ভারত বিএনপির কাছে কী চায়?
০৯ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০২ এএম
গত ২২ সেপ্টেম্বর ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতে দুই দেশের মধ্যে শক্তিশালী সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকের পর বিএনপি মহাসচিব সাংবাদিকদের বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে সম্পর্ক রয়েছে, সেই সম্পর্ক আরও কীভাবে গভীর করা যায়, সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের সাথে ভারতের যে সমস্যাগুলো রয়েছে, আমরা সেগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি। তিনি বলেছেন, আমরা ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে পানি সমস্যার সমাধানের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা বন্ধে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে বলেছি। সেই সঙ্গে সিকিউরিটির যে বিষয়টা আছে, সেটা নিয়েও কথা বলেছি। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘ভারতীয় হাইকমিশনার বলেছেন, এই বিষয়গুলোতে তারা সজাগ রয়েছেন। দ্রুততার সঙ্গে এ সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করছেন তারা।’
তাদের মূল বক্তব্য হলো, তারা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে চান। বিশেষ করে ছাত্র-জনতার বিপ্লবে ক্ষমতার পরিবর্তনের পরে নতুন যে অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে, তার সঙ্গে তারা ইতোমধ্যে যোগাযোগ করেছেন, কথা বলেছেন। বিএনপির সঙ্গেও ভারত সম্পর্ক দৃঢ় করতে চায়। এই সম্পর্কের মধ্যে কী করে আরও সুস্থতা, আরও পজেটিভিটি আনা যায়, সেটা নিয়ে তারা কাজ করতে আগ্রহী।
ভারতীয় মিডিয়া এএনআই’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মির্জা ফখরুল বলেছেন, বাংলাদেশে গত নির্বাচন থেকেই আমাদের সম্পর্কের বিষয়ে প্রশ্ন ছিল। এ সময়ে ভারতের হাইকমিশনার আমাদের অফিসে সাক্ষাৎ করেছেন। অবশ্যই এতে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। গত ১৫ বছর ধরে ভারতের সঙ্গে যেসব উদ্যোগ ও চুক্তি করা হয়েছে, তার বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিএনপি’র মহাসচিব বলেছেন, তার দল ভারতকে নিশ্চয়তা দিয়েছে যে, যদি তারা ক্ষমতায় আসে, তাহলে বাংলাদেশে ভারতের জন্য হুমকি কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনকে প্রশ্রয় দেবে না।
ভারতীয় হাই কমিশনারের বিএনপি কার্যালয়ে আসা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা এ আসাকে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন। অনেকের মতে, ভারতের সাথে বিএনপির যে শীতল সম্পর্ক, সেটা গলতে শুরু করেছে। ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর ভারত প্রকাশ্যে বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। তারা নানাভাবে বিপ্লবকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিল। প্রতি বিপ্লবের নানা চেষ্টা তারা করে আসছিল। তারা আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে প্রকাশ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। এসব কথায় তিন মাসের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করে দেওয়ার কথা ছিল। তারা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থা নিয়েছিল। বর্তমানে বিএনপি ও ড. ইউনূস সরকারের সাথে আলোচনা করলেও অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্র থেমে নেই।
ভারত কখনো বাংলাদেশের বন্ধু ছিল না। তাদের বন্ধু ছিল শুধু আওয়ামী লীগ। বিএনপি এবং ইসলামপন্থী সকল দল ভারতের কাছে শত্রু হিসেবে বিবেচিত। ভারত সব সময় বাংলাদেশে একটি দুর্বল সরকার চায়।
তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো ১৪, ১৮ এবং ২৪ এর নির্বাচন। ভারতের প্রকাশ্য মদদে এ তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ২০১৮-এর নির্বাচন ছাড়া অন্যগুলোতে বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। একদলীয় নির্বাচনকে বৈধতা দিতে ভারত হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে নির্বাচনে যেতে বাধ্য করেছিল। দেশে দুর্বল সরকার থাকায় ভারত ইচ্ছামত বাংলাদেশকে শোষণ করেছে। নিজেদের শতভাগ স্বার্থ আদায় করে নিয়েছে। দুর্বলতার সুযোগে ভারত ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে দিয়ে বাংলাদেশকে একটি অঘোষিত কলোনিতে পরিণত করেছিল।
