সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে জাতি ঐক্যবদ্ধ
০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৯ এএম | আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৯ এএম
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে ভারতের হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকার এবং তাঁর চেলা-চামুন্ডা, কতিপয় বিরোধী দল এবং মিডিয়া বিরতিহীনভাবে অন্তর্বর্তীকালীন ইউনূস সরকারকে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে ফের একটি তাবেদার সরকার গঠনে উঠেপড়ে লেগেছে। আর এই কাজে ইন্ধন যোগাচ্ছে দিল্লিতে অবস্থান করা পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা এবং দেশ-বিদেশে অবস্থান করা তার দোসর ও ছদ্মবেশী এজেন্টরা। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি আমেরিকার নিউইয়র্কে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সাথে এক ভার্চুয়াল আলোচনায় শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। ওই আলোচনায় শেখ হাসিনা দাবি করেন, ড. ইউনূসের ইন্ধনেই বাংলাদেশে গণহত্যা চলছে, বেছে বেছে সংখ্যালঘুদের টার্গেট করা হচ্ছে। মন্দির, গির্জা ও ধর্মীয় সংগঠন ইসকনের উপর হামলা চলছে। আজ পুলিশ, শিক্ষক, হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের উপর হামলা হচ্ছে বাংলাদেশে। খুন পর্যন্ত করা হচ্ছে তাদের। একাধিক গির্জা ও মন্দিরে হামলা চালানো হয়েছে, ভাঙচুর করা হয়েছে। বাংলাদেশে এখন কেন সংখ্যালঘুদের উপর হামলা চালানো হচ্ছে?
হাসিনা সরকারের পালানোর পরই দিল্লির হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকার বুঝে গেছে, এতদিন বাংলাদেশকে যেভাবে অঘোষিত কলোনি হিসেবে ব্যবহার করেছে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দাদাগিরি করেছে, আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের মনোরঞ্জন করে তার স্বার্থ রক্ষায় সর্বোতভাবে কাজ করেছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মতো গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর ভারতীয় কো¤পানিগুলোকে দিয়ে দিয়েছে। ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট-এর নামে নৌ, সড়ক ও রেলপথ ভারতীয়দের জন্য অনেকটা উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। এই একচেটিয়া সুবিধা নেওয়ার দিন শেষ হয়ে আসছে। এক কথায় আওয়ামী লীগ সরকার যেভাবে ভারতের তাবেদারি করেছে, গণঅভ্যুত্থান উত্তর অন্তর্বর্তী সরকার তা করবে না। কারণ, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস শপথ নেওয়ার আগেই ভারতের সংবাদমাধ্যম এনিডিটিভকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বাংলাদেশকে কেউ অস্থিতিশীল করতে চাইলে চারদিকে অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে পড়বে। প্রতিবেশী মিয়ানমার, ভারতের সেভেন সিস্টার্স, পশ্চিমবঙ্গ সব জায়গাতেই ছড়িয়ে পড়বে অস্থিরতা।
শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর এই বক্তব্যের পর ভারত সরকার উপলব্ধি করতে পেরেছিল, পাশা উলটে গেছে। ফলে মোদি সরকার শুরু থেকেই বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কল্পকাহিনিকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে বাংলাদেশ বিরোধী অবস্থান নিয়েছে। সর্বশেষ তারা ট্রা¤পকার্ড হিসেবে ইসকনের বহিষ্কৃত নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে মাঠে নামিয়েছিল। চিন্ময় কৃষ্ণ দাস বাংলাদেশের চট্টগ্রামসহ সারাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামে। এই অবস্থায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার একটি মামলায় বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত চিন্ময়কে আদালত কর্তৃক জামিন নামঞ্জুর হওয়াকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম জজকোর্ট প্রাঙ্গনে অরাজক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ইসকন। এই সময় ইসকনের নেতৃত্বে সশস্ত্র আক্রমণ করে চট্টগ্রাম জজকোর্টের আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। যদিও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই দেশের মানুষ ইসকনের চক্রান্তের ফাঁদে পা দেয়নি। দেশবাসী ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। এতে ভারতের হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর টার্গেট ফুলফিলে ব্যর্থ হয়ে অধৈর্য হয়ে উঠে। ফলে গত ২ ডিসেম্বর ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা করে বসে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষকে উস্কে দেয়ার জন্য কিছু ভারতীয় সনাতনী হিন্দুসমাজের ব্যানারে ফেনীর সীমান্তর্বর্তী পরশুরামের বিলোনিয়া স্থলবন্দরে বাংলাদেশবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে। এর আগে সিলেট সীমান্তেও বিক্ষোভ করেন ভারতীয়রা। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি) আয়োজনে মুম্বইয়ের বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনের কাছাকাছি বিক্ষোভ করেন। গত ২৮ নভেম্বর বঙ্গীয় হিন্দু জাগরণ নামের একটি সংগঠন কলকাতায় বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনের সামনে সহিংস বিক্ষোভ করে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ও প্রধান উপদেষ্টার কুশপুত্তলিকা পোড়ায়। আগারতলায় উগ্রবাদী হিন্দুদের নজিরবিহীন ওই হামলায় হাইকমিশন ভবনে ব্যাপক ভাঙচুরের পাশাপাশি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নামিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। হামলার পর থেকে বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে কনস্যুলার সেবা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ভারতের উগ্র সাম্প্রদায়িক হিন্দুরা বাংলাদেশ হাইকমিশনে নগ্ন হামলা ও বাংলাদেশ বিরোধী বিক্ষোভ করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা হিন্দু ঐক্যমঞ্চের ব্যানারে ‘বাংলাদেশ চলো’ কর্মসূচির মাধ্যমে সিলেট সীমান্তের ওপারে ভারতের অংশে পণ্যভর্তি প্রায় ৪ শতাধিক ট্রাক আটকে দিয়েছে। এতে আমদানি-রফতানি বন্ধ রয়েছে। ভারতের উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর বাংলাদেশবিরোধী অবস্থানের সাথে সুর মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বলেছেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশে জাতিসংঘের বিশেষ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা দরকার। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে যে ভারতীয়রা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের এই রাজ্যে ঠাঁই দিতে তৈরি আছি। তাদের খাদ্যের কোনো অসুবিধা হবে না বলেও আশ্বাস দিয়েছেন। ন্যাক্কারজনক এইসব ঘটনায় বাংলাদেশের মানুষ দল-মত, জাতি-ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ফুঁসে উঠেছে। বাংলাদেশের ৯৯ শতাংশ মানুষের সেন্টিমেন্ট ভারতের বিরুদ্ধে চলে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে এই ঘটনার আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করে প্রতিবাদপত্র হস্তান্তর করা হয়েছে একই সঙ্গে বাংলাদেশের সব কূটনৈতিক মিশন, পদস্থ কূটনীতিক, নন-কূটনীতিক স্টাফ মেম্বার এবং তাদের নিরাপত্তা নিñিদ্র করার পাশাপাশি ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কড়া পদক্ষেপ চেয়েছে বাংলাদেশ। সেইসঙ্গে আগরতলার বর্বোরচিত হামলার পুঙ্খানুপঙ্খ ঘটনায় তদন্ত এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ¯পষ্টভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে, ভারতীয় রাজনীতিবিদ, মিডিয়া এবং উগ্রপন্থি বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে আপত্তিকর বক্তব্য দেয়া হচ্ছে, যা বন্ধ না করলে মানুষে মানুষে গড়ে ওঠা দুই দেশের বহুমাত্রিক স¤পর্ক কেবলই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, হামলার ঘটনা বাংলাদেশ সরকারকে গভীরভাবে ক্ষুব্ধ করেছে। ঘটনাপ্রবাহ দেখে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, হামলাটি পূর্বপরিকল্পিত। এ ঘটনা কূটনৈতিক স¤পর্কবিষয়ক ভিয়েনা সনদের লঙ্ঘন। এ ছাড়া ওই হামলার ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভারতের আগ্রাসী তৎপরতার বিঠঝদ্ধে বিক্ষোভ করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছে। বিজয়ের মাসে বাংলাদেশবিরোধী অপশক্তি আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যে অপতৎপরতা চালাচ্ছে, তা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
যে জাতি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করছে, যে দেশে আবু সাঈদ, মুগ্ধদের জন্ম হয়, যে জাতি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বুলেটের সামনে নিরস্ত্র অবস্থায় বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যায়, সেই জাতিকে দেশি-বিদেশি কোনো অপশক্তি পদানত করতে পারবে না। আমরা মনে করি, অন্তর্বর্তী সরকারের হারানোর কিছু নেই। স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ। দেশের প্রয়োজনে যেকোনো ত্যাগ শিকারে জাতি প্রস্তুত।
লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
সউদী আরবকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের
গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহত আরও ৩৬
যুক্তরাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ রফতানিতে চীনের নিষেধাজ্ঞা
বিক্ষোভের মুখে প্রত্যাহার দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক আইন
সিরিয়ার প্রেসিডেন্টকে সতর্ক করে যা বললেন এরদোগান
নভেম্বরে রপ্তানি আয় বেড়েছে ১৫.৬৩ শতাংশ
সৈয়দপুরে পিকআপের ধাক্কায় এক শ্রমিক নিহত
শিক্ষার্থীদের মারধর ও শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার প্রতিবাদে শ্রমিকদের সঙ্গে খুবি শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতীয় ষড়যন্ত্র বরদাস্ত করা হবে না : বিক্ষোভ মিছিলে খেলাফত আন্দোলন
আগরতলায় সহকারি হাইকমিশনে উগ্রবাদীদের হামলার প্রতিবাদে চাঁদপুরে খেলাফত মজলিস বিক্ষোভ
বগুড়ায় ম্যাজিষ্ট্রেটের সিল-স্বাক্ষর জাল করার অভিযোগে ৩ প্রতারক গ্রেফতার
পিলখানা হত্যা, শাপলা চত্বরে গণহত্যা ও ২৪'র গণহত্যার বিচারের জন্য ছাত্র ঐক্যের প্রয়োজন: শিবির সভাপতি
‘কুটনীতিকদের উপর আক্রমণ করে ভারত নিজেদের অসভ্য জাতি হিসেবে পরিচয় দিয়েছে’
ষড়যন্ত্র রুখতে সরকারের পাশে থাকবে বিএনপি
ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ইস্যু নিয়ে ব্যাপক মিথ্যা ও অপতথ্য ছড়ানোয় বিএফইউজে ও ডিইউজের উদ্বেগ
স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য
ইনকিলাব সাংবাদিকের বাসায় দুর্ধর্ষ চুরি
পঞ্চগড়ে বিএনপির আনন্দ মিছিল
অব্যবহৃত মসজিদ বা তার জায়গা সংরক্ষণ করা প্রসঙ্গে?
চা শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করুন