থার্টি ফাস্ট নাইট এবং প্রাসঙ্গিক কথা
২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১৩ এএম | আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১৩ এএম
আনন্দ-উৎসব ধর্মীয় কৃষ্টি কালচারেরই একটি অংশ, যা সম্পর্কে সূরা হজ্বের ৬৭ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘প্রতিটি জাতির জন্য আমি ধর্মীয় উপলক্ষ নির্দিষ্ট করে দিয়েছি, যা তাদেরকে পালন করতে হয়।’ অমুসলিম, কাফির কিংবা মুশরিকদের উৎসবের দিনগুলো হচ্ছে তাদের জন্য উচ্ছৃঙ্খল আচরণের দিন, এদিনে তারা নৈতিকতার সকল বাঁধ ভেঙ্গে দিয়ে অশ্লীল কর্মকা-ে লিপ্ত হয়, আর এই কর্মকাণ্ডের অবধারিত রূপ হচ্ছে মদ্যপান ও ব্যভিচার। এমনকি খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বহুলোক তাদের পবিত্র বড়দিনেও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে মদ্যপ হয়ে ওঠে এবং পশ্চিমা বিশ্বে এই রাত্রিতে কিছু লোক নিহত হয় মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোর কারণে। পক্ষান্তরে মুসলিমদের উৎসব ইবাদতের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। বস্তুত ইসলাম কেবল কিছু আচার-অনুষ্ঠানের সমষ্টি নয়, বরং তা মানুষের গোটা জীবনকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অনুযায়ী বিন্যস্ত ও সজ্জিত করতে উদ্যোগী করে তুলে। আর একজন মুসলিমের জন্য জীবনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে ইবাদত, সূরা যারিয়াতের ৫৬ নং আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে: ‘আমি জ্বিন ও মানুষকে আমার ইবাদত করা ছাড়া অন্য কোনো কারণে সৃষ্টি করিনি।’ তাই মুসলিম জীবনের আনন্দ-উৎসব আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ ও অশ্লীলতায় নিহিত নয়, বরং তা আল্লাহর দেয়া আদেশ পালন করতে পারার মাঝেই নিহিত রয়েছে, কেননা মুসলিমের ভোগবিলাসের স্থান ক্ষণস্থায়ী পৃথিবী নয়, বরং চিরস্থায়ী জান্নাত। আর মুসলিম জীবনের প্রতিটি কাজে জড়িয়ে থাকবে তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ, তাদের ঈমান, আখিরাতের প্রতি তাদের অবিচল বিশ্বাস, আল্লাহর প্রতি ভয় ও ভালবাসা ।
আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশে চালু রয়েছে তিনটি বর্ষপঞ্জি- হিজরি বর্ষ, বাংলা বর্ষ ও ঈসায়ী তথা ইংরেজি বর্ষ। দুর্ভাগ্যবশত আমরা ইংরেজি বর্ষের আগ্রাসনের শিকার। বাংলা বর্ষে দিনাতিপাত না করলেও নববর্ষ উদযাপন করছি নিয়মিত। অথচ, মুসলিম জাতির আসল বর্ষ হিজরি বর্ষ, যা সম্পর্কে আমরা সর্বদা বেখবর। মুসলিম হিসেবে হিজরি বর্ষ নৈমিত্তিক করা জরুরি ছিল। আমরা বিশ্বায়নের কাছে সব হারাতে হারাতে নিজেদের বর্ষপঞ্জিও হারিয়ে ফেলেছি।
খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে মধ্য আমেরিকার মেক্সিকোতে ‘মায়া সভ্যতা’ নামে এক উচ্চমান সভ্যতা ছিল, যাদের ছিল সংখ্যা তাত্ত্বিক জ্ঞান, গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে অসাধারণ দক্ষতা। তারাই প্রথম আবিষ্কার করে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে আসতে পৃথিবীর সময় লাগে ৩৬৫ দিন। আর নিজেদের গণনার সুবিধার্থে সর্বপ্রথম রোমানরাই ক্যালেন্ডার তৈরি করে। তাতে বছরের প্রথম মাস ছিল মারটিয়াস, যা বর্তমানের মার্চ মাস। এটা তাদের যুদ্ধ দেবতার নামানুসারে নামকরণ করা হয়। অতঃপর খৃষ্টপূর্ব প্রথম শতকে জুলিয়াস সিজার কয়েক দফা পরিবর্তন ঘটান উক্ত ক্যালেন্ডারে। তৎকালীন প্রখ্যাত জোতির্বিজ্ঞানীদের সহযোগিতায় তিনিই প্রথম ক্যালেন্ডারে মায়াদের আবিষ্কৃত ৩৬৫ দিন ব্যবহার করেন। দীর্ঘদিন পর্যন্ত তার উদ্ভাবিত ‘জুলিয়ান ক্যালেন্ডার’ বাজারে প্রচলিত থাকে। অতঃপর ১৫৭৭ সালে খৃষ্টধর্মের ত্রয়োদশ পোপ গ্রেগরী জুলিয়াস প্রবর্তিত উক্ত ক্যালেন্ডারটিতে কিছু পরিবর্তন আনেন। পরিশেষে ১৫৮২ সালে আরেক দফা সংস্কার করে বর্তমান কাঠামোতে দাঁড় করান। যার নতুন বর্ষের শুরু হয় গ্রিকদের আত্মরক্ষার দেবতা ‘জানুস’-এর নামানুসারে জানুয়ারি দিয়ে। আর এটি ‘গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার’ নামে বিদ্যান সমাজে পরিচিত।
আমাদের দেশে বর্ষবরণ: ভারতীয় উপমহাদেশে বর্ষবরণ হয় বছরে দুইবার। প্রথমত, পশ্চিমা বিশ্বের সাথে ইংরেজি নববর্ষ উদযাপন। ইংরেজি নববর্ষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে পালিত হয়। বাংলাদেশে রাত বারটা বাজার সাথে সাথে আতশবাজি, নাচ-গান, হৈ-হুল্লোড়, উন্মত্ততা শুরু হয়। নতুন পোশাক, ভালো খাবার, বিভিন্ন স্পটে ঘুরতে যাওয়া, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন ইত্যাদির মধ্যদিয়ে পালিত হয় ইংরেজি নববর্ষ। দ্বিতীয়ত, বাঙালি মিশ্র সংস্কৃতিতে বৈশাখ উদযাপন। যার চিত্রও ভয়াবহ। পহেলা বৈশাখ শুরু হয় ভোরে। সূর্যোদয়ের পর পর। মূল অনুষ্ঠান শুরু হয় ৩১ চৈত্র; চৈত্র সংক্রান্তির মধ্য দিয়ে। যার মাধ্যমে চৈত্রকে বিদায় ও নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছায়ানটের শিল্পিরা বিশ্বকবির বৈশাখী গান ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো...’ গেয়ে সূর্যবরণের মাধ্যমে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। বের হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। যার প্রতীক হলো চারুকলার ম্যাসব্যাপী পরিশ্রমে বানানো ঘোড়া, হাতি, ময়ূর, পেঁচা, পুতুল, পাখি, বিভিন্ন মূর্তি, বিভিন্ন মুখোশ প্রভৃতি। বস্তুত এতে রয়েছে হিন্দু কালচারের সফল বিচরণ।
রাতের গুরুত্বপূর্ণ যে সময়টিকে ইংরেজি বর্ষ উদযাপনের নামে বাংলার তরুণ প্রজন্ম টগবগে যৌবনের লাগামছাড়া নেশা মেটানোর সময় হিসাবে বেছে নেয়, সে সময়কে মহান আল্লাহ সাফল্যের সুবর্ণ মুহূর্ত ঘোষণা করেছেন। সপ্তআকাশে তাঁর কুদরত প্রকাশ করে অসুস্থ, ক্ষমাপ্রার্থীসহ সকল প্রার্থনাকারীর চাহিদা পূরণ করেন। মহান ¯্রষ্টার আহবানকে উপেক্ষা করে যারা শয়তানের আহবানে রাত জাগে, তাদের পরিণাম আল্লাহর কাছে কি-ই বা হবে? ইরশাদ হচ্ছে, ‘রাতের মধ্যে এমন একটি সময় আছে, যদি কোনো মানুষ সে সময় লাভ করতে পারে, তবে আল্লাহর নিকট ইহকাল ও পরকালের কোনো কল্যাণ চাইলে আল্লাহ তাকে দান করেন। আর এ সময়টি প্রতি রাতেই রয়েছে।’ অপরদিকে বাংলা নববর্ষে সূর্যোদয়ের সময়টিকে কল্যাণের জননী হিসেবে বেছে নিয়ে সূর্যকে আহবান করা হয়। বস্তুত কোনো সময়কে এভাবে অশুভ বা শুভ মনে করা হিন্দু সংস্কৃতির অংশ, যা প্রকৃত মুসলমানের কাজ নয়। এরূপ শুভাশুভ নির্ণয় ও তাতে বিশ্বাস স্থাপনের ব্যাপারে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কুলক্ষণে বিশ্বাস করা শিরক’। আধুনিকতার নামে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে যুবক-যুবতীদের অবিমিশ্রণ জাহেলিয়াতকেও হার মানায়। নগ্নতার এই অপসংস্কৃতি দেশকে দ্রুত নিয়ে যাচ্ছে পঙ্কিলতার দিকে। নতুন প্রজন্মের জন্য চরিত্রবান মায়ের সংকট তৈরি করছে তারা। আঁটসাঁট, অশালীন, অমার্জিত পোষাক পরিধানকারী, মাথার চুল উপরে তুলে বাঁধা নারীদের তীব্র নিন্দা জানিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘দুই শ্রেণির জাহান্নামী রয়েছে, যাদের অন্যতম নগ্ন পোষাক পরিধানকারী নারী, যারা পুরুষদেরকে নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করে এবং নিজেরাও পুরুষের দিকে আকৃষ্ট হয়। তাদের মাথা বক্র উঁচু কাঁধ বিশিষ্ট উটের ন্যায়। তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এমনকি জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না।’ (মিশকাত হাদীস:৩৫২৪)
জীবনের দীর্ঘ একটি বছরের ইতি ও নতুন বছরের সূচনালগ্ন, একজন মুমিন হিসেবে নিজেকে বিকশিত করার সময়। এ হিসাব করার সময় এসেছে যে, যাপিত জীবনে আমাদের জীবনযাপন, চিন্তা লালন ও কর্ম পালন কতটুকু ইসলামসম্মত হয়েছে? ইসলামের অতি আবশ্যকীয় ও করণীয় ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নতে মুয়াক্কাদা আমরা যথাযথ পালন করেছি কি না? ইসলামে নিষিদ্ধ কর্মকা-ে আমাদের বেখেয়াল বা অসচেতন সম্পৃক্ততা ছিল কি না? ঈমানদারের নববর্ষ পরিকল্পনা হবে ইসলামী ভাবধারায়। তার নিকট-অতীতের সময়পঞ্জির অবস্থা ও অবস্থান পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন করতে হবে। অন্যথায় নববর্ষ সর্বাঙ্গীণ রঙিন করা যাবে না। ধুলা-বালির আস্তরণে শুভা রং ঝিলিমিলি করে না, কদর্য বাড়ায়। একজন মুমিন তাঁর নতুন বছরকে ইসলামিয়াত দিয়ে সাজসজ্জা করবেনÑ এটা স্বাভাবিক, এটাই কাক্সিক্ষত। ঈমানের চাহিদায় নিজেদের উপযোগী ও প্রস্তুত করার এটা মোক্ষম সময়। আল্লাহ জীবন-মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন পরীক্ষা করার জন্য, কে সবচেয়ে বেশি সুন্দর আমল করতে পারে?
