দুর্নীতি ও অর্থপাচারের বিস্ময়কর রেকর্ড
০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৯ এএম | আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৯ এএম
দেশে বর্তমানে সর্বাধিক আলোচ্য বিষয় হচ্ছে অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র, যা সাধারণ মানুষের কাছে আওয়ামী লীগারদের অবাধ লুটপাটের দলিল বলে গণ্য। ২৮ অগাস্ট দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক চিত্র জানতে খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠিত হয়। শ্বেতপত্রের খ-াংশ দেশের ও বিদেশের মিডিয়ায় হাইলাইট হয়েছে। সে খবর এবং এ বিষয়ে কমিটির সদস্যদের সংবাদ সম্মেলনের খবর অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের শাসনামলে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে চোরতন্ত্র বা লুটপাটতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি লুটপাটের শিকার হয়েছে যথাক্রমে ব্যাংক খাত, ভৌত অবকাঠামো খাত, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত এবং আইসিটি খাত। ২৮টি উপায়ে এই দুর্নীতি হয়েছে। এছাড়া, উন্নয়ন বাজেটের ৪০ শতাংশ অর্থ তছরুপ হয়েছে। এসব দুর্নীতিতে রাজনৈতিক, সামরিক ও বেসামরিক আমলা, বিচার বিভাগসহ সবাই অংশ নিয়েছে। আলোচ্য সময়ে প্রতিবছর পাচার হয়েছে ১৬ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ গত ১৫ বছরে দেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে, যা দিয়ে ৭৮টি পদ্মাসেতু করা সম্ভব। মূলত তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনই এই বিষবৃক্ষ তৈরি করেছে। অর্থনৈতিক শ্বেতপত্রসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলের দুর্নীতি, লুণ্ঠন ও আর্থিক কারচুপির যে তথ্য পাওয়া গেছে তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো। দুর্নীতির মাধ্যমেই কিছু মানুষ আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ বনেছে। ফলে ১০ শতাংশ মানুষ দেশের ৮৫ শতাংশ সম্পদের মালিক হয়েছে। বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে মেগা প্রকল্পগুলোতে। উপরন্তু শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, উক্ত সময়ে রাজনৈতিক প্রভাব ব্যাংকিং খাতের সংকটকে গভীর করেছে। ফলে গত জুন শেষে মোট মন্দ ঋণ ছিল ৬ লাখ ৭৫ হাজার ৩০ কোটি টাকা। এই অর্থ দিয়ে ১৪টি মেট্রো রেল ও ২৪টি পদ্মাসেতু করা যেত। অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র গ্রহণ করে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘প্রতিবেদনে যে চিত্র উঠে এসেছে, তা শুনে আমরা আতঙ্কিত। এটা রক্ত হিম করার মতো ঘটনা। গরিব মানুষের টাকা লুটপাট হয়েছে। খবরে প্রকাশ, শেখ হাসিনার সরকারের সময়ের দুর্নীতির ৬০% টাকা বিভিন্ন দেশে পাচার হয়েছে আর বাকী ৪০% টাকা দেশে ব্যবহার হয়েছে। ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ানের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠরা যুক্তরাজ্যে সম্পত্তি ক্রয় করতে বিপুল অর্থ ব্যয় করেছেন, যার মোট পরিমাণ ৪০ কোটি পাউন্ডের বেশি। উক্ত রিপোর্টে এই ঘনিষ্ঠদের মধ্যে অনেকের নাম ও সম্পদের পরিমাণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে গত ১ ডিসেম্বর প্রকাশিত বিবিসির বাংলা খবরে। খবরে আরো বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠরা শুধু যুক্তরাজ্যেই নয়, সেই সাথে দুবাই ও সিঙ্গাপুরেও বিপুল সম্পদ গড়েছে। অপরদিকে, টিআইবি বাংলাদেশের ২০২৩ সালের দুর্নীতিগ্রস্ত খাতের তথ্য প্রকাশ করেছে সম্প্রতি। সে মতে, ক্রমান্বয়ে রয়েছে পাসপোর্ট অফিস, বিআরটিএ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। স্মরণীয় যে, গত সরকারের সময়ে বিপুল ঋণের মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের সময়ই মেগা দুর্নীতি হচ্ছে বলে বিরোধী দলগুলো থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল। এ নিয়ে মিডিয়ায়ও অনেক খবর প্রকাশিত হয়েছে। দুর্নীতির অর্থে কারা কানাডা, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বেগম পাড়া ও সেকেন্ড হোম করেছে, তার খবর প্রকাশিত হয়েছে বহু বার। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) রিপোর্টে এবং টিআইবির রিপোর্টেও দেশের দুর্নীতি ও অর্থ পাচার নিয়ে বলা হয়েছে বহুবার। তবুও তৎকালীন সরকার, এমনকি পূর্ববর্তী সরকারগুলো এসবে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেনি। তাই দুর্নীতি বেড়েই চলেছে। টিআই ২০২৩ সালের দুর্নীতির ধারণা সূচক প্রকাশ করেছে সম্প্রতি। সে মতে, দুর্নীতিতে বাংলাদেশের দুই ধাপ অবনমন হয়েছে। দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ১০ম স্থানে রয়েছে। আগের বছর ছিল ১২তম।
পতিত আওয়ামী সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম মুহিত একবার বলেছিলেন, দেশের সম্পদের ৬০% কালো টাকা। আগে পুকুর চুরি হতো এখন সাগর চুরি হয়। টিআইয়ের তথ্য মতে, দুর্নীতিতে বাংলাদেশ পরপর তিন বছর বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল, ব্যবসায়ীরাই দুর্নীতি বেশি করে পণ্যের আন্ডার ইনভয়েস ও ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে। গত জুলাইয়ে মাননীয় হাইকোর্ট বলেছেন, দুর্নীতি দেশে সুশাসন ও উন্নয়নের অন্তরায়। তাই যে কোনো উপায়ে দুর্নীতি-অর্থ পাচার বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশ থেকে ৫০ বছরে ১১ লাখ ৯২ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে বলে গত জুনে জানিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। বিচার বিভাগসহ দেশের সব বিভাগে দুর্নীতি ক্যান্সারের মতো ছেয়ে গেছে বলে গত সেপ্টেম্বরে মন্তব্য করেছেন প্রধান বিচারপতি। স্মরণীয় যে, দুর্নীতির কারণে প্রতিবছর প্রবৃদ্ধির হার ২-৩% কম হচ্ছে। উপরন্তু সম্পদ বৈষম্য বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রায় সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছে। তাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।
যা’হোক, দুর্নীতি ও অর্থ পাচার দেশের সার্বিক উন্নতি ও শান্তির চরম অন্তরায়। তাই এই ক্যান্সারকে নির্মূল করতে হবে। সে জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিচার বিভাগসহ সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে পূর্ণভাবে স্বাধীন, শক্তিশালী ও কার্যকর এবং নির্বাহী বিভাগের আওতামুক্ত করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক (অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মাসদার হোসেন ৩ ডিসেম্বর বলেছেন, ‘২০০৭ সালে আমার মামলায় (মাসদার হোসেন মামলায়) বিচার বিভাগকে কাগজ-কলমে আংশিক স্বাধীন করা হলেও আসলে এটি স্বাধীন হয়নি)। উপরন্তু দুর্নীতির বিচারগুলো স্বল্প সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি এবং দোষী ব্যক্তিকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তাহলেই দুর্নীতি নির্মূল না হলেও অধিকাংশ বন্ধ হয়ে যাবে। দুর্নীতি বন্ধ হলেই অর্থ পাচার বন্ধ হয়ে যাবে। অপরদিকে, অর্থ পাচার বন্ধ করার জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। চিহ্নিত অর্থ পাচারকারীদের স্বল্প সময়ের মধ্যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তাহলে ভবিষ্যতে কেউ অর্থ পাচার করার সাহস পাবে না। দ্বিতীয়ত, আমদানি ও রফতানির ক্ষেত্রে কেউ যেন আন্ডার ইনভয়েস ও ওভার ইনভয়েস করতে না পারে সেদিকে কঠোর দৃষ্টি রাখতে হবে। এছাড়া, এ পর্যন্ত যে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে তার শতভাগ দেশে ফেরত আনতে হবে। শেখ পরিবারের সব সদস্য ও সংশ্লিষ্টদের দেশে-বিদেশে সম্পদ অনুসন্ধানের জন্য দুদক, সিআইডি ও এনবিআর সমন্বয়ে ১০টি টিম গঠন করা হয়েছে এবং টিম কাজ শুরু করেছে বলে খবরে প্রকাশ। এই টিম যেন সঠিকভাবে কাজ করে এবং তার সুফল পাওয়া যায় সেটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা। এছাড়া, গত সেপ্টেম্বরে বিদেশে থাকা বাংলাদেশিদের অবৈধ সম্পদ জরুরি ভিত্তিতে ফ্রিজ করার আহ্বান জানিয়েছে টিআইবিসহ যুক্তরাজ্যভিত্তিক চারটি দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা। অবশ্য ইতোমধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে গত ২৯ সেপ্টেম্বর একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সম্প্রতি বলেছেন, বিগত সরকারের আমলে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থের গন্তব্য চিহ্নিত করে তা ফিরিয়ে আনতে জোরালো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র উদ্যোগ নিলেই হবে না, পাচার হওয়া অর্থের সন্ধান পাওয়ার সাথে সাথে তা দেশে ফেরত এনে সরকারি কোষাগারে জমা করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলেই দুর্নীতি ও অর্থ পাচার বন্ধ হয়ে যাবে, আয় বৈষম্যও কমে যাবে। সার্বিক উন্নতি ত্বরান্বিত হবে। মনে রাখতে হবে, বৈষম্য নিরসন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রধান আকাক্সক্ষা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
সউদী আরবকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের
গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহত আরও ৩৬
যুক্তরাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ রফতানিতে চীনের নিষেধাজ্ঞা
বিক্ষোভের মুখে প্রত্যাহার দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক আইন
সিরিয়ার প্রেসিডেন্টকে সতর্ক করে যা বললেন এরদোগান
নভেম্বরে রপ্তানি আয় বেড়েছে ১৫.৬৩ শতাংশ
সৈয়দপুরে পিকআপের ধাক্কায় এক শ্রমিক নিহত
শিক্ষার্থীদের মারধর ও শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার প্রতিবাদে শ্রমিকদের সঙ্গে খুবি শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতীয় ষড়যন্ত্র বরদাস্ত করা হবে না : বিক্ষোভ মিছিলে খেলাফত আন্দোলন
আগরতলায় সহকারি হাইকমিশনে উগ্রবাদীদের হামলার প্রতিবাদে চাঁদপুরে খেলাফত মজলিস বিক্ষোভ
বগুড়ায় ম্যাজিষ্ট্রেটের সিল-স্বাক্ষর জাল করার অভিযোগে ৩ প্রতারক গ্রেফতার
পিলখানা হত্যা, শাপলা চত্বরে গণহত্যা ও ২৪'র গণহত্যার বিচারের জন্য ছাত্র ঐক্যের প্রয়োজন: শিবির সভাপতি
‘কুটনীতিকদের উপর আক্রমণ করে ভারত নিজেদের অসভ্য জাতি হিসেবে পরিচয় দিয়েছে’
ষড়যন্ত্র রুখতে সরকারের পাশে থাকবে বিএনপি
ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ইস্যু নিয়ে ব্যাপক মিথ্যা ও অপতথ্য ছড়ানোয় বিএফইউজে ও ডিইউজের উদ্বেগ
স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য
ইনকিলাব সাংবাদিকের বাসায় দুর্ধর্ষ চুরি
পঞ্চগড়ে বিএনপির আনন্দ মিছিল
অব্যবহৃত মসজিদ বা তার জায়গা সংরক্ষণ করা প্রসঙ্গে?
চা শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করুন