ঢাকা   শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৩ পৌষ ১৪৩১

সচিবালয়ে আগুন সন্দেহজনক

Daily Inqilab ইনকিলাব

২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১৩ এএম | আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১৩ এএম

বাংলাদেশ সচিবালয়কে সরকারের কর্মকাণ্ড তথা আমলাতন্ত্রের হৃদপিণ্ড বলা হয়। এটি দেশের প্রধান কেপিআই বা সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনা এলাকা হিসেবে বিবেচিত। এর নিরাপত্তা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের অংশ। সেই সচিবালয়ে মধ্যরাতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সেই আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ১৯টি ইউনিটকে ৬ ঘণ্টা ধরে কাজ করতে হয়েছে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত সচিবালয়ে আগুন লাগার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেয়ার পর আগুনের এমন লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়া এবং ৬ ঘণ্টা ধরে জ্বলতে থাকা জনমনে সন্দেহ ও নানামুখী জল্পনার জন্ম দিয়েছে। সচিবালয়ের প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের দপ্তরগুলোতে নিজস্ব স্বয়ংক্রিয় অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা থাকার কথা এবং সচিবালয়ের অভ্যন্তরে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি সর্বদা প্রস্তুত থাকার কথা। এতকিছুর পরও একাধিক প্রান্তে আগুন লেগে দাহ্য পদার্থের মতো অগ্নিশিখা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে উপরের দিকে ওঠার বিষয়টিকে স্বাভাবিক দুর্ঘটনা হিসেবে মেনে নেয়া যায় না। সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে এই অগ্নিকা- সংঘটিত হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, ছাত্র-জনতার প্রতিনিধি নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদের দফতর এই ভবনে অবস্থিত। এই ভবনে অর্থ, সড়ক, পানি সম্পদ ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অফিসগুলো রয়েছে। আমরা জানি, বিগত ১৬ বছরে এ সব মন্ত্রণালয়ে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি ও তহবিল তছরুপের ঘটনা ঘটেছে। অন্তর্বর্তী সরকার দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে মেগা দুর্নীতির অভিযোগগুলোর তদন্ত শুরু করেছে। এহেন বাস্তবতায় সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনের অগ্নিকা-কে দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ ধ্বংস করার নাশকতা হিসেবেই মনে করছে সাধারণ মানুষ।

সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জনমনে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় চলছে। ঘটনার প্রকৃতি, পরম্পরা এবং সামগ্রিক বিচার-বিশ্লেষণে একে একটি নাশকতার ঘটনা হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। ঘটনার তদন্তে ৭ সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। সচিবালয়ে রাত দেড়টায় আগুন লাগা এবং পরবর্তী নানা ঘটনাক্রম পর্যালোচনায় নাশকতার যেসব আলামত তুলে ধরা হচ্ছে তা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। গত ১৬ বছর ধরে শেখ হাসিনার দুর্নীতি-দুঃশাসনের দোসর ছিল প্রতিটি সেক্টরে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। মন্ত্রী-এমপি ও দলীয় ক্যাডাররা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও সচিবালয়ে থাকা স্বৈরাচারের পদন্নোতিপ্রাপ্ত ও সুবিধাভোগী আমলারা বহাল তবিয়তেই আছেন। গত ৫৩ বছরেও আমলাতন্ত্রের ভেতর লুকিয়ে থাকা দুষ্টচক্রকে চিহ্নিত ও নির্মূল করার তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্র-জনতার নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ইতোমধ্যে প্রশাসনিক সংস্কারের লক্ষ্যে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে এবং সেই কমিশনের সুপারিশের পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল উত্তেজনাও দেখা যাচ্ছে। পরিবর্তনের বিপক্ষের আমলারা সরকারের প্রতি আল্টিমেটামসহ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। সচিবালয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অনেক প্রশ্নই উঠে আসছে। মেগা দুর্নীতির সাথে মন্ত্রী-আমলাদের যোগসাজশের ঘটনাগুলোর তথ্য-প্রমাণ ধ্বংস করার পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলা, দেশে অস্থিতিশীলতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির আওয়ামী ও ভারতীয় এজেন্ডার যোগাসাজশের কথা বলা হচ্ছে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দিল্লিতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই একের পর এক ইস্যু সৃষ্টি করে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার তৎপরতার সাথে পতিত স্বৈরাচারের প্রেতাত্মারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। সচেতন ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধে তাদের চক্রান্ত ব্যর্থ হলেও তারা থেমে নেই। দিল্লিতে বসে শেখ হাসিনার নাশকতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির নির্দেশনা এখন আর কোনো গোপন বিষয় নয়। কিন্তু এনজিও মার্কা অন্তর্বর্তী সরকার সেসব ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় কার্যকর কর্মপন্থা গ্রহণ করতে বার বার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। সচিবালয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির নানাবিধ তৎপরতার অংশ হিসেবে আনসারদের দিয়ে সচিবালয় দখলের চেষ্টা, দাবি-দাওয়া নিয়ে ছাত্রদের সচিবালয়ে প্রবেশের ঘটনাও গত চার-পাঁচ মাসে একাধিকবার ঘটেছে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের উপর ভারতীয় আধিপত্যবাদী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মূল শক্তি ছিল আওয়ামী লীগসহ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা ভারতীয় এজেন্ট এবং আমলাতন্ত্র। দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের পুরনো বন্দোবস্ত ভেঙ্গে দিতে ছাত্র-জনতার জোরালো দাবির বিপরীতে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান খুবই দুর্বল। একটি বিপ্লবী সরকারের উপর একই সঙ্গে জনগণের ব্যাপক প্রত্যাশা এবং পরাজিত শক্তির প্রতিবিপ্লবী অপতৎপরতার চাপ সক্রিয় থাকে। ইতোমধ্যে সরকারের অভ্যন্তরে পরাজিত শক্তির দোসরদের অবস্থান ও সক্রিয় তৎপরতার নানা অভিযোগ উঠে এসেছে। সরকারের অভ্যন্তরে সমন্বয়হীনতা এবং দুর্বলতা অনেকটাই স্পষ্ট। শুধু প্রধান উপদেষ্টা বা কয়েকজন ছাত্র উপদেষ্টার পক্ষে এসব চাপ মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও ক্ষমতা ও নির্বাচনকেন্দ্রিক মতানৈক্য দেখা দিতে শুরু করেছে। দেড় দশকের বেশি সময় ধরে অগণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে থেকে যে ফ্যাসিবাদী প্রশাসন গড়ে তোলা হয়েছিল, তা রাতারাতি আমূল বদলে ফেলা সম্ভব না হলেও পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকারের দুর্বলতা দেশের জন্য বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। অনেকে মনে করছেন, লাখ লাখ কোটি টাকা দুর্নীতির সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের তদন্ত, জনপ্রশাসনের সংস্কার প্রস্তাবসহ পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ এবং এর বিরোধীদের তৎপরতা, ভারতীয় গণমাধ্যম ও আওয়ামী লীগের পরিকল্পিত অপপ্রচার, অব্যাহত হুমকি এবং সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা একই সূত্রে গাঁথা। পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের শেকড়সহ উপড়ে ফেলা ছাড়া রাষ্ট্রবিরোধী চক্রান্তের ঘেরাটোপ থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়। যে কোনো তদন্তের আগে শর্ষের ভেতরে ভূতকে চিহ্নিত করে এগুতে হবে। দ্রুততম সময়ে সচিবালয়ে অগ্নিকা-ের নেপথ্যের তথ্য এবং ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের সাথে সাথে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

শুধু নামেই জিমনেসিয়াম
মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে কী পরিবর্তন আসছে?
অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতদ্বৈততা কাম্য নয়
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের যত্ন নিতে হবে
সংবিধান সংশোধন-পুনর্লিখন প্রসঙ্গে
আরও

আরও পড়ুন

চলছে বিক্ষোভ, তারেক রহমানকে স্মারকলিপি, জবির অন্যান্য সংগঠনের প্রতিবাদ

চলছে বিক্ষোভ, তারেক রহমানকে স্মারকলিপি, জবির অন্যান্য সংগঠনের প্রতিবাদ

চীনে তৈরি হবে বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ বাঁধ

চীনে তৈরি হবে বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ বাঁধ

কোহলির আরও বড় শাস্তি প্রাপ্য ছিল: পন্টিং

কোহলির আরও বড় শাস্তি প্রাপ্য ছিল: পন্টিং

বান্দরবানে আগুন দিয়ে ১৭ ঘর পুড়ে দেয়ার সাথে জড়িত দের ছাড় দেয়া হবে না- পার্বত্য উপদেষ্টা

বান্দরবানে আগুন দিয়ে ১৭ ঘর পুড়ে দেয়ার সাথে জড়িত দের ছাড় দেয়া হবে না- পার্বত্য উপদেষ্টা

জাহাজ সেভেন মার্ডারের খুনি ধর্মান্তরিত ইরফানের অজানা কাহিনী

জাহাজ সেভেন মার্ডারের খুনি ধর্মান্তরিত ইরফানের অজানা কাহিনী

খুলনার তাবলীগ মসজিদ এলাকায় সেনাবাহিনীর টহল

খুলনার তাবলীগ মসজিদ এলাকায় সেনাবাহিনীর টহল

দেশে কি চাঁদাবাজি বন্ধ হয়েছে? জামায়াত আমীরের প্রশ্ন

দেশে কি চাঁদাবাজি বন্ধ হয়েছে? জামায়াত আমীরের প্রশ্ন

ভারতে ইসকন মন্দিরে চিন্ময়ের আইনজীবীর বৈঠক

ভারতে ইসকন মন্দিরে চিন্ময়ের আইনজীবীর বৈঠক

নির্বাচনে অংশ নিতে খালেদা জিয়া-তারেক রহমানের আইনগত কোনো বাধা নেই : অ্যাটর্নি জেনারেল

নির্বাচনে অংশ নিতে খালেদা জিয়া-তারেক রহমানের আইনগত কোনো বাধা নেই : অ্যাটর্নি জেনারেল

শুরু হয়েছে অনির্দিষ্টকালের নৌ ধর্মঘট, বন্ধ রয়েছে পায়রা বন্দরের পণ্য খালাস কার্যক্রম

শুরু হয়েছে অনির্দিষ্টকালের নৌ ধর্মঘট, বন্ধ রয়েছে পায়রা বন্দরের পণ্য খালাস কার্যক্রম

'কাঠামোর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোকে গণতান্ত্রিক উপযোগী করলেই আমরা গণতন্ত্রকে সফল করতে পারব

'কাঠামোর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোকে গণতান্ত্রিক উপযোগী করলেই আমরা গণতন্ত্রকে সফল করতে পারব

ইসরাইলের বিমানবন্দরে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হুতিদের

ইসরাইলের বিমানবন্দরে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হুতিদের

ভর শীতে ও গারো পাহাড় সীমান্তাঞ্চলের বিলে-ঝিলে দেখা মিলছে না অতিথি পাখির!

ভর শীতে ও গারো পাহাড় সীমান্তাঞ্চলের বিলে-ঝিলে দেখা মিলছে না অতিথি পাখির!

এ বছর আর হচ্ছে না বিজিবি-বিএসএফের বৈঠক

এ বছর আর হচ্ছে না বিজিবি-বিএসএফের বৈঠক

দীর্ঘদিন শরীর সুস্থ রাখার উপায়

দীর্ঘদিন শরীর সুস্থ রাখার উপায়

গফরগাঁওয়ে ভয়াবহ ব্রহ্মপুত্র ট্রেন দুর্ঘটনা: গুরুতর আহত ১

গফরগাঁওয়ে ভয়াবহ ব্রহ্মপুত্র ট্রেন দুর্ঘটনা: গুরুতর আহত ১

বাসের ধাক্কায় দুমড়েমুচড়ে গেল প্রাইভেটকার, নিহত ৫

বাসের ধাক্কায় দুমড়েমুচড়ে গেল প্রাইভেটকার, নিহত ৫

যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম গুরুতর বার্ড ফ্লু সংক্রমণে মিউটেশন, শনাক্ত একজন

যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম গুরুতর বার্ড ফ্লু সংক্রমণে মিউটেশন, শনাক্ত একজন

বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

সূর্যের নিকটতম যাত্রা, নিরাপদে ফিরে এলো নাসার পার্কার সোলার প্রোব

সূর্যের নিকটতম যাত্রা, নিরাপদে ফিরে এলো নাসার পার্কার সোলার প্রোব