তাই আসুন, আমরা আমলনামা সমৃদ্ধকরণের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হই। যে উৎসব পৌত্তলিক-খৃষ্টান সমাজ গ্রহণ করেছে তাকে কেন আমরা বর্জন করছি না? প্রিয়নবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের অনুসরণ করল, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হলো’। অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে, আপনার স্নেহের সন্তানকে যে বয়সে আপনি রশি ছেড়ে রেখেছেন বর্ষবরণ অনুষ্ঠান পালন করতে, সে বয়সে মুস‘আব বিন উমাইর (রা.) গিয়েছেন ওহুদ যুদ্ধে শহীদ হতে। তরুণ-তরুণীদেরও সতর্ক হতে হবে, অশ্লীলতায় জড়িয়ে নিজেকে অবমূল্যায়ন করা যাবে না। যুবক মুহাম্মদ বিন কাশিমের হাতে ইসলাম শক্তিশালী হয়েছে। ঈমানদার তরুণীরা কত পুরুষকে দ্বীনের পথে অবিচল থাকতে সাহস জুগিয়েছে। সেটাই মুক্তির পথ। তাই আজকের তরুণ-তরুণীদের জীবনকে আলোকিত করতে হলে সেদিকেই ধাবিত হতে হবে।
লেখক: ইসলামী গবেষক ও খতিব
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
অবশেষে টাঙ্গাইলের সেই আলোচিত ব্রীজটির উদ্বোধন হলো আজ
অস্ট্রেলিয়ার শেষ উইকেট জুটিতে বিপদে ভারত
দেশীয় অস্ত্রসহ খুলনার শীর্ষ সন্ত্রাসী আটক
'দি ওডিসি' সিনেমায় বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন নোলান
রোমানিয়ার নির্বাচনে অস্বচ্ছতা নিয়ে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর ক্ষোভ
বাউফলে হামলা-পাল্টা হামলা, বিএনপির এক পক্ষের মানববন্ধন ও আরেক পক্ষের সংবাদ সম্মেলন
১৫ দিনের মধ্যে সাংবাদিকদের জন্য ডিজিটাল কার্ড ইস্যু হবে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে ২১ সাংবাদিক
চাকরিচ্যুত সাবেক সেনাদের সড়ক অবরোধ, ২ ঘণ্টা পর যান চলাচল স্বাভাবিক
আশুলিয়ায় ভবন মালিকের স্বেচ্ছাচারিতায় অর্ধশত শিক্ষার্থীর লেখাপড়া বন্ধ
হাটহাজারী সাংবাদিক ঐক্য পরিষদের প্রতিবাদ সভা
৫ আগস্টের পর বেশ কয়েকটি ইসলামী ব্যাংক দখল করেছে একটি ইসলামী দল
মেহেরপুরে তসলিমা হত্যা মামলায় ২ জন আটক
ঈশ্বরদীতে ৫ বছরের শিশু কন্যাকে যৌন হয়রানির অভিযোগে সৎ বাবা গ্রেফতার
নাসার নতুন সাঁতারু রোবট , ইউরোপায় প্রাণের খোঁজে এক বিস্ময়কর যাত্রা
৩১ ডিসেম্বরের ঘোষণাপত্র লিখিত দলিল হিসেবে থাকবে : সারজিস
ইসলাম নিয়ে রাজনীতি করেন, ইসলাম মানে তো বারবার মোনাফেকি করা না : রিজভী
উখিয়ায় চুরির দায়ে পিটিয়ে এক যুবককে হত্যা, পরিবারের অভিযোগ পরিকল্পিত খুন
৩১ ডিসেম্বর মুজিববাদী সংবিধানের কবর রচিত হবে : হাসনাত আবদুল্লাহ
বিধ্বস্তের আগে যে বার্তা পাঠিয়েছিলেন বিমান যাত্রী