অসম্ভবকে সম্ভব করেছে ছাত্র-জনতা
১৮ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৪ এএম
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গত সাড়ে ১৫ বছর দেশটিকে নিজের সম্পত্তি বানিয়ে নিয়েছিল। তার মতের বিরুদ্ধে এবং ইচ্ছার বিরুদ্ধে কারো কোনো কথা বলার অধিকার ছিল না। গণতন্ত্রের নামে দেশে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিল। আওয়ামী লীগ দেশে অন্য কোনো দলকে তাদের দলীয় কোনো কার্যক্রম করতে দিতো না। ফ্যাসিবাদের এই যাত্রা শুরু হয় মূলত ২০০৮ সালে। ফ্যাসিবাদী নিপীড়ন চরম মাত্রায় পৌঁছে ২০১৪ সালের অবৈধ নির্বাচনের পর থেকে। এ সময়ে ফ্যাসিস্ট সরকার দেশের সবচেয়ে বড় দল বিএনপিকে মাঠেই নামতে দেয়নি। বিএনপির সিনিয়র নেতাদের পার্টি অফিসে পর্যন্ত যেতে দিতো না। বিরোধী মতের কাউকে কোথাও সমাবেশ করতে দিতো না। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এ সময় অঘোষিত নিষিদ্ধ ছিল। তারা কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকা- করতে পারতো না।
এ সময় ফ্যাসিবাদের মন্ত্রীরা বিরোধী দলকে নিয়ে নানান তামাশা করতেন। দাঁত কেলিয়ে আর মুখ ভেঙচিয়ে বলতেন, বিএনপির সাহস নেই। সাহস থাকলে সামনে আসে না কেনো? ফ্যাসিবাদের এসব দোসর অনলাইন ও অফলাইন মিডিয়ায় হাসাহাসি করতো। তারা বলতো, বিএনপি ভিডিও বার্তার দলে পরিণত হয়েছে। দেশের তথাকথিত মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবীরাও সরকারের সুরে সুর মিলাতো! বিরোধী জোটের ভিডিও বার্তার আন্দোলনকে তারা রাজনীতিই মনে করত না। অথচ, তথাকথিত সুশীল সমাজ এ প্রশ্ন করতে নৈতিক সাহস দেখায়নি যে, একটি গণতান্ত্রিক দেশে সেই দেশের সর্ববৃহৎ দলটি কেনো তার অফিসে বসতে পারছে না? ভিডিও বার্তার ঐ লোকটিকে গোপন স্থান থেকে গ্রেফতার করে গুম করে ফেলেছিল ফ্যাসিস্ট হাসিনা। তথাপিও সুশীলরা নির্লজ্জভাবে আওয়ামী লীগেরই দালালি করে গেছে। বলছিলাম, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহমেদের কথা। ফ্যাসিস্ট সরকার যখন রাজপথে নামতে দিচ্ছিল না, পার্টি অফিস বন্ধ করে রেখেছিল ঠিক তখন বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ ভিডিও বার্তার মাধ্যমে আন্দোলনের দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন। সেটাও তারা সহ্য করতে পারেনি। গোপন স্থানে অবস্থান করেও আওয়ামী পুলিশের হাত থেকে তিনি রেহাই পাননি। তাকে ঐ গোপন স্থান থেকেই গ্রেফতার করে ভারতে চালান করে দিয়েছিল। দীর্ঘ নয় বছর পর ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর তিনি দেশে ফেরেন।
দেশের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দলের প্রধান তারেক রহমান দীর্ঘ ১৫-১৭ বছর নির্বাসনে ছিলেন, এখনও আছেন। বিদেশে বসেই ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দল পরিচালনা করেছেন। তিনি অসুস্থ মাকে দেখতে দেশে আসতে পারেননি। ভাইয়ের জানাযায় অংশ নিতে পারেননি। একের পর এক মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। বিচারকের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে তার বিরুদ্ধে ফরমায়েশি রায় লেখানো হয়েছে। তাকে নিয়েও ফ্যাসিবাদীদের সার্কাসের শেষ ছিল না। আওয়ামী সার্কাসের বয়ান ছিল এমনÑ ‘এতো সাহস থাকলে দেশে আসুক! বিদেশে বসে বসে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে সে যা করছে সেটা কোনো রাজনীতি নয়।’ অথচ, প্রশ্ন হওয়া দরকার ছিলো, বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাকে কেন দেশের বাইরে নির্বাসনে দেওয়া হয়েছে?
ফ্যাসিবাদের নিপীড়নের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার শিকার অনেক দেশপ্রেমিক এক্টিভিস্ট। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন পিনাকী, মিনা ফারাহ, ইলিয়াস, শাহেদ আলম, কনক সরওয়ার, মনির হায়দার প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। এসব ব্যক্তি ফ্যাসিবাদের নগ্ন থাবা থেকে আত্মরক্ষা করতে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। আর যারা দেশে রয়ে গিয়েছিলেন তারা রাজনৈতিক এক্টিভিজমে ক্ষান্ত দিয়ে গোপনীয়তা রক্ষা করে কোনোমতে সার্ভাইভ করেছেন।
আওয়ামী আমলে অন্যতম নির্যাতিত দল জামায়াতে ইসলামী। সারাদেশে তার একটি অফিসও খুলতে দেয়নি ফ্যাসিবাদী সরকার। সে সরকার ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর বহু জামায়াত নেতাকর্মীকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করেছে। সিনিয়র নেতাদের জুডিশিয়াল কিলিংয়ের মাধ্যমে হত্যা করেছে। বুলডোজার দিয়ে তাদের বাড়িঘর গুড়িয়ে দিয়েছে। পার্টি অফিসে মিটিং করতে না পেরে তারা যখন গোপনে কোথাও মিটিং করেছে, সেটাকে গোপন বৈঠক বা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে গ্রেফতার করেছে। দেশে তথাকথিত সুশীল সমাজের একজন বিবেকবান মানুষও ছিলো না এ বিষয়ে কথা বলার। তাদের একজনও এ প্রশ্ন করেনি যে কেনো একটা গণতান্ত্রিক দলের পার্টি অফিস থাকতে তারা গোপনে মিটিং করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা ছিলো আরো ভয়াবহ। গত সাড়ে পনের বছর বিরোধী ছাত্র সংগঠন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অঘোষিত নিষিদ্ধ ছিল। ক্যাম্পাসে একটা স্বাভাবিক মিছিল মিটিং করতে দেওয়া হয় নাই তাদের কাউকে। যখনি কেউ দাবি দাওয়া নিয়ে মিছিলের চেষ্টা করেছে তখনি তাদের উপর হামলা হয়েছে। এমনকি নারী কর্মীদের উপরও হামলা হয়েছে। কাউকে বিরোধী মতের মনে হলেই তাকে শিবির তকমা দিয়ে পিটিয়ে হল ও ক্যাম্পাস থেকে বের করে দিয়েছে। পরিচয় গোপন করে থাকা কর্মীদেরও খুঁজে বের করে টর্চার করেছে।
২০১৩ থেকে ২০১৯ এই ছয় বছরে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ঢাবি ক্যাম্পাসে নির্যাতনের প্রায় ৫০টি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে ঢাবির হলগুলো থেকে শুধুমাত্র সন্দেহবশত অন্তত ৪০ জন শিক্ষার্থীকে রাতভর পশুর মতো নির্যাতন করে হল থেকে বের করে দিয়েছে। জঙ্গি আখ্যায়িত করে তাদের পুলিশে দিয়েছে। ছাত্রদল বা শিবিরের কোনো সিনিয়র নেতার সাথে যোগাযোগের প্রমাণ পেলে কিংবা ফোনে কারো নাম্বার পাওয়া গেলেই তাকে পেটানো হয়েছে। কোনো শিক্ষার্থীর ফ্যামিলি বিএনপি বা জামায়াতের সাথে জড়িত থাকার খবর পেলেই তাকে জঙ্গি ট্যাগ দিয়ে পিটিয়ে পুলিশে দিয়েছে। পরীক্ষার হল থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে তাদেরকে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা পিটিয়েছে।
ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে সহাবস্থানের রাজনীতি শেষ করে দিয়ে হামলা আর পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করিয়ে উপহাস করতো। আর বলতো, কই, ছাত্রদল তো ক্যাম্পাসে রাজনীতি করার সাহসই রাখে না। ওবায়দুল কাদেরসহ অন্য মন্ত্রীরাও ‘বিএনপি আন্দোলন করার সক্ষমতা রাখে না’ বলে টিটকারী করতো। ঈদের পরে আন্দোলন ঘোষণা দিয়েও কেনো করতে পারে না তা নিয়েও আওয়ামী নেতারা উপহাস করতো। ‘বিএনপি কোন্ ঈদের পরে আন্দোলন করবে’ এ নিয়ে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি তথাকথিত সুশীল সমাজও হাসাহাসি করতো। অথচ, প্রশ্ন করা দরকার, ছিলো একটা গণতন্ত্রাতিক দল তাদের কর্মসূচি পালন করতে গেলে কেনো নিপীড়নের শিকার হবে? মূলত শেখ হাসিনা এবং তার অনুচরেরা চেয়েছিল আজীবন ক্ষমতায় থাকতে।
তবে একথা সত্য যে, বিএনপি-জামায়াত ১৫ বছর ধরে আন্দোলন করলেও দেশবাসী রাস্তায় নামেনি। তাদের আহবানে জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত সাড়া দেয়নি। বিধায় দেশের অধিকাংশ মানুষ ধরেই নিয়েছিল যে, শেখ হাসিনা ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে হাসিনা বাংলাদেশ পুলিশ, বাংলাদেশ আর্মি, বিজিবি, আনসার, বাংলাদেশের সচিবালয়, বাংলাদেশের বিচারালয়, বাংলাদেশের গণমাধ্যমÑ এক কথায় দেশের সকল সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আওয়ামী কর্মী দিয়ে দিয়ে তার প্রশাসন যন্ত্র সাজিয়েছিল। লক্ষ্য ছিল আজীবন ক্ষমতায় থাকা।
অথচ, কী নির্মম পরিহাস, যা ছিল অসম্ভব ও কল্পনাতীত তাই সত্য হয়েছে। শেখ হাসিনা পলায়নের আধা ঘণ্টা আগেও কেউ ভাবতে পারেননি যে, তাকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হবে। আলাপচারিতায় অনেক সাধারণ মানুষ বলতো, হাসিনা রেজিম থেকে দেশ মুক্ত হবে না। আর এ কারণে বোধহয় তিনি ভিশন ২০৪১ ঘোষণা করেছিলেন। মানুষ তাই বলাবলি করতো, একমাত্র আবাবিল যদি আসে তাহলেই শেখ হাসিনার পতন ঘটবে। ঘটনা তাই-ই ঘটেছে বলে আমি মনে করি। কারণ, বিপ্লবের নায়ক হলো ছাত্র-জনতা, আর আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের বয়স ২৫ এর নিচে। তাদের মাঝে কেউ কেউ ছিল নিষ্পাপ কিশোর। জনগণ তাদের আহবানে সাড়া দিয়ে বিপ্লবে শরিক হয়েছিল। মা তার কোলের শিশু নিয়ে বিপ্লবের মিছিলে শামিল হয়েছিল। এটা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা। বিপ্লবের মিছিলে শামিল হওয়া তরুণ শিক্ষার্থীরা ছিল মূলত আবাবিল। দলে দলে তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে জালিমের পতনে ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিল। ফ্যাসিস্ট মুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। তবে দেশ থেকে ফ্যাসিস্ট বিদায় হলেও তার শিকড় রয়ে গেছে মাটির গভীরে। এ শিকড় উপড়াতে না পারলে বিপ্লব ব্যাহত হবে। বিপ্লবকে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ভারতে পাচারকালে সাতক্ষীরা সীমান্ত থেকে দুই নারী উদ্ধার
কুরআন-সুন্নাহর আইন ছাড়া দেশে শান্তি আসবে না : চাঁদপুরে হাবিবুল্লাহ মিয়াজী
শাহজাহান ওমরকে জুতা ও ডিম নিক্ষেপ
জীবনে উত্তম কর্ম, জ্ঞান ও উন্নত চরিত্র অর্জন করতে হলে সফল ব্যক্তিদের সান্নিধ্য অবলম্বন আবশ্যক
নড়াইলে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার মামলায় জেলা আ.লীগ সভাপতি কারাগারে
নোবিপ্রবির সঙ্গে তুরস্কের আনাদোলু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউশনাল এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর
শিক্ষার্থীদের মতের ভিত্তিতেই ছাত্রদলের রাজনীতি চলবে : নাছির
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় লাইনচ্যুত ট্রেন উদ্ধার, চলাচল স্বাভাবিক
না.গঞ্জে ২৪ ঘন্টায় ৪৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত
খরচ চালাতে লকার রুম, দরজা বিক্রি করছে রিয়াল মাদ্রিদ
যুক্তরাষ্ট্রে গৌতম আদানির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি
ক্ষেতের মধ্যে রেললাইন, জীবিকা হারানোর মুখে কাশ্মীরের আপেল চাষিরা
সাতক্ষীরায় সাফজয়ী তিন ফুটবলারের গণসংবর্ধনা
মার্কিনের পর এবার ব্রিটিশ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে রাশিয়ায় হামলা ইউক্রেনের
আহমেদাবাদ শিশু চলচ্চিত্র উৎসবে ৩৫ ইরানি ছবি
কিউই সিরিজের কথা ভুলে অস্ট্রেলিয়ায় হ্যাটট্রিকের অভিযানে ভারত
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য স্কলারশিপের অনুমোদন দিয়েছে পাকিস্তান
সেনাকুঞ্জে হাস্যোজ্জ্বল খালেদা জিয়া, ড. ইউনূসের সঙ্গে কুশল বিনিময়
সউদী আরবের ফ্যাশন শো নিয়ে যেসব কারণে ক্ষুব্ধ ইসলামী পণ্ডিতরা
সশস্ত্র বাহিনী দিবসে খালেদা জিয়াকে আনতে পেরে আমরা গর্বিত: প্রধান উপদেষ্টা