বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন জরুরি
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম
১৬ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়া গ্রাম গোমতী নদীর বাঁধ ভাঙ্গার স্থলটি পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। আশ্রয় শিবির থেকে মানুষজন চলে গেলেও নদীর বাঁধে এখনও বহু মানুষ কাপড় বা পলিথিনের তাবু টাঙিয়ে পরিবার নিয়ে অবস্থান করছে। তাদের সাথে পালিত গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগীও দেখতে পেলাম। আশ্রয় শিবিরে খাবার মেলে কিন্তু এখানে সবই রান্না করে খেতে হয়। আমি যখন যাচ্ছিলাম সবাই দুপুরের রান্নার কাজে ব্যস্ত। ঝিরঝির বাতাসে রান্না করা খাবারের গন্ধ ছড়াচ্ছে। পানি সরে যাওয়া স্বত্ত্বেও অনেকেই বাড়ি যাচ্ছে না। তাদের সঙ্গে মতবিনিময়ে জানা গেল, পানি সরে গেলেও ঘরের কোন চিহ্নই তাদের নেই। কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা জানান, কুমিল্লা জেলায় মোট আট হাজার ৬৭৪টি বাড়িঘর পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভয়াবহ বন্যায় এসব বাড়িঘরের বেশিরভাগই বানের স্রোতে ভেসে গেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বুড়িচং উপজেলায়। মোট চার হাজার ১৪৩টি ঘর পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কুমিল্লা সদর উপজেলা, চৌদ্দগ্রাম, মনোহরপুর উপজেলায় প্রায় তিন হাজার ঘরবাড়ি পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাকী উপজেলাগুলোতে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির সংখ্যা ৭৪ হাজার ৮১টি। টাকার অংকে এক হাজার ৮৪ কোটি ১৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। বন্যার পানি কমার সাথে সাথে নিজ বসতবাড়িতে ফিরতে শুরু করেছে অনেকেই। বন্যা পরবর্তী এলাকায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো পুনর্বাসনের কাজ। দেখতে পেলাম, পানি কমার সাথে সাথে পূর্বের ন্যায় মানুষ সাহায্য আর পাচ্ছে না। এখন তাদের আর কেউ খোঁজ খবর রাখছে না। বেশ কিছু বাড়ি আছে বন্যার পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। এরা ত্রাণ ঠিকই পেয়েছে। কিন্তু গৃহ মেরামতের সাহায্য পাচ্ছে না। বুড়ুবুড়িয়া, শিকারপুর, খাড়াতাইয়া ও মহিষমাড়া গ্রামে বিল্ডিং ছাড়া বেশির ভাগ গৃহ যাদের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা মেরামতে অনেকের কিন্তু সামর্থ্য নেই।
বসতবাড়ি এখনও কর্দমাক্ত, তাই গৃহ মেরামতে সমস্যা। তাছাড়া অর্থের সংস্থান কোথা থেকে হবে? একজন মহিলা জানান, সরকারিভাবে তালিকা হয়েছে। কিন্তু গৃহ মেরামতের আদৌ কোনো সাহায্য আসবে কিনা তা আমরা অবগত না। সরকারের পক্ষ থেকে গৃহ মেরামতের ঘোষণা থাকলে ওদেরকে এতটা ভাবনায় পড়তে কি হতো?
রাস্তাগুলোর অবস্থা এতটাই করুণ যে, স্বাভাবিক চলাচল করতেও সমস্যা হচ্ছে। রাস্তার মাঝখানে বিশাল বিশাল গর্ত দেখতে পেয়েছি। পায়ে হাঁটাও দুষ্কর। অনেকের মূল্যবান গাছগাছালি মূলসহ বানের পানিতে উপড়ে গেছে। বুড়বুড়িয়া গ্রামের একজনের ৫০০টি পেঁপে গাছের বাগান ছিল, এখন বাগানের কোনো চিহ্নই অবশিষ্ট নেই। এভাবে অনেকের শাকসবজি নষ্ট হয়েছে, কৃষকের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, কুমিল্লা জেলায় মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ এক লাখ ৩৫ হাজার ২৩৮ হেক্টর, যার মধ্যে ৬৩ হাজার ৯৭৪ হেক্টর ফসলি জমি সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে কৃষকদের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৮০০ কোটি টাকা হবে। ফসলের মাঠে আরেক সমস্যা দেখা দিয়েছে। কয়েকদিন আগেও ফসলের সবুজের সমারোহ ছিল। ভালো ফলন হবে, এমন আশায় স্বপ্নের দিন গুনছিল কৃষকরা। কিন্তু বন্যার পানিতে সব ফসল বিনষ্ট হয়েছে। পানি নামার পর দেখা দিয়েছে নতুন সমস্যা। মাঠের পর মাঠ ঢেকে গেছে নদীর বালির স্তূপে। নিচু জমিতে বালির ঢিবি তৈরি হয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় বালিতে জমির আইলও ঢেকে গেছে। বালির স্তূপ না সরালে জমি চাষাবাদ সম্ভব নয়। দুশ্চিন্তায় কৃষকের মাথায় হাত। জমি চাষাবাদযোগ্য করতে হলে সরকারি সাহায্য প্রয়োজন। কারণ, জমিতে দেখা যাচ্ছে তিন থেকে চার ফুট বালির স্তূপ। এগুলো অপসারণ করা না হলে আগামী ১৫/২০ বছরেও এসব জমি চাষযোগ্য হিসেবে তৈরি করা যাবে না।
সবাই কিন্তু আমন রোপণের কাজ শেষ করেছিল। রোপণকৃত আমন ধান একেবারে বিনাশ হয়ে গেলেও নতুন করে বীজতলা করা সম্ভব হচ্ছে না। কৃষকদের ভাষ্যমতে, সংরক্ষণে বীজধান নেই। তাছাড়া বীজ বপন করে চারা গজাতে গজাতে আমনের সিজন শেষ হয়ে যাবে। তাই অনেক কৃষককে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে ধানের চারা অধিক মূল্যে সংগ্রহ করতেও দেখা যাচ্ছে। এ সংখ্যা ৫ শতাংশ হতে পারে। ৯৫ শতাংশ কৃষক এবার বন্যার জন্য আমন চাষ করতে পারবে না। না পারার অন্যতম কারণ জমিতে বানের পানি না সরার কারণে রোপণ করা যাবে না। খাল ভরাট হয়ে বহুপূর্বে পানি নামার রাস্তা বন্ধ। খালের উপর অনেকে বাড়িঘর, দোকান তৈরি করে খাল দখলে নিয়েছে। জমিতে পানি থাকার কারণে আমন রোপণ করা যাচ্ছে না। তাই শ্রম বাজারও নিষ্ক্রিয়। ব্রাক্ষ্মণপাড়া উপজেলার কংশনগর বাজারে শ্রম বিক্রির হাট বসত। বাজারে শ্রম হাটে এখন শ্রমিক শূন্য দেখা যাচ্ছে। স্থানীয়রা জানায়, এ সময়টায় গত বছরও ভোরের আলো ফুটতেই শ্রমিক ও গৃহস্থদের উপস্থিতিতে এ হাট সরব থাকতো। কৃষি শ্রমিকেরা গোমতী ব্রিজের দুই পার্শ্বে জটলা বেঁধে বসে থাকতো। গৃহস্থরা দরদাম করে নিয়ে যেত। গোমতী ও সালদা নদীর বাঁধ ভাঙ্গার কারণে পানিতে তলিয়ে আছে চাষযোগ্য জমি। অলুয়া, চন্ডিপুর, মনোহরপুর, মালা পড়া ও আসাদনগর গ্রামে দেখা গেল এখনো জমিতে কোমর সমান পানি। সবাই মাছ ধরায় ব্যাস্ত। পানি নামতে নামতে আমন রোপণের দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। মাঠ আমন চাষ বিহীন থাকার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফসল বিহীনে কৃষকদের অবস্থা আরও জটিল হবে। নিশ্চিত খাদ্যাভাব দেখা দেবে।
জেলার মৎস্য ও পশুসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় পোল্ট্রি ও হাঁসমুরগির খামার আছে ১৩ লাখ ৬৬ হাজার। সবগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, মারা গেছে ১০ লাখ ২২ হাজার মুরগি ও দুই হাজার হাঁস। বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়া গ্রামের একজনের ৬টি মুরগির খামার ছিল। তার ১২ হাজার লেয়ার মুরগি ছিল খামারে। তিনি ৭ বছর পূর্বে সৌদি আরবের প্রবাস জীবন শেষ করে সামান্য পুঁজি নিয়ে পোল্ট্রি ব্যবসায় নেমেছিলেন। একটি একটি করে ৬টি খামার প্রতিষ্ঠা করেন। ব্যাংক থেকে ৪০ লক্ষ টাকা ঋণও নেন। দুটো দুতলা শেট বিল্ডিং ফার্মের জন্য করেন। যে জায়গায় গোমতীর বাঁধ ভেঙেছে তার