পতনের পর গোটা বিশ্বের কাছে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ একটি ফ্যাসিস্ট দল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। অথচ এই দলটিকে মাঠে ফিরিয়ে আনতে আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছে ভারত। আজ হোক, কাল হোক, ভারতের নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হবে বলে অনেকে মনে করছেন। বর্তমানে তারা হাসিনা ও মোদি ড. ইউনূস সরকারকে ব্যর্থ করতে বিরামহীন প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। পাশাপাশি মন্দের ভালো একটি সরকারকে ক্ষমতায় আনতে পরিকল্পনা কষছে। এক্ষেত্রে, ভারত বিএনপিকে টার্গেট করেছে। এ উপলক্ষেই ভারতের রাষ্ট্রদূতের বিএনপি কার্যালয়ে আসা বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।
বর্তমানের অন্তর্বর্তী সরকার দেশ চালালেও জনমনে স্বস্তি ফেরেনি। আইন-শৃঙ্খলার কাক্সিক্ষত উন্নতি হয়নি। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসেনি। উপদেষ্টাদের মাঝে সমন্বয় দেখা যাচ্ছে না। তাদের মধ্যে মতবিরোধ পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে এখনও অন্তর্বর্তী সরকারের জনসমর্থন আছে। বলা বাহুল্য, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও দেশের সংকট কাটেনি। কারণ, সকল সেক্টরে শেখ হাসিনার প্রেতাত্মারা রয়ে গেছে। বর্তমান সরকারকে নেপথ্যে তারাই পরিচালনা করছে। দেশের সকল বিভাগে নব্বই শতাংশ কর্মকর্তা ও কর্মচারী আওয়ামী সরকারের অনুসারি। সচিবালয় ও সেনাবাহিনীর কিছু সেনাকর্মকর্তা ভারতপন্থী। হাসিনার পতনের পর ৬২৬ জন আওয়ামী লীগের নেতাকে তারা ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় দিয়েছিল। তাদের অনেকেই ভারতে পালিয়ে গেছে। ভারত এখন আওয়ামী নেতাদের সেকেন্ড হোম। আওয়ামী নেতাদের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে ভারতের বিভিন্ন হোটেল ও পার্ক। কোলকাতায় যেন তারা চাঁদের হাট বসিয়েছেন। অনুমান করা হচ্ছে, সেখানে বসে তারা তাদের সরকারি আমলাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। কলাকৌশল নির্ধারণের মাধ্যমে তারা দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন। সুতরাং ভারতপন্থী সেনাকর্মকর্তা এবং জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারাই এখন দেশ পরিচালনা করছেন। তারা শেখ হাসিনাকে দেশে প্রত্যাবর্তন করাতে সুকৌশলে এগিয়ে যাচ্ছে।
হাসিনার প্রত্যাবর্তন যদিও কঠিন, তবে একেবারেই অসম্ভব নয় বলে অনেকে মনে করছেন। কারণ, দক্ষিণ এশিয়ার পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাস অনেক পুরাতন। তাদের অতীত ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে যে, পরিবারতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো দেউলিয়া হয়ে গেলেও একেবারে ধ্বংস হয়ে যায় নি। কাজেই, অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম যদি স্থবির হয়ে পড়ে, তাহলে শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের সুযোগ বাড়বে।
অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্কারে মনোনিবেশ করেছে। কারণ, ফ্যাসিস্ট হাসিনা দীর্ঘ ষোল বছরে দেশের গোটা শাসনযন্ত্র দলীয়করণ করেছে। এটি সংস্কার ছাড়া সামনে অগ্রসর হলে ছাত্রজনতার বিপ্লব নিরর্থক হয়ে যাবে। দেশের প্রশাসনে ঘাঁপটি মেরে থাকা ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও ভারতের দোসররা এ সংস্কার কাজে বাধা দিচ্ছে। তারা হেন প্রচেষ্টা নেই, যা করছে না। তারা সরকারকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তারা নীরবে প্রতিবিপ্লবের পথ তৈরি করছে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি না হলে মানুষ ধৈর্য হারাবে। এমন প্রেক্ষিতে, ভারত বিএনপিকে ফাঁদে ফেলতে চাইছে। বিএনপির উচিৎ হবে, ভারতের সেই ফাঁদে পা না দেয়া।
বিএনপির উচিৎ, চারদলীয় জোটের মতো শক্তিশালী জোট গঠন করে আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে একটি শক্তিশালী সরকার গঠন করা। তাতে একদিকে সরকার শক্তিশালী ও টেকসই হবে। অন্যদিকে, ভারতের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক হবে।
লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
Email: [email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস
শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া
ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল
‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’
প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের
প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া
মুসলিম চিকিৎসক
শীর্ষে দিল্লি
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান