ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪ | ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

আওয়ামী লীগের ফিরে আসা কঠিন

Daily Inqilab মাহবুব নাহিদ

২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৯ এএম | আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৯ এএম

আওয়ামী লীগ কি দল হিসেবে পতিত হয়েছে, নাকি শুধু তাদের নেত্রী শেখ হাসিনার পতন হয়েছে, এই প্রশ্নটি এখন অনেকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা বিষয় হয়ে উঠেছে। যদিও এটি একান্তই একজন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক এবং জনগণের নিজস্ব চিন্তা, তবুও এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগের পতন কি শুধু শেখ হাসিনার জন্য হয়েছে, নাকি দলটি একটি ফ্যাসিবাদী রূপ নিয়েছে? সেটা থেকেই কি তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে? এ প্রশ্নগুলো একে অন্যের সাথে জড়িত।

এটা স্পষ্ট যে, আওয়ামী লীগের রাজনীতি এখনও শেখ হাসিনার চারপাশে ঘুরছে। শেখ হাসিনা তার রাজনীতি সাজিয়েছেন একেবারে ব্যক্তিগত ক্ষমতার প্রয়োগের মাধ্যমে, যা কখনোই গণতান্ত্রিক আদর্শের সাথে সংগতিপূর্ণ ছিল না। তিনি শুধু সরকার প্রধান ছিলেন না, তিনি ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরাচারি শাসকে পরিণত হয়েছিলেন। দেড় দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থেকে তিনি যে ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম করেছিলেন, তা ছিল নজিরবিহীন।

শেখ হাসিনা দলের নেত্রী হিসেবে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকাকালে অনেক সুযোগ পেয়েছিলেন, তবে সেই সুযোগকে তিনি ব্যক্তিগত ক্ষমতা হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য, তিনি জনগণের সমস্যা ও দরকারি দাবিগুলোর সাথে কোনো সম্পর্ক রাখেননি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন, গণতন্ত্রকে অবজ্ঞা এবং ব্যক্তিগত স্বার্থে দেশকে শাসন করেছেন। দলের সদস্যদের উপর আধিপত্য বজায় রেখে শুধু নিজের ক্ষমতা মজবুত করেছেন। জনগণের ভোট ও সমর্থনের চেয়ে, শেখ হাসিনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং সেটি শুধু তার ব্যক্তিগত লাভের জন্য।

ক্ষমতার লোভ এবং টিকে থাকার জন্য দেশের অর্থনীতির প্রত্যেকটি খাতকে ধ্বংস করেছেন শেখ হাসিনা। যখন দারিদ্র্য বাড়ছে, তখন আওয়ামী লীগের নেতারা কীভাবে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, তা সবার জানা। যখন জনগণের স্বার্থ উপেক্ষা করা হচ্ছিল, তখন শেখ হাসিনা শুধু নিজের রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারে মত্ত ছিলেন। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য গণতান্ত্রিক বিধি-নিষেধের ধার ধারেননি। এমনকি দেশবিরোধী এবং অবৈধ রাজনৈতিক কর্মকা-ও করতেও পিছপা হননি। আওয়ামী লীগের প্রতি তার কর্মীদের যে মনোভাব, সেটি নিছক দলপ্রেম নয়, এটা একটি পদ্ধতির প্রতি অগাধ টান। ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করার জন্য আওয়ামী লীগকে যেভাবে দীক্ষা দেয়া হয়েছে, দলের সকল সদস্য, নেতা-কর্মী নিঃশর্তভাবে তাতে আনুগত্য প্রদর্শন করেছে। তাদের মধ্যে যে বুদ্ধিবৃত্তিক বা রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব, সেটা রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। তারা গণতন্ত্র এবং জনগণের পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে শেখ হাসিনার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে। দলটির এখনকার অনেক কর্মীর মধ্যে এ প্রবণতা রয়েছে, শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসন ব্যবস্থায় থাকতে পারা একটি গর্বের ব্যাপার।

শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নিজেকে এবং তার পরিবারকে বাঁচাতে দেশ থেকে পালিয়ে যান। বোনকে সাথে নিয়ে তার এই পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে, শেখ হাসিনা কতটা স্বার্থপর যে নিজের দলের নেতাকর্মীদের কথা চিন্তা করেননি। দলের নেতাকর্মীদের কাছে তার এই পলায়ন এক বড় ধাক্কা হিসেবে এসেছে। তার পালানোতে পরিষ্কার হয়েছে, দলের জন্য তার কোনো দায়বদ্ধতা ছিল না, শুধু নিজের ক্ষমতা এবং ব্যক্তি স্বার্থই ছিল মুখ্য। এই ঘটনা আওয়ামী লীগের মধ্যে গভীর হতাশা সৃষ্টি করা স্বাভাবিক। তবে তার পতন হওয়া সত্ত্বেও দলটির নেতাকর্মীরা ফ্যাসিবাদী চরিত্র পুনরায় ফিরিয়ে আনার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। তারা এখন রাজপথে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গা গরম করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে শেখ হাসিনার পক্ষে। এসব নেতাকর্মী, যারা শেখ হাসিনার শাসন ব্যবস্থায় লাভবান হয়েছেন, তারা আবারও ফ্যাসিবাদী শাসনে ফিরে যেতে চাইছেন। যারা তার শাসনব্যবস্থায় আখের গোছাচ্ছিল, তাদের জন্য শেখ হাসিনার ফিরে আসা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারা বুঝতে পারছে যে, শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনতে না পারলে তাদের সমস্ত অবৈধ উপার্জন এবং ক্ষমতা হারিয়ে যাবে। তারা যে আবার ফিরে আসার জন্য হাহাকার করছে, সেটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক এবং আর্থিক স্বার্থের দিকে ইঙ্গিত করে।

আজকের বাংলাদেশ, যেখানে জনগণ গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং স্বাধীনতার জন্য উদগ্রীব, সেখানে আওয়ামী লীগের পক্ষে আর কোনোভাবেই তার আগের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ফিরে আসা সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার একনায়কত্বে শক্তিশালী হয়েছিল, তবে জনগণের প্রতি তার দায়বদ্ধতা এবং নৈতিক আদর্শ হারিয়েছে। দলটির রাজনীতি এখন ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা, শোষণ, নিপীড়ন এবং বল প্রয়োগের বদনামের উপর দাঁড়িয়ে আছে। জনগণ এখন আর দলটির সেই রাজনীতি মেনে নেবে না। কারণ, মানুষ অতীতে অনেক সহ্য করেছে। গণহত্যা, অন্যায়-অবিচার, বাকস্বাধীনতা হরন, বিরোধীদল দমন করা, খুন, গুম, এই সমস্ত কিছুই আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার মূল কৌশল ছিল। তারা দেশের হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে, সাধারণ মানুষকে ভয় দেখিয়ে দেশ শাসন করেছে।

এই আওয়ামী লীগ যদি আবার ফিরে আসতে চায়, তবে তার জন্য সহজ কোনো পথ আপাতত নেই। ফিরতে হলে মানুষের ভরসা অর্জন করতে হবে, জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে এবং বিশেষত আগের শাসনব্যবস্থা নিয়ে অনুশোচনা থাকতে হবে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, এ নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। তাদের মধ্যে এই প্রবণতা বিরাজমান, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে যে গণহত্যা চালিয়েছে, তা ঠিকই আছে। অথচ জনগণের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে কোনো রাজনৈতিক দলই স্থায়ীভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, সে যতই শক্তিশালী হোক না কেন।

বাংলাদেশে নতুন পটে অনেকগুলো পরিবর্তন আসছে। এখন আর সেই পুরোনো ফ্যাসিবাদী রাজনীতি আর জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। আওয়ামী লীগ যদি ভবিষ্যতে ফিরে আসতে চায়, তার প্রথম কাজ হবে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের পরিত্যাগ করা। যদি সে অতীতের মতো ক্ষমতার জন্য ফ্যাসিবাদী পথে চলতে থাকে, তবে তার রাজনীতির দিন শেষ। কারণ, এখনকার বাংলাদেশের জনগণ আর সেই পথে হাঁটবে না।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

সংস্কারের প্রাসঙ্গিকতা
ইসকনের যত আপত্তিকর কর্মকাণ্ড
দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করতে হবে
ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক উস্কানির ফাঁদ পাতা হচ্ছে
বিজেপির হুমকির যথাযথ জবাব দিতে হবে
আরও

আরও পড়ুন

আইপিএল নিলামে নাম না তোলার ব্যাখ্যা দিলেন ইংলিশ অলরাউন্ডার

আইপিএল নিলামে নাম না তোলার ব্যাখ্যা দিলেন ইংলিশ অলরাউন্ডার

‘চিকিৎসা নিতে করাচি যান, ভারতে নয়’, বাংলাদেশিদের ভিসা বাতিলের দাবি শুভেন্দুর

‘চিকিৎসা নিতে করাচি যান, ভারতে নয়’, বাংলাদেশিদের ভিসা বাতিলের দাবি শুভেন্দুর

বৃষ্টির কবলে দ. আফ্রিকা-শ্রীলঙ্কা প্রথম টেস্ট

বৃষ্টির কবলে দ. আফ্রিকা-শ্রীলঙ্কা প্রথম টেস্ট

ইসকন দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে - বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন

ইসকন দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে - বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন

আওয়ামী নেতাদের নির্দেশে চট্রগ্রামে নৈরাজ্য সৃষ্টির ব্যর্থ চেষ্টা

আওয়ামী নেতাদের নির্দেশে চট্রগ্রামে নৈরাজ্য সৃষ্টির ব্যর্থ চেষ্টা

সাত কলেজ অনার্স প্রথম বর্ষের কালকের পরীক্ষা স্থগিত

সাত কলেজ অনার্স প্রথম বর্ষের কালকের পরীক্ষা স্থগিত

নাঙ্গলকোট উপজেলা যুবদলের ১২ নেতাকর্মীর পদত্যাগ কমিটি বাতিলের দাবি

নাঙ্গলকোট উপজেলা যুবদলের ১২ নেতাকর্মীর পদত্যাগ কমিটি বাতিলের দাবি

মহারাষ্ট্রে মুখ্যমন্ত্রী পদ নিয়ে মহা জট, ফড়নবিশকে জরুরি তলব দিল্লিতে

মহারাষ্ট্রে মুখ্যমন্ত্রী পদ নিয়ে মহা জট, ফড়নবিশকে জরুরি তলব দিল্লিতে

সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান ফখরুল ইসলামের

সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান ফখরুল ইসলামের

আইনজীবী সাইফুল হত্যাকারী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী বহিষ্কার

আইনজীবী সাইফুল হত্যাকারী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী বহিষ্কার

আইনজীবী হত্যার অবিলম্বে বিচার চাই -ইসলামী আন্দোলন ঢাকা জেলা দক্ষিণ

আইনজীবী হত্যার অবিলম্বে বিচার চাই -ইসলামী আন্দোলন ঢাকা জেলা দক্ষিণ

ফ্যাসিবাদের দোসর উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ইসকন’কে নিষিদ্ধ করা হোক আলহাজ হাফিজ সাব্বির আহমদ

ফ্যাসিবাদের দোসর উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ইসকন’কে নিষিদ্ধ করা হোক আলহাজ হাফিজ সাব্বির আহমদ

ভারতের প্রেসক্রিপশনে ইসকন বাংলাদেশে অশান্তি করছে: হাসনাত

ভারতের প্রেসক্রিপশনে ইসকন বাংলাদেশে অশান্তি করছে: হাসনাত

ডোমিনোজ পিৎজা এখন মহাখালীতে

ডোমিনোজ পিৎজা এখন মহাখালীতে

বিএনপি জনগণের দল, 'ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন দিন' অধ্যক্ষ সেলিম ভূইয়া

বিএনপি জনগণের দল, 'ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন দিন' অধ্যক্ষ সেলিম ভূইয়া

ইসকন ভারতের হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা বাস্তবায়নে দাঙ্গা লাগানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত দেশব্যাপী তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড়

ইসকন ভারতের হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা বাস্তবায়নে দাঙ্গা লাগানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত দেশব্যাপী তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড়

ডেঙ্গুতে আরও ৪ জনের মৃত্যু

ডেঙ্গুতে আরও ৪ জনের মৃত্যু

ইসকনের মিথ্যাচার ও ভারতীয় মিডিয়ার সিন্ডিকেট নিউজ

ইসকনের মিথ্যাচার ও ভারতীয় মিডিয়ার সিন্ডিকেট নিউজ

ঋণগ্রহীতা মারা যাওয়ার পর পাওনাদার তার পাওনা মাফ করে দেওয়া প্রসঙ্গে।

ঋণগ্রহীতা মারা যাওয়ার পর পাওনাদার তার পাওনা মাফ করে দেওয়া প্রসঙ্গে।

সংস্কারের প্রাসঙ্গিকতা

সংস্কারের প্রাসঙ্গিকতা