ঢাকা   শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ | ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

গাজা-লেবাননে গণহত্যা ইসরাইলের পতন অনিবার্য

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

১০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৪ এএম

এক বছর ধরে অবরুদ্ধ গাজাবাসির উপর প্রতিদিন শত শত টন বোমা ফেলেও হামাসকে দমাতে পারেনি আইডিএফ। এমনকি হাজার হাজার সেনা নামিয়ে স্থল অভিযান চালিয়েও হামাসের টানেল নেটওয়ার্কও ধ্বংস করতে পারেনি। প্রতিদিন বেসামরিক মানুষের উপর বোমা ফেলে হাজার হাজার শিশু-নারী ও নিরস্ত্র মানুষ হত্যায় মেতে উঠেছে ইসরাইল। গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক কিংবা বিমান হামলা করে হামাস, হেজবুল্লাহ, সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, ইয়েমেন ও ইরানের রাজনৈতিক নেতা, সামরিক কমান্ডার ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হত্যা করা ইসরাইলীদের পুরনো কৌশল। একটি ভারসাম্যহীন যুদ্ধে নির্বিচার বোমা বর্ষণ করে বেসামরিক মানুষ হত্যা করাকে যুদ্ধে পরাজয়ের একটি মনস্তাত্ত্বিক পূর্ব লক্ষণ হিসেবেই ধরা যায়। মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো সামরিক বিশ্লেষক এমনটি মনে করছেন। ইরানের বিরুদ্ধে ক্রমাগত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা, মোসাদের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করে সেখানকার বেসামরিক অ্যাকাডেমিসিয়ান, বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ ও রাজনৈতিক নেতাদের হত্যা করে ইরানকে দাবিয়ে রাখা যায়নি। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পরস্পর বিরোধী স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ রয়েছে। রাশিয়া-আমেরিকা, চীন-আমেরিকা-ভারত, আমেরিকা-কিউবা-ভেনিযুয়েলা, চীন-তাইওয়ান-হংকং ইত্যাদি আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক বিরোধে এত অ্যাসাসিনেশন বা গুপ্তহত্যা ও টার্গেটেড কিলিং হয়নি ইসরাইলের হাতে হামাস-হেজবুল্লাহ-ইরানের নেতারা যেভাবে গুপ্ত হত্যার শিকার হয়েছেন। প্রাচীনকাল থেকেই যুদ্ধের কিছু সাধারণ নিয়ম-নীতি মান্য করার বিধান রয়েছে। সম্মুখ যুদ্ধে একজন ঘোড়া থেকে পড়ে গেলে কিংবা তরবারি ভেঙ্গে গেলে বীর যোদ্ধারা নিরস্ত্র প্রতিপক্ষের উপর আক্রমণ করে হত্যা করা থেকে বিরত থাকার অনেক মহাকাব্যিক নজির আছে। চার দশক ধরে ইরানের উপর পশ্চিমা বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক অবরোধ, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেও যখন ইরানের সামরিক প্রযুক্তিগত অগ্রযাত্রা রুখতে পারছে না, তখন ইসরাইলকে দিয়ে ইরানি সামরিক-বেসামরিক ও প্রযুক্তিগত দক্ষ নেতৃত্বকে হত্যা করাকেই উৎসাহিত করেছে পশ্চিমারা। এ থেকে জায়নবাদ প্রভাবিত পশ্চিমাদের মানবিক মূল্যবোধে দেউলিয়াত্বের বহি:প্রকাশ স্পষ্টভাবে ধরা পড়ছে। অবরোধ দিয়ে হামাস-হেজবুল্লাহর মত জানবাজ প্রতিরোধ শক্তির ক্রমবর্ধমান উত্থান যেমন ঠেকানো যায়নি, একইভাবে কাশেম সুলাইমানির মত একজন অতুলনীয় দক্ষ ও প্রজ্ঞাবান সামরিক নেতৃত্বের সৃজনশীলতার বিকাশকেও ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। কাসেম সুলাইমানির বিচক্ষণতার কাছে আইএস জুজু, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধসহ সিআইএ, মোসাদ ও পশ্চিমাদের শত বিলিয়ন ডলারের সাম্রাজ্যবাদী সামরিক প্রোগ্রাম ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। ২০২০ সালের ২জানুয়ারি বাগাদাদ বিমান বন্দরে ড্রোন হামলা করে কাসেম সুলাইমানি ও ইরাকের প্রতিরোধ আন্দোলনের কমান্ডার আবু মাহাদি আল মোহান্দিসকে হত্যার পর ইরানের প্রতিরোধ আরো বেগবান হয়েছে। দামেস্কের ইরানি কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা করে আল কুদস ফোর্সের সিনিয়র কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজা জাহেদিসহ বেশ কয়েকজনকে হত্যার প্রতিক্রিয়ায় এপ্রিলের ১৪ তারিখে ইসরাইলের মাটিতে প্রথম বারের মত সরাসরি মিসাইল হামলা চালায় ইরান। এরপর গত কয়েক মাসে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া, ইয়াহিয়া সিনোয়ার, কয়েকজন ইরানি নেতা এবং সর্বশেষ হেজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা করে ইসরাইল। একেকটি হত্যাকান্ডের পর প্রতিরোধ ফ্রন্ট আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রবল শক্তিতে জায়নবাদী বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। হাসান নাসরুল্লাহ শহীদ হওয়ার পর একদিকে হামাস-হেজবুল্লাহর প্রতিরোধ অনেক বেশি শক্তিতে ইসরাইলী বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে অন্যদিকে ইরানের রেভ্যুলুশনারি গার্ড বাহিনী ইসরাইলের প্রধান সামরিক ঘাটিগুলোর উপর অকল্পনীয় ক্ষিপ্রতায় ১৮০টি হাইপারসনিক ব্যালেস্টিক মিসাইল হামলা করে সর্বাধুনিক এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানসহ ঘাটিগুলোকে ধ্বংসস্তুপে পরিনত করে। এর মধ্য দিয়ে ইসরাইলের আয়রনডোম আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তথা পশ্চিমা সামরিক প্রযুক্তির আধিপত্য প্রথমবারের মত ইরানি হামলায় ধূলায় মিশে গেছে। ইরানি সামরিক কমান্ডাররা বলেছেন, ইসরাইলের আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কাঁচের মত ভঙ্গুর।

