অর্থনীতি ও নির্বাচনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে
১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম
অর্থনীতির সাথে অপরাধ বৃদ্ধির যোগসূত্র রয়েছে। অর্থনীতি শক্তিশালী হলে মানুষের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা যেমন কমে, তেমনি দুর্বল হলে বাড়ে। সাধারণ মানুষ যখন জীবনযাপনের মৌলিক চাহিদা মিটাতে পারে না কিংবা হিমশিম খায়, তখন তাদের অনেকের মধ্যে ক্ষোভ-হতাশা বিরাজ করে। এই ক্ষোভ ও হতাশা থেকে কেউ কেউ অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। খুন, অপহরণের মতো ভয়াবহ অপরাধে সম্পৃক্ত হয়। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতির হার বেড়ে যায়। আমরা দেখেছি, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসনকালে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কীভাবে খুন, গুম, অপহরণ, তুলে নিয়ে যাওয়া, বিচারবর্হিভূত হত্যাকা- ঘটেছে এবং কীভাবে তার দল আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, ছিনতাই, ডাকাতিসহ হেনকোনো অপরাধ নেই, যা করেনি। দেশে এক ভয়ের পরিবেশ গড়ে ওঠে, যেখানে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বলে কিছু ছিল না। এসব অপরাধ হয়েছে, মানুষকে নিষ্পেষণে রেখে তাদের আখের গোছানোর জন্য। সাধারণ মানুষ অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্যে থাকলেও এর প্রতিবাদ করতে পারেনি। সে সময় অনেকেই হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনার পতন ও পলায়নের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জনগণের বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। শুরুতেই ড. মুহাম্মদ ইউনূস পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাবশালী দেশ, মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে প্রায় সব দেশে বিপুলভাবে সমাদৃত হন এবং দেশগুলো তাকে অকুণ্ঠ সমর্থন ও একের পর এক অর্থনৈতিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেয়। এতে শেখ হাসিনার ফোকলা করে রেখে যাওয়া অর্থনীতি পুনর্গঠনে আশার সঞ্চার হয়। এটা শুধু ড. মুহাম্মদ ইউনূসের একক কৃতিত্ব এবং বিশ্বব্যাপী তার অসামান্য গ্রহণযোগ্যতার কারণে হয়েছে। তিনি ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনে উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে ড. আহসান এইচ. মনসুরের মতো যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিত্বকে দায়িত্ব দেন। এ দুজন অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ধসে যাওয়া ব্যাংক খাতসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে সংস্কার করে সঠিক পথে এনেছেন এবং তাতে গতি সঞ্চারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। পর্যবেক্ষকদের মতে, অর্থনৈতিক কাঠামোকে শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া এবং সহযোগিতা করা উচিৎ।
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সময়কার অর্থনৈতিক চিত্রের দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখব, ব্যাংক দখল করে মানুষের জমানো টাকা হাতিয়ে নেয়া, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রভাবশালীদের ব্যাংক লুটপাট ও বাণিজ্যের নামে অর্থপাচার, টাকা ছাপিয়ে ব্যাংক টিকিয়ে রাখা, ডলার সংকট, রিজার্ভ তলানিতে নিয়ে যাওয়া। নিত্যপণ্যের মূল্য আকাশছোঁয়া হয়ে যাওয়া এবং সাধারণ মানুষের আয় কমে নিদারুণ দুঃখ-কষ্টে জীবনযাপন করা। অন্তর্বর্তী সরকারকে এই লিগ্যাসি নিয়েই দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে। স্বল্প সময়ে এসব সমস্যা সমাধান করে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। ফলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ অব্যাহত রয়েছে। তারা অত্যন্ত কষ্টে জীবনযাপন করছে। দুবেলা আহার জোগাড় করা কঠিন হয়ে পড়েছে। সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। মানুষ নিদারুণ অভাব-অনটনের মধ্যে পড়েছে। যারা কখনো টিসিবির ট্রাকের কাছে লাইন ধরতেন না, তারাও এখন সংকোচ নিয়ে দাঁড়াচ্ছেন। এতে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশার অবসান না হয়ে আরও বেড়ে গেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় অনেকে অপরাধ প্রবণ এবং অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। গত কয়েক দিনে বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকা- ঘেটেছে। গত সপ্তাহে সিলেটে এক শিশু খুন, গত বৃহস্পতিবার ধানমন্ডিতে চুরির ঘটনা প্রতিহত করতে গিয়ে যুক্তরাজ্য প্রবাসী এক ব্যক্তি ও হাজারিবাগে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে এক কিশোর খুন, আজিমপুরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মচারির বাসায় ঢুকে ডাকাতদল লুটপাট করে তার ছোট্ট মেয়েকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে। এমন আরও অনেক অপরাধমূলক ঘটনা দেশজুড়ে হচ্ছে, যা পত্রপত্রিকায় আসে না। এসব অপরাধের বেশিরভাগই মানুষের অভাব-অনটন থেকে সৃষ্ট। ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও মানুষের অপরাধ প্রবণতা ঠেকাতে অন্তর্বর্তী সরকারকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে। জিনিসপত্রের দাম মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসা, কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ বৃদ্ধি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পলিথিন উচ্ছেদের মতো কাজ করার চেয়ে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণ করা সবচেয়ে বেশি জরুরি। দ্বিতীয়ত, যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ তৈরি এবং অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করা। যত বিলম্ব হবে, তত দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে। কারণ, মাঠ পর্যায়ে অন্তর্বর্তী সরকারের বিস্তৃতি ও জনপ্রতিনিধি নেই যে তা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারে। সরকার নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটি গঠন করলেও কমিশন এখনো গঠিত হয়নি। এক্ষেত্রে বিলম্ব করা উচিৎ হবে না। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত সপ্তাহে এএফপিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ স্বল্প হওয়া উচিৎ এবং সংস্কার করে নির্বাচন দেয়া হবে। এ কাজটি দ্রতি এগিয়ে নেয়া দরকার। অন্যদিকে, ব্রাসেলসভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসজি) অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন উপলক্ষে গত বৃহস্পতিবার ‘আ নিউ এরা ইন বাংলাদে? দ্য ফার্স্ট হান্ড্রেড ডেজ অফ রিফর্ম’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলেছে, নতুন নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের ১৮ মাসের বেশি সময় নেয়া উচিৎ নয়। দীর্ঘ সময় এ সরকারের ক্ষমতায় থাকা ঠিক হবে না। এর মধ্যে সংস্কার করে নির্বাচন দেয়া উচিৎ। যদি এই সরকার হোঁচট খায়, তাহলে বাংলাদেশ আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংস্কার কাজ এগিয়ে নিতে হলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে রাজনৈতিক ঐকমত্য বজায় রাখতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলে সমস্যা ও সংকট প্রকট হয়ে উঠতে পারে। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানও ইতোমধ্যে বলেছেন, দেড় বছর বা ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন দেয়া উচিৎ। দেখা যাচ্ছে, গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিরা নির্বাচন দ্রুত আয়োজন করার উপর বেশি তাকিদ দিচ্ছেন। দেশের বৃহত্তম দল বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বোতভাবে যেমন সহায়তা করে যাচ্ছে, তেমিন দ্রুত নির্বাচনেরও তাকাদা দিচ্ছে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারকে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনসহ গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সংস্কারের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা জরুরিভিত্তিতে শেষ করে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে হবে।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে গতিতে এগিয়ে যেতে চান ও যাচ্ছেন, তার সাথে জনাকয়েক উপদেষ্টা ছাড়া অন্যদের মধ্যে তেমন তাড়া নেই। তাদের আচার-আচরণে অযোগ্যতা ও অদক্ষতা পরিদৃষ্ট হয়ে উঠেছে। তাদের মধ্যে ক্ষমতা উপভোগের প্রবণতা প্রবল বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। তারা এ বিষয়টি আমলে নিতে চাচ্ছেন না যে, তারা একটি জরুরি সরকারের উপদেষ্টা এবং তাদের মেয়াদ সীমিত। তাদের উচিৎ, অর্পিত দায়িত্ব দ্রুত শেষ করে নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করা। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, অর্থ উপদেষ্টা, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উপদেষ্টা, তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা, বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনরের কাজ যেভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে, অন্যদের ক্ষেত্রে তা দৃশ্যমান নয়। বিদ্যুৎ খাতে ধীরে হলেও কিছু কাজ হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়তে চীন থেকে প্ল্যান্ট আনা এবং গ্যাস ও জ্বালানি উৎপাদনে আরও বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিৎ। তা নাহলে, দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা বিরূপ প্রভাব পড়বে, যা অর্থনীতি পুনর্গঠনকে ধীর করে দেবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে মনে রাখতে হবে, তাদের হানিমুন পিরিয়ড পার হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষের পর্যবেক্ষণও শেষ হয়েছে। এখন তারা সরকারের কর্মকা- এবং সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব মেলাতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে তারা শঙ্কিত। সরকারকে এসব বিষয়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রথমত, অর্থনীতি শক্তিশালীকরণসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে জনমনে স্বস্তি সৃষ্টি করতে হবে। দ্বিতীয়ত, দ্রুত সংস্কার কাজ শেষ করে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ঘোষণা করা হয়েছে মেলন মিউজিক অ্যাওয়ার্ড ২০২৪ - এর মনোনীতদের নাম
চীনে বহুতল ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত ৭
সরিষাবাড়ীতে বিএনপির বিশাল জনসভা - দেশপ্রেমের আহ্বান শামীম তালুকদারের
মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের ‘ধর্মযুদ্ধে’ নামতে বললেন মহারাষ্ট্রের উপমুখ্যমন্ত্রী
বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশে খেলাধুলার সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করা হবে - মেজর হাফিজ।
৫ আগস্টের বিজয়ে তারেক রহমান পনেরো বছর ধরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন
পুলিশকে জনগণের বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে: আইজিপি
নারায়ণগঞ্জে হরতালের সমর্থনে মিছিল
জুলাই-অগাস্ট অভ্যুত্থানে শহীদদের নামে উপজেলা পর্যায় হবে স্টেডিয়াম
বিশ্বজনতার নজর আমেরিকায় কেন?
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি : ফ্যাসিবাদের পক্ষাবলম্বনে কুগেলম্যান
হতাশ মুসলিম ভোটাররা
ঘুরে দাঁড়িয়ে মালদ্বীপকে হারাল বাংলাদেশ
বাইডেন প্রশাসনের নিন্দা জানালেন মার্কিন সিনেটর
অস্ট্রিয়ায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করছে রাশিয়া
চীনের নতুন মেগাপোর্ট উদ্বোধন
দ্বিগুণ সাহায্য চায় ভঙ্গুর দেশগুলো
গালওয়ান সীমান্ত নিয়ে বিভেদ ভুলে যাচ্ছে ভারত ও চীন
ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি নিয়ে ট্রাম্পকে যে আহ্বান জানাল হামাস
ব্রিটেনে পুরুষদের ফুসফুস ক্যান্সারের হার সর্বাধিক