ফ্যাসিবাদ পুনরুত্থানের আশঙ্কা!
১৬ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১১ এএম | আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১১ এএম
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সূত্রমতে, বিচারবিভাগ এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ ও প্রক্টোরিয়াল বডিতে নিয়োগ পেয়ে তারা বলছে, ‘ছাত্ররা আমাকে নিয়োগ দিয়েছে’, অতএব, কোনো রাজনৈতিক দলকে আমলে না নিলেও চলে। অবশ্য জামায়াতে ইসলামের ব্যক্তিদের তদবিরের ক্ষেত্রে একথা বলা হচ্ছে না। প্রকৃতপক্ষে বিএনপি নীতি-নির্ধারকের ভূমিকা রাখতে পারছে না বলেই জামায়াত সমর্থিতদের একচেটিয়া আধিপত্য দেখা যাচ্ছে। কোনো কোনো উপদেষ্টার সুদৃষ্টি তাদের ক্ষমতায় আসীন হওয়ার মাঠ প্রস্তুত করে দিচ্ছে। কিন্তু দেশের সকল রাজনৈতিক দলই জানে, নির্বাচন হলে জামায়াত কখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হতে পারবে না। আসলে জামায়াতের পক্ষে ভারতের প্রচারণা আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে বর্তমান সরকারের ক্ষমতায় থাকাটা প্রলম্বিত হবে। আর তা হলে সময়ের স্রোতে শেখ হাসিনার পক্ষে সহানুভূতি গড়ে উঠবে। ফলে ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান সম্ভব। উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল নিজের পছন্দের মানুষকে দেশের সব জায়গায় নিয়োগ দিয়ে নিজের মনের মতো টিম গড়ে তুলছেন। ফায়দা হাসিলের এই কৌশল দেশের জন্য ভয়ঙ্কর।
বিএনপির মুখপাত্র ও সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সরকারের বিভিন্ন নিয়োগ নিয়ে বারবার অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকার আমলে যারা একের পর এক দুষ্কর্ম করেছে তাদের প্রশ্রয় না দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তিনি (দৈনিক বাংলা, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪)। ডিসি নিয়োগ ও শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক পদে সৈয়দ জামিল আহমেদের নিয়োগ নিয়েও প্রশ্ন তুলে তিনি বলেছেন, ‘স্বৈরশাসকের দোসররা মাথাচাড়া দিলে আবার সেই পরিস্থিতি তৈরি হবে। ১০ সেপ্টেম্বর ৩৪ জন ডিসি দিয়েছেন। এই ডিসিদের সবাই ছিল ছাত্রলীগের। এরা গণতন্ত্রের পক্ষে কাজ করবে না।’ মহাপরিচালক অধ্যাপক জামিল আহমেদ নারী সমাজের পর্দাপ্রথা তথা বোরকা পরাকে কটাক্ষ করেছেন। আওয়ামী শিল্পীদের নিয়ে শিল্পকলার প্ল্যাটফর্ম থেকে ওয়াজ মাহফিলের বিরুদ্ধে প্রচারণা কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। দাঙ্গা বাঁধানোর ভয়াবহ এই দূরভিসন্ধি সত্ত্বেও তিনি বর্তমান সরকারের আস্থাভাজন। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দৃষ্টিতে তিনি জঙ্গিবাদের উস্কানিদাতা এবং ভারতের হেজিমনিক বক্তা। এজন্য রাজধানীর একটি মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে এনে চায়ের টেবিলে বসিয়ে পুনরায় রাজনীতি করার সুযোগ তৈরির যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা প্রকৃতপক্ষে ভারতের ভাষ্য। ফ্যাসিস্ট সরকারের ভূত এভাবে প্রভাব বিস্তার করছে সর্বত্র। গণঅভ্যুত্থানে শত শহীদের আত্মত্যাগের কি কোনো মূল্য নেই এদের কাছে? গণবিরোধী ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসন! গণবিপ্লব, গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থ? তিনি কীভাবে এখনও একটি দেশের জাতীয় প্রতিষ্ঠান শিল্পকলায় আসীনÑ জনমানুষের বোধগম্য নয়।
সরকারের কোন জায়গা থেকে নিয়োগ সম্পন্ন হচ্ছেÑ তা জনগণ জানতে চায়। জামায়াতের লোক বেশি প্রাধান্য পাওয়ার কারণ কী? তারা পছন্দের নাম পাঠিয়ে উদ্দেশ্য হাসিল করে নিচ্ছে কি? অপরদিকে অভিযোগ তুলেও বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দলের মুখপাত্র রিজভী সাহেবের কথাকে কোনো মূল্য দেওয়া হচ্ছে না কেন? বিতর্কিত নিয়োগ নিয়ে জানানো সত্ত্বেও দেখা গেল সরকারের উপদেষ্টারা কোনো কোনো অফিসে নিজে গিয়ে দায়িত্বে বসিয়ে দিয়ে আসছেন। ফলে রাজনৈতিক দলের প্রতি সরকারের উপদেষ্টাদের উপেক্ষা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ জরুরি। ড. আসিফ নজরুলীয় হেজিমনিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য কাউন্টার হেজিমনি তৈরি করা বিএনপির মতো জনপ্রিয় দলের পক্ষে খুব বেশি কঠিন না।
জনগণ মনে করছে, প্রধান উপদেষ্টা থাকার পরও ড. আসিফ নজরুল একজন উপ-প্রধান উপদেষ্টার মতো সব মন্ত্রণালয়ে নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য নিয়োগে দাপট প্রদর্শন করে চলেছেন। ফলে প্রশাসনে ফ্যাসিবাদের ভূত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করছে না, বরং তিনি নিজের ইচ্ছে পূরণ করে চলেছেন। এক্ষেত্রে পিনাকী ভট্টাচার্য আসিফ নজরুল সম্পর্কে ব্যঙ্গ করে যা বলেছেন, তার সারমর্ম হলো, উপদেষ্টাদের প্রশ্রয়ে ফ্যাসিবাদী দোসররা রাজনীতির মঞ্চে ফিরে এলে তা হবে বিপ্লবের চরম ব্যর্থতা। একথাও মনে রাখা দরকার, এদেশের জনগোষ্ঠী তিতুমীরের আদর্শ, সূর্যসেনের প্রতিবাদ, প্রীতিলতার আত্মত্যাগ আর কবি নজরুলের কঠিন কুঠারে শাণিত। আবু সাঈদ, মুগ্ধ, আবরার, ফেলানি, স্বর্ণা দাসের আত্মত্যাগ ব্যর্থ হবার নয়। ভুল করলে তার মাসুল সরকারকেই দিতে হবে। ঝড়ের সময় খই না ভাঁজাই ভালো।
৪.
বিগত ১৬ বছরে ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতা কুক্ষিগত করে সারাদেশকে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত করেছিল। দুদকের মতো প্রতিষ্ঠানকে যেমন নিজের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছিল, তেমনি গড়ে তুলেছিল ফ্যাসিবাদী চেতনা লালনকারী সমর্থক গোষ্ঠী। অহঙ্কার ও দাম্ভিকতা হাসিনার পতনের আরো একটি কারণ। হাসিনার দাম্ভিকতা ইকারুস মিথকে স্মরণ করিয়ে দেয় (প্রতীচ্য পুরাণ, ফরহাদ খান, পৃ ২৮)। ডিডেলাসের পুত্র ইকারুস। ডিডেলাসের অন্যায়কর্মের জন্য ক্রিটের রাজা মাইনস পুত্রসহ তাকে বন্দি করে রাখেন। ডিডেলাস নিজের উদ্ভাবনী প্রতিভাবলে নিজের এবং পুত্রের জন্য পাখির পালক ও মোম দিয়ে দু’জোড়া ডানা তৈরি করেন, যাতে তারা ক্রিট থেকে উড়ে পালিয়ে যেতে পারেন। ডিডেলাস ইকারুসকে বার বার সতর্ক করে দেন যে, সে যেন কখনোই বেশি উপরে না ওঠে, কারণ এতে সূর্যের তাপে মোম গলে যেতে পারে। কিন্তু ইকারুস তার পিতার কথায় কান দেয় না, আকাশে ওড়ার আনন্দে সে সব ভুলে যায়। একসময় উড়তে উড়তে অনেক উপরে উঠে যায়, তখন সূর্যের তাপে মোম গলে গিয়ে তার পাখা ভেঙে যায় আর ইকারুস সমুদ্রে পতিত হয়ে মারা যায়। ডিডেলাসের পুত্র ইকারুসের ঘটনা শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী আচরণের ভয়ঙ্কর পরিণতিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। শেখ হাসিনার অহঙ্কার ইকারুসের পতনের মতো মহাবিপর্যয় তৈরি করেছে। আওয়ামী লীগের মাফিয়া চক্র বিপদাপন্ন, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সংকটে পড়েছে দলের নেতা-কর্মীরা। গণআন্দোলনে যে হত্যাযজ্ঞ চলেছে তার ভাগিদার ফ্যাসিবাদের দোসররাও। তারা বিচারের সম্মুখীন হচ্ছে। শীঘ্রই বিচার কার্য শুরু করতে হবে। অসংখ্য আওয়ামী জমানার লোক এখনও প্রশাসন ও বিচার বিভাগ ও পুলিশে কর্মরত। রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে পুলিশের মনোবল বৃদ্ধি করতে হবে। নিরপেক্ষ জায়গা থেকে যোগ্যতা বিশ্লেষণ করে ভালো কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে। আশ্চর্য হলো ড. ইউনূস সরকারের কাছে যে পরিপূর্ণ সংস্কার প্রত্যাশা করা হয়েছে, তার কোনো অগ্রগতি নেই। দ্রুত সংস্কার করে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সরকার আনতে হবে। অথচ, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেটিÑ নির্বাচনের রোডম্যাপ সরকার কর্তৃক ঘোষিত হয়নি এখনও। এজন্য দেশের জনগণ সন্দিহান।
৫.
মূলত সমকালীন পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে যাচ্ছে। এর জন্য দায়ী বর্তমান সরকার। সময়ের প্রয়োজনে ছাত্র-জনতার সমর্থনে গঠিত হয়েছে সরকার। সর্বস্তরের জনগণ তা মেনে নিয়েছে। সরকারকে মেনে নিয়ে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে নাÑ একথা প্রণিধানযোগ্য। ১৭ সেপ্টেম্বর (২০২৪) বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশনায়ক তারেক রহমান বলেছেন, গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। তাঁর মতে, ‘সংস্কারের পথ ধরে নির্বাচনি রোডম্যাপে যাবে বাংলাদেশ। তিনি নির্বাচন কমিশন, জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংস্কার করে একটি নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠার কাজকে অগ্রাধিকার দিতে ড. ইউনূস সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।’
দেশনায়ক যে কথাগুলো বলেছেন তার গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু কেউ কি কর্ণপাত করছেন? সরকার শুনছে না। বিদেশে অবস্থানরত বুদ্ধিজীবীরাও পরামর্শ দিচ্ছেন, তাদেরও আমলে নিচ্ছে না। গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতা জীবন দিয়েছে, সেখানে বিদেশি সাংবাদিক-অ্যাক্টিভিস্টরা ছিলেন বিপ্লবের চূড়ান্ত মনস্তত্ত্ব তৈরি করার অনুঘটক। অথচ, গণআন্দোলনের অনলাইন বীরদের কোনো পরামর্শকে আমলে নিচ্ছেন না সরকারের উপদেষ্টারা। কারো আশাবাদকে, দেশের কল্যাণ কামনাকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজেদের অভিলাষকে প্রাধান্য দিয়ে দেশ চালাচ্ছেন ড. ইউনূস সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলী। ফলে নতুন বোতলে পুরানো মদ রাখার পরিস্থিতি দেশকে ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থানকে সম্ভব করে তুলতে পারে। (সমাপ্ত)
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান এবং অধ্যাপক, থিয়েটার অ্যান্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
নাটকীয় শেষ দশ মিনিটে দুই গোল শোধ করে বার্সাকে রুখে দিল সেল্তা
বিবর্ণ সিটিকে ইতিহাদেই বিধ্বস্ত করলো টটেনহ্যাম
নটিংহ্যামকে হারিয়ে চার ম্যাচের জয়খরা কাটালো আর্সেনাল
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা জাতীয়করণের দাবী অত্যন্ত যৌক্তিক
পাঠ্যবই ছাপায় অনিয়মে আনন্দ প্রিন্টার্সকে সতর্কতা
দক্ষিণ লেবাননে ৬ চিকিৎসাকর্মী নিহত
জনগণের সাথে জনসংযোগ বাড়াতে হবে
আমরা যুদ্ধে বিশ্বাসী না কেউ গায়ে পড়লে জবাবের প্রস্তুতি রাখতে হবে: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
বাফুফের নতুন সভাপতি তাবিথের কাছে ২৭ রেফারির চিঠি
ফের বাড়লো সোনার দাম, ভরি ১ লাখ ৪২ হাজার টাকা
বাংলাদেশে খেলা নিয়ে অনিশ্চিয়তায় হামজা!
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেই হবে অনূর্ধ্ব-২০ নারী সাফের খেলা
সিলেটে মাজিদের ফিফটি
অ্যাম্বাসেডর কাপ উশুতে সেনাবাহিনী চ্যাম্পিয়ন
মাদক শুধু ব্যক্তিকে নয় পরিবারকেও ধ্বংস করে
সাধারণ মানুষের পেটে লাথি মেরে আ.লীগ নিজেদের ভাগ্য গড়েছে : এমরান সালেহ প্রিন্স
ধর্মদ্রোহী সরকারের সময় কোনো ধর্মই নিরাপদ ছিল না
দৌলতখানে শীতকালীন সবজি পরিচর্যায় ব্যস্ত কৃষক
সুন্দরগঞ্জে ছয় পা বিশিষ্ট বাছুরের জন্ম
বৈষম্যের শিকার কুমিল্লার ১৫ হাজার এতিম শিশু