আশেপাশেই খামারগুলো ছিল। তার খামারে ৬ জন কর্মচারী এবং তার ইন্টার মিডিয়েট পাস করা দুই সন্তানও খামারে কাজ করতো। এ খামার থেকে প্রতিদিন ১০ হাজার ডিম সংগৃহীত হতো। প্রতিমাসে যাবতীয় খরচ বাদ দিয়ে দুই লক্ষ ৫০ হাজার টাকা লাভ হতো। খামারের শেটগুলো দুমড়ে মুচড়ে ধ্বংস করে ফেলেছে বন্যার পানি। মনে হবে যেন ভয়াবহ টর্নেডো বয়ে গেছে তার খামারে। জীবন বাজি রেখে প্রবল বন্যার মধ্যেই ৬০০ মোরগ উদ্ধার করতে পেরেছিলেন। সংরক্ষণের অভাবে তা ১০০ টাকা পিস বিক্রি করতে হয়েছে। বাকী সব মোরগ পানি ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তার যা ক্ষতি হয়েছে তার ভাষ্য অনুযায়ী ২ কোটি ১০ লাখ টাকা। যদি ব্যাংক থেকে আবার ঋণ না পান তাহলে দাঁড়াতে পারবেন না। এ রকম অবস্থা হয়েছে অনেকের।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তার তথ্য অনুযায়ী, ২৩ হাজার ৪২টি মৎস্য খামার (দিঘি, পুকুর ও মাছের ঘের) পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে। খামারগুলো তলিয়ে যাওয়ায় খাল, বিল, জলাশয়ে এখন মাছ ধরার উৎসব চলছে। প্রচুর পরিমাণে ৪ ও ৬ ইঞ্চি আকারের রুই, কাতল, মৃগলের পোনা মৎস্য শিকারীর জালে উঠতে দেখেছি। বন্যায় প্লাবিত পুকুর ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। শিকারপুর গ্রামের এক ব্যক্তির ভাষ্যমতে, তার ৩টি পুকুর ছিল, প্রায় ২ লক্ষ টাকার বিভিন্ন প্রজাতির পোনা মাছ ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তার পুকুর সংস্কার করা প্রয়োজন। পাড় বাঁধাই করে ফিটকারী ও চুন দিয়ে পানি শোধন করতে হবে। পানি নিষ্কাশন করে রাক্ষসী মাছ নির্মূল করা প্রয়োজন। তারপর মৎস্য চাষে আবার ফিরে যাওয়া যাবে। এ কাজ সময় সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, মৎস্য খাতে খামারিদের ৫০০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। এদেরকে ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়া না হলে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।
বন্যার পানি নামার সাথে সাথে যখন বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছে বানভাসি মানুষেরা, তখনই দেখা দিয়েছে তীব্র গরম। শুরু হয়েছে বিদ্যুৎ সংকট। মারাত্মক লোডশেডিং। প্রতিদিন ১৪/১৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিহীন অবস্থা। এতে পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় বিঘœ হচ্ছে।
কুমিল্লা বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শনে মনে হলো, পুরো এলাকাকে কমপক্ষে ৬ মাস নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা দরকার। কৃষকরা যাতে তার জমিগুলো চাষাবাদযোগ্য করতে পারে, সেজন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারিভাবে সাহায্য করা না হলে এ জমিগুলো চাষাবাদযোগ্য করতে ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ হবে। গৃহহীনদের তালিকা যেহেতু হয়েছে, যারা এখনও নদীর বাঁধে অবস্থান করছে তাদের ঘরগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তৈরি করে দিতে হবে। যারা আমন ফসল রোপণ করতে পারবে না সেই পরিবারগুলিকে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় আনা যেতে পারে। পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা স্বরূপ সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।
লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট
mizannurrhman 207@ gmail.com
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস
শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া
ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল
‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’
প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের
প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া
মুসলিম চিকিৎসক
শীর্ষে দিল্লি
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান