৭২-১৯৭৯) অধ্যাপনা করেছেন ১৭ বছর। স্বাধীনতার পূর্বে ও পরে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। ১৯৫৯ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ-এর আদি পূর্বসূরী দারুল উলুম (ইসলামিক একাডেমি)-এর সুপারিন্টেন্ডেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০ থেকে ৮৯ সাল পর্যন্ত ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের প্রকাশনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

তাঁর সাংবাদিকতার শুরু হয়েছিলো ১৯৪৭ সালে পাক্ষিক জিন্দেগীতে। এরপর সাপ্তাহিক সৈনিক (১৯৪৮-১৯৫৬) পত্রিকায় প্রথমে সহ-সম্পাদক এবং পরবর্তীতে সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৭ সালে দৈনিক মিল্লাত এবং ১৯৫৮ সালে দৈনিক নাজাত-এ সহকারী সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দৈনিক আজাদ-এর বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর ইংরেজি ডেইলি পিপল (১৯৭২-১৯৭৫)-এ এবং দৈনিক দেশ (১৯৭৯ - ১৯৮০)-এ সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ফিচার সম্পাদক হিসেবে তিনি কর্মরত ছিলেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত।

এই বিশাল কর্মময় জীবনে তিনি বাংলা ও ইংরেজিতে অনেক বই লিখেছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও ইসলাম, বিপ্লবী উমর, কর্মবীর সোলায়মান, Social Welfare, Social Services,, কোরআনী সমাজের রূপরেখা, ইসলাম কি এ যুগে অচল, ইসলামের জীবন দৃষ্টি, রমজানের সাধনা, ইসলামের রাষ্ট্রীয় ঐতিহ্য, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, শাশ্বত নবী অন্যতম। তাঁর রচিত শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, খোদার রাজ্য, স্বাধীনতার গল্প শোনো ও আসমান জমিনের মালিক। এ ছাড়াও তার আত্মজৈবনিক গ্রন্থ আমার কালের কথা-১ প্রকাশিত হয়েছে। এখনো অনেক লেখাই অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। ভাষা আন্দোলনের অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৫ সালে পেয়েছেন একুশে পদক।

অধ্যাপক আবদুল গফুরের চলে যাওয়া ইনকিলাবের জন্য অনেক বড় ক্ষতি। জাতির ক্ষতি হয়েছে আরো বেশি। এই ক্ষতি পূরণ হবে না। আমরা তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

মানসিক সুস্থতায় কর্মবিরতি
মুনতাহার মর্মান্তিক মৃত্যু এবং কিছু কথা
ট্রাম্পের বিজয়ে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার কি কোনো লাভ হবে?
ব্যাটারিচালিত রিকশা-অটোচালকদের তাণ্ডব রুখতে হবে
স্মৃতির দর্পণে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী
আরও

আরও পড়ুন

বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ

বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ

কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার

কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার

প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ

প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ

বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত

বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত

উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ

উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ

গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস

গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস

শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে

শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে

চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক

চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক

পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া

পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া

ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব

ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব

লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু

লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু

ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল

ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল

‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’

‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’

প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের

প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের

প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া

প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া

মুসলিম চিকিৎসক

মুসলিম চিকিৎসক

শীর্ষে দিল্লি

শীর্ষে দিল্লি

সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা

সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা

ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা

ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা

বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান

বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান