মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে কী পরিবর্তন আসছে?
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১৩ এএম | আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১৩ এএম
পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির দেশ সিরিয়া। এই অঞ্চলটি ইসলামপূর্ব যুগ থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। এই ভূমিতে জন্মগ্রহণ করেছেন অসংখ্য নবী। তারা বসবাসও করেছেন এখানে। হযরত ইব্রাহিম (আ.) নিজ সম্প্রদায়ের বিরোধিতার মুখে পড়ে আল্লাহর আদেশে সিরিয়া ভূমিতে হিজরত করেন। এখানে জন্মগ্রহণ করেন হযরত ঈসা (আ.)। হযরত মুসা (আ.) হিজরত করে আগমন করেছিলেন এখানে। সিরিয়া তৎকালীন সময়ে শাম বলে পরিচিত ছিল। বর্তমান সিরিয়া, ফিলিস্তিন, লেবানন ও জর্ডান এই শাম ভূমির অন্তর্ভুক্ত। এই শামের সঙ্গে ভবিষ্যতের ও কেয়ামতপূর্ব অনেক ঘটনাও জড়িত রয়েছে। ইমাম মাহাদীর হাতে বাইয়াত, হযরত ঈসা (আ.) আগমন, দাজ্জালের হত্যাসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হবে বলে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এই শামদেশ বা সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের শাসনের শুরু হয় ১৯৭০ সালে। ৫৪ বছর ধরে এ পরিবার দেশটির রাজনীতিতে একক আধিপত্য ধরে রাখে। তাদের শাসন আমল চিহ্নিত হয়েছে গৃহযুদ্ধ, গণহত্যা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য। বাশারের বাবা হাফিজ আল আসাদ ১৯৭০ সালে একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। সিরিয়ার বাথ পার্টির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং সামরিক বাহিনীতে শক্তিশালী অবস্থানের কারণে তিনি ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেন। তার শাসন ছিল কেন্দ্রীয়করণ এবং কঠোর নিয়ন্ত্রণের প্রতীক। ১৯৮২ সালে হামা শহরে মুসলিম ব্রাদারহুডের বিদ্রোহ দমনে তার আদেশে যে গণহত্যা চালানো হয়, তাতে ১০ থেকে ২০ হাজার মানুষ নিহত হয়। এই ঘটনা তার শাসনের এক কাল অধ্যায় হিসেবে ইতিহাসে লেখা রয়েছে। ২০০০ সালে বাশার আল আসাদ ক্ষমতায় আসেন। পেশায় একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ বাশারকে প্রথমে একজন সংস্কারপন্থী নেতা হিসেবে দেখা হলেও ক্ষমতায় আসার পর তিনি তার বাবার মতই কঠোর নীতি অনুসরণ করেন। ২০১১ সালে আরব বসন্তের ঢেউ সিরিয়ায় পৌঁছানোর পর বাশারের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। জনগণ গণতান্ত্রিক অধিকার এবং মুক্তির দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে, যা বাশার আল আসাদের শাসনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে। তবে সংলাপের পরিবর্তে আল আসাদ কঠোর দমননীতি গ্রহণ করেন। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের উপর সামরিক অভিযান এবং রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের কারণে দেশটি ধীরে গৃহযুদ্ধের মধ্যে ডুবে যায়। এই যুদ্ধে প্রায় ছয় লক্ষ মানুষ নিহত হয় এবং প্রায় এক কোটি মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে লেবানন, জর্ডান এবং তুরস্কে শরণার্থী হয়েছে। গত ৮ ডিসেম্বর বিদ্রোহীদের দামেস্কে প্রবেশের মধ্য দিয়ে বাশার আল আসাদের ২৫ বছরের দুঃশাসনের অবসান ঘটে। বাশার আল আসাদ ক্ষমতা নেওয়ার আগে থেকেই সিরিয়ার তরুণদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, দুর্নীতি, রাজনৈতিক ও বাকস্বাধীনতার অভাববোধ থেকে তুমুল হতাশা ছিল, যা উস্কে দেয় আরব বসন্ত। কথিত আরব বসন্ত ব্যর্থ হওয়ার পর সিরিয়া গত ১৩ বছরের বেশি সময় ধরে ছিল গৃহযুদ্ধের জ্বলন্ত উনুন। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের কারণে ধন-মান-ঐতিহাসিক পুরাকীর্তিতে সমৃদ্ধ দেশ বর্তমানে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ইতিহাসের ভয়াবহতম মানবিক সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছে দেশটিকে।
২০১১ সালে বাশার আল আসাদ তার শাসনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকে নির্মমভাবে দমন করেছিলেন। তখন রাশিয়া ও ইরানের সহায়তায় বিরোধীদলকে নাস্তানাবুদ করেন বাশার। সেবারের মতো বেঁচে যান তিনি। রাশিয়া তখন তার শক্তিশালী বিমানবাহিনী ব্যবহার করেছিল। আর সিরিয়ায় সামরিক উপদেষ্টা পাঠিয়েছিল ইরান। প্রতিবেশী লেবাননের প্রতিরোধ সংগঠন হিজবুল্লাহ, যেটিকে সিরিয়া সমর্থন করে, তারা প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদের মোতায়েন করেছিল। তবে এবার আর তা হয়নি। রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর পর সেখানে যুদ্ধ করছে। গাজায় ইসরাইলের আগ্রাসনকে কেন্দ্র করে গত বছর হিজবুল্লাহ ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায়, যা এখনো চলছে। অন্যদিকে, ইসরাইলের সঙ্গে ইরানেরও পাল্টাপাল্টি কিছু হামলা হয়েছে। এরপর ইরান ইসরাইলকে মোকাবিলা করা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় সিরিয়ায় নতুন সংঘাতে সরাসরি জড়াতে চায়নি। মিত্রদের সহায়তা না পাওয়ায় ইসলামপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘হায়াত তাহরীর আল শামের’ নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী বাহিনীর বিরুদ্ধে কার্যত কোথাও কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি আসাদ বাহিনী। সিরিয়ায় আসাদের পতন ইরানের জন্য বড়সড় ধাক্কাই। কারণ, আসাদের সময় ইরান ও হিজবুল্লাহর মধ্যে যোগাযোগের অংশ ছিল সিরিয়া। হিজবুল্লাহকে অস্ত্র ও রসদ সরবরাহের ক্ষেত্রে সিরিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইসরাইলের সঙ্গে প্রায় এক বছর ধরে যুদ্ধে হিজবুল্লাহ দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং তাদের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত। ইরান সমর্থিত ইয়ামেনের হুতিযোদ্ধারাও বারবার হামলার শিকার হয়েছে। ইরাকের মিলিশিয়া ও গাজার হামাস যোদ্ধাসহ এসব গোষ্ঠীকে ইরান প্রতিরোধের অক্ষ মনে করে, যারা এখন ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন। ইরানের মিত্রদের এমন বিপর্যয়ই ইসরাইল উদযাপন করতেই পারে, কারণ তারা ইরানকে নিজেদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করে।
তুরস্কের মাথা ব্যথার কারণ ওই দেশে আশ্রয় নেয়া ৩০ লাখ সিরীয় শরণার্থী। এটি একটা স্পর্শকাতর সমস্যা। তাই রজব তাইপ এরদোয়ান কূটনৈতিক সমাধান আশা করেছিলেন, যাতে শরণার্থীদের ফেরত পাঠানো যায়। কিন্তু বাশার আল আসাদ আলোচনায় বসতে অস্বীকৃতি জানান। আসাদ পরিবারের বিদায়ে সিরিয়ার মানুষ খুশি কিন্তু ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
আসাদ সরকারের পতনের পরপরই সীমান্ত অতিক্রম করে সিরিয়ার ভূখ-ে ঢুকে পড়ে ইসরাইলি ট্যাঙ্ক। দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ পালানোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সিরিয়ার গোলান মালভূমিতে প্রবেশ করে তারা। ১৯৭৪ সালের পর এই প্রথমবার ইসরাইলের ট্যাঙ্ক সীমান্ত অতিক্রম করলো। ইসরাইলি বাহিনী গোলান মালভূমির সিরিয়া-ইসরাইল সীমান্তে তাদের সেনা উপস্থিতি বাড়িয়েছে। এ পদক্ষেপ সিরিয়ায় অভ্যন্তরে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইসরাইলি সেনারা জানিয়েছে, তারা গোলান মালভূমি এবং সীমান্তের আশেপাশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেনা পাঠিয়েছে। শুধু তাই নয় ইসরাইলি বাহিনী বলেছে, স্থানীয় সমস্যা ইসরাইলের দিকে যাওয়া ঠেকাতে তারা এই পদক্ষেপ নিয়েছে। ইসরাইলি সেনারা একই সঙ্গে লেবানন সীমান্তের কাছে থাকা একটি কনভয় আক্রমণ করে। যেগুলো সিরিয়া থেকে পালিয়ে লেবাননে যাচ্ছিল। এই কনভয়ে অন্তত ১৫০টি ট্যাঙ্ক ও সামরিক গাড়ি ছিল। ইসরাইলের সামরিক কার্যক্রমের মাধ্যমে সিরিয়ার অভ্যন্তরে আরো সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিদ্রোহীদের সঙ্গে ইসরাইলের সরাসরি সংঘর্ষ হলে পরিস্থিতি আরো জটিল আকার ধারণ করতে পারে।
সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতন মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন এক পালাবদল এনে দিতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। সেখানে ক্ষমতার ভারসাম্যেও বদল আসবে নিশ্চিতভাবে। ইরান, ফিলিস্তিন, ইসরাইল, লেবানন, ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর রাজনীতি নতুন রূপ নেবে। তবে এটি ইরানের জন্য হবে বড় ধরনের আঘাত। কারণ, সিরিয়া ইরানের অন্যতম মূল্যবান মিত্র। এতে কোনো সন্দেহ নাই যে, ইরান সরকার সিরিয়াকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে।
সিরিয়ায় নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। এই সরকারের উচিত হবে সিরিয়ার সব জাতি, সম্প্রদায় এবং ধর্মীয় উপাদানসহ সকল ভেদাভেদ ভুলে সব সিরিয়ানদের মঙ্গলের জন্য কাজ করা। কারণ, এই মুহূর্তে সিরিয়ার আঞ্চলিক অখ-তা রক্ষা করা খুবই দরকার। আমরা এমন এক সিরিয়া দেখতে চাই যেখানে শান্তি ও স্বস্তি বিরাজ করবে; যেখানে কেউ বাদ পড়ে না, কেউ নিপীড়নের শিকার হয় না, কারো অধিকার ও স্বাধীনতা লঙ্ঘিত হয় না এবং বিভিন্ন পরিচয়ের মানুষ শান্তিতে পাশাপাশি বাস করে।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ইসরাইলের বিমানবন্দরে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হুতিদের
ভর শীতে ও গারো পাহাড় সীমান্তাঞ্চলের বিলে-ঝিলে দেখা মিলছে না অতিথি পাখির!
এ বছর আর হচ্ছে না বিজিবি-বিএসএফের বৈঠক
দীর্ঘদিন শরীর সুস্থ রাখার উপায়
গফরগাঁওয়ে ভয়াবহ ব্রহ্মপুত্র ট্রেন দুর্ঘটনা: গুরুতর আহত ১
বাসের ধাক্কায় দুমড়েমুচড়ে গেল প্রাইভেটকার, নিহত ৫
যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম গুরুতর বার্ড ফ্লু সংক্রমণে মিউটেশন, শনাক্ত একজন
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
সূর্যের নিকটতম যাত্রা, নিরাপদে ফিরে এলো নাসার পার্কার সোলার প্রোব
দোয়ারাবাজার পল্লীতে যুবক খুন
স্পেনগামী সমুদ্রপথে ২০২৪ সালে অভিবাসীদের রেকর্ড সংখ্যক মৃত্যু
অভিনয়ের জন্য গোসল করতেন না অনিল কাপুর
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০২৫ সালে রাশিয়া সফর করবেন
শেষ বিকেলে দ্রুত উইকেট হারিয়ে চাপে ভারত
বিশিষ্ট ব্যবসায়ী টাইম ওয়ার্নারের প্রাক্তন সিইও রিচার্ড ডি. পারসন্সের মৃত্যু
নারীকে যৌন নিপীড়ন: খোদ মহারাষ্ট্রে ইসকন সন্ন্যাসী জুতাপেটা
অনূর্ধ্ব-১৯ নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দল ঘোষণা
আফগানিস্তানকে পেয়ে আবারও জ্বলে উঠলেন উইলিয়ামস
অস্ট্রিয়ার তিরোলে তুষারধসে বাবা-ছেলের মৃত্যু
বিয়ে-বাচ্চা সব মানুষ হওয়ায় দিছে: জেফার