জায়নবাদ প্রভাবিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের সম্মিলিত সামরিক-অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে ব্যবহার করে ইউক্রেনে রাশিয়াকে পরাজিত করতে বড় ধরনের বাজি রেখে চলেছে। শত শত বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা ও সর্বাধুনিক উচ্চ ক্ষমতার যুদ্ধাস্ত্র দিয়েও জেলনস্কির পতন ঠেকানো যাচ্ছে না।বিগত শতাব্দীর আশির দশক পর্যন্ত ইউক্রেন সোভিয়েত রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে পড়ার আগ পর্যন্ত বিশ্বের পরাশক্তির মধ্যে পূর্ব-পশ্চিমে একটি ভারসাম্য বজায় ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা সমাজতান্ত্রিক বলয়ের রাজনৈতিক পতনের পর ওয়ারশ’ সামরিক জোটও ভেঙ্গে যায়। স্নায়ুযুদ্ধের ঝুঁকি কমে যাওয়ার সাথে সাথে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের তৎপরতা ও সামরিক বাজেটও স্বাভাবিকভাবেই কমে যাওয়ার কথা। আদতে তা হয়নি। দুই পরাশক্তির মধ্যকার সামরিক-অর্থনৈতিক ভারসাম্য ভেঙ্গে ইউনিপোলার বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একমেরুকেন্দ্রিক বিশ্ব গড়ে ওঠার সাথে সাথে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বের উপর একচ্ছত্র সামরিক-অর্থনৈতিকস আধিপত্যবাদী শক্তি হিসেবে আর্বিভুত হয়। স্নায়ুযুদ্ধকালে গড়ে ওঠা মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের হাজার হাজার কোটি ডলারের বিনিয়োগ মুনাফাসহ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে তাদের একটি অন্তহীন যুদ্ধের বাস্তবতা টিকিয়ে রাখা প্রয়োজন ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে নতুন বিশ্ব বাস্তবতায় ইসলামোফোবিয়া এবং ইরানের ইসলামি বিপ্লবের জুজু এবং কথিত পারমানবিক হুমকির মত বিষয়গুলোকে পশ্চিমারা তাদের নতুন যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে প্রপাগান্ডার বিষয়বস্তু করে তোলে। নিউইয়র্কের বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রে নাইন-ইলেভেন বিমান হামলার সাথে ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থার জড়িত থাকার বেশ কিছু আলামত অকাট্য প্রমান হিসেবে হাজির করা হলেও সে সব ধতর্ব্যে আনা হয়নি। ঘটনার আধাঘন্টার মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ কোনো তথ্যপ্রমান ছাড়াই বিমান হামলার জন্য আলকায়েদার উপর দোষ চাপিয়ে ওয়ার অন টেররিজম শুরু করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এই যুদ্ধকে নতুন ‘ক্রসেড’ বলে অভিহিত করেছিলেন। এই যুদ্ধের মূল লক্ষ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে সন্ত্রস্ত ও বশংবদ করে রাখা এবং তাদের সাথে হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র ও নিরাপত্তা চুক্তির বিনিময়ে এক ধরণের অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তিতে আবদ্ধ করা। আরব বষন্ত ও আইএস জুজু দেখিয়ে পেট্টোডলারের আরব দেশগুলোর সাথে পশ্চিমাদের যে পরিমান সমরাস্ত্রের বাণিজ্য হয়েছে তার আগের ৫০বছরেও তা হয়নি। প্রকারান্তরে এসব সামরিক চুক্তি ও বাণিজ্যের মূল টার্গেট ছিল ইরান ও ইরান সমর্থিত প্রক্সি বাহিনীগুলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, ইসরাইলসহ পশ্চিমা বশংবদ আরব দেশগুলোর সর্বাত্মক সহায়তা নিয়ে ইরাকি নেতা সাদ্দাম হোসেন ইরানে দখলদারিত্ব কায়েম করতে ৮ বছরব্যাপী সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে সফল হতে পারেনি। ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর প্রবল প্রতিরোধের মুখে সাদ্দাম হোসেনের প্রক্সিতে ইসরাইলী ও পশ্চিমা সামরিক শক্তি চরমভাবে পরাজিত হয়। নাইন-ইলেভেনের পর শুরু হওয়া ওয়ার অন টেররিজমের চূড়ান্ত টার্গেট ছিল ইরান। ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া ও ইয়েমেনে ন্যাটো ও পক্সি বাহিনী সফল হলে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র বদলে দেয়ার জায়নবাদী নীল নকশার বাস্তবায়ন ঘটত। সে সব দেশে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী ব্যর্থ হলেও জায়নবাদীরা হাল ছেড়ে দেয়নি। উগ্র বর্ণবাদী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রতিশ্রুতি ভুলে গিয়ে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে মূলত ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা তথা দ্বিরাষ্ট্রকেন্দ্রিক সমাধানের বদলে নেতানিয়াহুকে গ্রেটার ইসরাইল গঠনের উস্কানি দিয়েছিলেন। তার আগে ইরানের সাথে ৬ বিশ্বশক্তির পারমানবিক সমঝোতা চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সে সময় মধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্রিক বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রবণতা থেকে বুঝা যাচ্ছিল, নেতানিয়াহু’র ইচ্ছাই যেন সেখানে শেষ কথা।

গত বছর সেপ্টেম্বরে ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু জাতিসংঘে বক্তৃতা দেয়ার সময় গ্রেটার ইসরাইলের মানচিত্র এবং ইরানের পারমানবিক বোমার প্রোপাগান্ডামূলক বয়ান হাজির করেছিলেন। তার আগে থেকেই আল আকসা মসজিদে ইহুদি বাহিনীর বার বার অনুপ্রবেশ এবং মুসলমান মুসল্লিদের উপর নিপীড়নের ঘটনা ঘটছিল। ফিলিস্তিনিদের জমি দখল করে নতুন নতুন ইহুদি বসতি স্থাপনের তৎপরতা ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের পর থেকেই অব্যাহত রয়েছে। একদিকে মুসলমানরা বাস্তুচ্যুত হয়ে উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নিচ্ছে অন্যদিকে ইহুদি নতুন বসতিকে ঘিরে নিরাপত্তা বেষ্টনি ও নজরদারি বেড়ে চলেছে। জাতিসংঘ ও বিশ্বসম্প্রদায়ের নিরবতায় ইসলামি রেজিস্ট্যান্স কখনো থেমে থাকেনি। গত বছর ৭ অক্টোবর হামাসের আল কাসাম ব্রিগেড ‘অপারেশন আল আকসা ফ্লাড’ নাম দিয়ে ইসরাইলের অভ্যন্তরে এক দু:সাহসী সামরিক অভিযান পরিচালনা করে কয়েক শ’ ইসরাইলীকে বন্দি করে নিয়ে যায়। সে অজুহাতেগত ১ বছর ধরে প্রতিদিন শত শত টন বোমা ফেলে গাজা উপত্যকাকে ধ্বংসস্তুপে পরিনত করার সাথে সাথে চল্লিশ হাজারের বেশি বেসামরিক নাগরিককে হত্যা ও প্রায় ১ লাখ মানুষকে আহত করেও হামাসকে ধ্বংস কিংবা দুর্বল করতে পারেনি। গাজায় যুদ্ধ শুরুর দিন থেকেই লেবাননের হেজবুল্লাহর সামরিক শাখা ফিলিস্তিন ও হামাসের সাথে সংহতি প্রকাশ করে ইসরাইলের সামরিক লক্ষ্যবস্তুর উপর নিয়মিতভাবে রকেট হামলা চালিয়ে যাচ্ছিল। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে বৈরুতে হিজবুল্লাহর কমান্ড সেন্টারকে লক্ষ্য করে বড় ধরণের বিমান হামলার মধ্য দিয়ে গাজার যুদ্ধকে লেবাননে বিস্তৃত করেছে ইসরাইল। বিশেষত হিজবুল্লাহ্র শীর্ষ নেতা হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যার মধ্য দিয়ে গাজা যুদ্ধকে একটি সর্বাত্মক আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিনত করার ঝুঁকি নিয়েছে নেতানিয়াহু। আর এই যুদ্ধোনা¥াদনার নেপথ্যে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধন। জো বাইডেন প্রশাসন ইসরাইলকে লেবাননে আগ্রাসন চালানোর সবুজ সংকেত দিয়েছিল বলে কয়েকমাস আগেই পশ্চিমা গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। বলা হয়ে থাকে, আমেরিকা যার বন্ধু তার ধ্বংসের জন্য কোনো শত্রুর প্রয়োজন হয়না। ইরানের রেজা শাহ পাহলবি, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, মিশরের হোসনি মোবারক, তিউনিসিয়ার বেন আলি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নেতানিয়াহু নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে গিয়ে ইসরাইলকে ধ্বংসের প্রান্তে ঠেলে দিয়েছেন। আর এই আত্মঘাতের মূল উস্কানিদাতা হিসেবে উঠে এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জো বাইডেন প্রশাসনের নাম। মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে দলই ক্ষমতায় থাক না কেন, ইসরাইলের তথাকথিত আত্মরক্ষার অধিকার এবং মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে কোনো হেরফের হয়নি। কমলা হারিসের অভিষেক কিংবা ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে যাই ঘটুক না কেন, সেখানকার ডিপ স্টেট পরিচালিত হয় কর্পোরেট ব্যাংকার ও জায়নবাদী লবির প্রভাবে।

বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাস হাজার হাজার বছরে প্রবল প্রতাপশালী সাম্রাজ্যসমুহের উত্থান-পতনের ইতিহাস। গ্রীক সাম্রাজ্য, রোমান সাম্রাজ্য, পারস্য সাম্রাজ্য, মোঘল, অটোমান ও বৃটিশ সাম্রাজ্যের উত্থান পতনের দীর্ঘ ইতিহাসে অনেক চড়াই-উৎরাই, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামরিক ঘটনার ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে জায়নবাদের নোংরা ও অতি হিংস্র সামরিক নেক্সাস ও একটি জনগোষ্ঠির উপর ধারাবাহিক গণহত্যার এমন পৈশাচিক ইতিহাসের নজির আর একটিও নেই। কোনো রকম মানবিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক কিংবা সামরিক নিয়ম-নীতি ছাড়াই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদতে দশকের পর দশক ধরে ইসরাইল ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠির উপর এথনিক ক্লিনজিং এবং তার আরব প্রতিবেশিদের উপর নির্বিচার আগ্রাসন অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঘুরে দাড়ানোর ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকে না। প্রায় এক দশকের প্রক্সি যুদ্ধে সিরিয়াকে ধ্বংসস্তুপে পরিনত করেও বাশার আল আসাদ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে না পারলেও মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র বদলে দিয়ে গ্রেটার ইসরাইল গঠনের স্বপ্নে বিভোর নেতানিয়াহু হাজার হাজার টন বোমা ফেলে গাজা উপত্যকা ধ্বংসের পর এখন লেবাননে হাত বাড়িয়েছে। সেখানে ফসফরাস বোমা ফেলে সবকিছু পুড়িয়ে দিতে শুরু করেছে। লেবাননে পোড়ামাটি নীতি নিয়ে স্থল হামলা করতে গিয়ে হেজবুল্লাহর প্রতিরোধ ও প্রত্যাঘাতে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে আইডিএফ তার এলিটফোর্স গোলানি ব্রিগেডসহ শত শত সেনা হারিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। লেবাননে আগ্রাসন জোরদার করার সাথে সাথে হামাস-হেজবুল্লাহ, ইরাকের ইসলামিক জিহাদ, ইয়েমেনের আনসারাল্লাহ হুতি গ্রুপের চর্তুমুখী আক্রমনে বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে ইসরাইল। চলমান গাজা যুদ্ধে ইসরাইলের কাছে যুদ্ধবিরতি ও ফিলিস্তিন সমস্যার শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক-কূটনৈতিক সমাধানের সুযোগ থাকলেও মুসলমানদের হাতে প্রতিরোধ-প্রত্যাঘাত ছাড়া উত্তরণের কোনো পথ নেই। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী থিঙ্কট্যাঙ্কগুলো মনে করছে, আইডিএফ হিজবুল্লাহকে ধ্বংস করতে পারলে পশ্চিমাদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ আরো সুরক্ষিত হবে। অন্যদিকে হামাস-হেজবুল্লাহ হুতিদের ধ্বংস করতে পারলে ইরানের উপর ইসরাইল ও ন্যাটো জোটের প্রক্সি আগ্রাসনের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এরপর শত বছরেও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা, আল আকসার মুক্তির চিন্তা মাথায় আনার সাহস পাবে না মুসলমানরা। শিয়া-সুন্নী বিরোধ জিইয়ে রেখে, ইরানের পারমানবিক জুজু দেখিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে একটি আঞ্চলিক ঐক্য ও নিরাপত্তার সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করা হয়েছে। এখন আর অনৈক্যের সুযোগ নেই। হামাস, হেজবুল্লাহ, ইসলামিক জিহাদ, হুতি, লেবানন,আইআরজিসি, সিরিয়া, জর্ডান, মিশর, তুরষ্ক, সউদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, বাহরাইনসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ইস্পাত কঠিন ঐক্য এবার একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্ন ও ইসলামের প্রথম কেবলা আল আকসার মুক্তি ত্বরান্বিত করতে পারে। সাতষট্টি সালের যুদ্ধের আগের সীমানা অক্ষুন্ন রেখে দ্বিরাষ্ট্র কেন্দ্রিক সমাধানের ভিত্তিতে পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্তর্জাতিক প্রস্তাবকে অগ্রাহ্য করে ফিলিস্তিন ও লেবাননের উপর বর্বর বোমা হামলা অব্যাহত রাখলে ইসরাইলের ধ্বংস ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বাস্তবতা অথবা মধ্যপ্রাচ্য থেকে আরেকটি মহাযুদ্ধে লাখ লাখ মানুষের জীবন-মৃত্যুর হুমকি, এর যে কোনো একটি বেছে নিতে হবে। তারা যা’ই বেছে নিক, জয়-পরাজয়ের নিয়ামক শক্তি আর তাদের হাতে নেই।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

মানসিক সুস্থতায় কর্মবিরতি
মুনতাহার মর্মান্তিক মৃত্যু এবং কিছু কথা
ট্রাম্পের বিজয়ে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার কি কোনো লাভ হবে?
ব্যাটারিচালিত রিকশা-অটোচালকদের তাণ্ডব রুখতে হবে
স্মৃতির দর্পণে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী
আরও

আরও পড়ুন

বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ

বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ

কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার

কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার

প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ

প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ

বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত

বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত

উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ

উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ

গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস

গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস

শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে

শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে

চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক

চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক

পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া

পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া

ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব

ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব

লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু

লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু

ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল

ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল

‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’

‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’

প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের

প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের

প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া

প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া

মুসলিম চিকিৎসক

মুসলিম চিকিৎসক

শীর্ষে দিল্লি

শীর্ষে দিল্লি

সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা

সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা

ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা

ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা

বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান

বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান