সংখ্যালঘু নির্যাতনের ভারতীয় বয়ান থেকে এদেশের হিন্দুদের সতর্ক থাকতে হবে
০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:১১ এএম | আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:১১ এএম
সব দেশেই বিভিন্ন ধর্মের মানুষ একসাথে বসবাস করে, সবাই দেশের নাগরিক। সেমতো সবাই সম-নাগরিক অধিকার ভোগ করবে। দেশের আইন সবার জন্য সমান। এখানে জাত-পাতের ভেদাভেদ অপ্রয়োজনীয়। সুতরাং, কাউকে বিশেষভাবে নিরাপত্তা দেওয়ারও প্রয়োজন পড়ে না। চাকরির সুবাদে আমি এলাকার বাইরে আসার পর কয়েকজন বন্ধু এদেশে অত্যাচারের কথা বলে এবং কেউ কেউ ভারত রাষ্ট্রকে নিজের রাষ্ট্র ভেবে ওপারে পাড়ি জমায়। তারা এখন বলে, বাংলাদেশ ছেড়ে তারা ভুল করেছে। মূল ভারতীয়রা তাদের কুনজরে দেখে; ভারতে সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসা বেশি, অধিকাংশ লোক হাড়কিপটে ইত্যাদি। আমি শুনে হেসে উড়িয়ে দিই। এদেশের হিন্দুসম্প্রদায় যে দলকে স্বাধীনতার আগে থেকেই বন্ধু ভেবেছিল, তারাই সব সময় তাদের প্রতি অত্যাচার ও জমিজমা দখল করেছে। ভারত রাষ্ট্রটা হিন্দু সম্প্রদায়ের খুব পছন্দের। আওয়ামী লীগ ভারতের গোলামী করে, তাই হিন্দু সম্প্রদায় আওয়ামী লীগের বন্ধু। সম্পদ লুটের সময়ে তারাই আবার শত্রুতে পরিণত হয়। একই রাজনৈতিক দল নিজে দইটা চেটে খেয়ে অন্য কোনো দলের মুখে হাত মুছে দিয়ে নিজেরা ধোয়া তুলসিপাতা সাজে। এতটা বছরে একথা ওপেন-সিক্রেট হয়ে গেছে। কোনো কোনো হিন্দু নেতার মুখেও টিভি চ্যানেলে বক্তৃতায় এ সত্য কথা স্বীকার করতে শুনেছি। একথা ভারত সরকার অবহিত হলেও এখন তারা জিভ ঘুরিয়ে ডাহা মিথ্যা বিশ্বব্যাপী রটায় কিসের স্বার্থে? স্বার্থটা হচ্ছে ‘গোলাম’ দেশছাড়া, তাই স্বার্থ হাতছাড়া। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা আওয়ামী সম্প্রদায় ও ভারতকে দেবতা জ্ঞানে মান্য করে চলে। আমার মনে হয়, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার জন্য যুদ্ধের পর বিভিন্ন দিক থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা উঠলেও তারা চুপ করে গিয়েছিল। দেশ গড়তে নিজেদের অযোগ্যতা, দুরভিসন্ধি ও ব্যর্থতা ঢাকতে দোষ বিএনপি-জামায়াতের ঘাড়ে চাপায়। এদেরকে বিশ্ব-মুরব্বিদের কাছে ‘জঙ্গি-মৌলবাদী’ বানিয়ে জুজুর ভয় দেখিয়ে নিজ স্বার্থ হাসিল ও সিংহাসনে বসে থাকার নি¤œমানের ফন্দি-ফিকির।
অনেক মানুষই আওয়ামী লীগের স্বাধীনতা যুদ্ধের আগের কথা ও যুদ্ধের পরের লুটতরাজ, মিথ্যাচার, প্রভুর নিরঙ্কুশ স্বার্থরক্ষার কাজ দেখে তাদের মতলববাজি ও প্রতারণা বুঝতে পেরে নৈতিকতার কারণে দলত্যাগী হয়েছে। বাঁধ দিয়ে নদীর পানিকে অনেক সময় বশে আনা যায় না, মানুষের মনকে তো নয়ই। আমি এটা সাইকোলজিক্যাল ও সোসাইটাল পয়েন্ট অব ভিউতে বিশ্লেষণ করে অনেকবার দেখেছি। পরবর্তীতে জামায়াতের সাথে নিয়ে আন্দোলন করে, পাশে বসিয়ে বক্তৃতা দেয়; রাষ্ট্রক্ষমতায় বসার জন্য জামায়াতের কোনো নেতার পা ছুঁয়ে সালাম করে, আবার দীর্ঘদিন পর তাদের নেতাদের স্বকল্পিত অপরাধে ফাঁসীতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করতেও দ্বিধাবোধ করে না।
আওয়ামী লীগ ভারতে দলবলসহ পালিয়ে যাবার আগে গত্যন্তর না দেখে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে নিজেদের রাজনীতির পালে অনুকূল হাওয়া লাগাতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছে। মানুষ একই টেকনিক বারবার খায় না। আচ্ছা, আমাদের দেশে খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ও তো সংখ্যালঘুর আওতায় পড়ে; তারা কি কখনো সংখ্যালঘু অত্যাচারের কথা বলে? এদেশের হিন্দু ধর্মের কিছু লোক আওয়ামী-ভারতের শক্তিতে ধরাকে সরা জ্ঞান করে ও আওয়ামী রাজনীতির সাথে যুক্ত। আওয়ামী লীগ ভারতকে ‘দাদাগিরি’ করতে সুবিধা দেওয়াতে এদেশের কুমতলবি দাদারা বিভিন্ন প্রকার দুর্নীতি, অন্যায় ও অপরাধ করে, এদেশের যত অসত্য-কুকথা ভারতের কানে লাগায়। পূজার মৌসুমে ভারতের দান-দক্ষিণা এনে খাচ্ছে। এখন আওয়ামী লীগের পতনে তাদের প্রতি কোথাও কোথাও সাধারণ মানুষ প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পালটা-আক্রমণ করেছে। এটা হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি আক্রমণ নয়, আওয়ামী বন্ধুদের কুকর্মের বিরুদ্ধে আক্রমণ। তারা দুর্নীতি-দুষ্কর্ম করবে আওয়ামী রাজনীতির ব্যানারে, আবার আক্রান্ত হলেই সংখ্যালঘুর ওপর অত্যাচার বলে চালিয়ে দেবে এবং দল গুছিয়ে শ্লোগান হাঁকবে ও দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে, এটা কেমন সমীকরণ? এদেশের সাধারণ হিন্দু সম্প্রদায়ের এ বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে হবে। সতীর্থ রাজনীতিকদের হাতের গুটি হলে চলবে না। একমাত্র আওয়ামীলীগার ছাড়া মুসলমান-হিন্দুরা একে অপরের বন্ধু হয়ে সেই আদিকাল থেকে এদেশে একসাথে বসবাস করে আসছে। তারা কিংবা তাদের পূজার ঘর কখনো আক্রান্ত হলে রাজনৈতিক স্বার্থের মারপ্যাচে আওয়ামী লীগ সে-কাজ করে আসছে। আমি হিন্দু বন্ধুদের কাছ থেকে শুনে ও দেখে ভেতরের অনেক খবর রাখি; আবার ‘আমার ফাঁসী চাই’ বইতেও পড়েছি। সাধারণ হিন্দুরা মনে মনে মতলববাজ ও ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চাইলে প্রকৃতির নিয়মেই তাদেরকে ভুগতে হবে। তারা যে কোনো দলের রাজনীতি করতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু রাজনৈতিক দলের মারামারি সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার বলে চালানো যাবে না। একমাত্র আওয়ামী লীগ ছাড়া কেউ তাদের অত্যাচার করেও না। তাদেরকেও অন্যান্য জাতি-সম্প্রদায়ের মতো নাগরিক অধিকার নিয়ে এদেশে বসবাস করতে হবে। এদেশকে ভালোবাসতে হবে। তাদের অন্যায় দুর্নীতি করলে নিজেকে আইনের উর্ধ্বের ভাবা যাবে না। বিষয়টি তারা ও ভারত সরকার সাম্প্রদায়িকভাবে নিচ্ছে, দেশ-বিদেশ মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছে। মূল কথা তাদের সেবাদাস ও দাসী দেশছাড়া, এ ক্ষোভ তারা মিটাতে গিয়ে ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে চাচ্ছে। ভারত এদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাচ্ছে। এতে বাংলাদেশ যদি অশান্তিতে থাকে, ভারতও অশান্তিতে থাকবে। শেখ হাসিনাকে এদেশের গদিতে তারা আর বসাতে পারবে না বলে আমার বিশ্বাস।
সাভারে রানা প্লাজা ধসে গার্মেন্ট শ্রমিকদের নির্মম মৃত্যুর পর কেচো খুঁড়তে বেরিয়ে এলো যে, জমিটা হিন্দুদের; দখল করেছিল আওয়ামী নেতা। অবৈধভাবে বিল্ডিং তৈরি করেছিল। এমন হাজার হাজার সত্য দেশব্যাপী গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে আছে। জমি দখল ও মন্দির ভাঙায় দেশছাড়া হলে বুঝতে হবে মূল হোতা আওয়ামী-বন্ধুর শত্রুতা। কাউকে কোনোদিন বিচারের আওতায়ও আনা হয় না। আমার দেখা চোখে সব হিন্দুই কিন্তু অত্যাচারের কারণে ভারতে দেশান্তরি হয়নি; অনেকে ভারতকে নিজের আপন ঠিকানাÑ স্বর্গরাজ্য ভেবেই গেছে। অনেককে দেখেছি, এদেশে অপকর্ম করে শাস্তির ভয়ে পালিয়ে পরিবারসহ রাতের অন্ধকারে ভারতে চলে গেছে। আবার অনেকে এদেশ থেকে কুটকৌশল করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে; পি.কে. হাওলাদার তাদের একজন। দেখা যায়, একাংশ হিন্দু বাস করে এদেশে, আয় রোজগার করে এদেশে, সম্পদ গড়ে ভারতে। ভারতকে তাদের নিরাপদ স্থান বলে গণ্য করে। আমার অনেক পরিচিতজন, বন্ধুবান্ধবও তাই করেছে। যারা রাজনৈতিক ফায়দা লোটা কিংবা ব্যক্তিস্বার্থের করণে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন করেছে; মিথ্যা সংখ্যালঘু নির্যাতনের ও জঙ্গি-মৌলবাদী দেশ নামাবলীর ট্রামকার্ড ব্যবহার করে দেশ-বিদেশে ছড়িয়েছে বা এখনও ছড়াচ্ছে, ভারতের সেসব সেবাদাস ও সেবাদাসী এদেশ লুটপাট ও গণহত্যা চালিয়ে তাদের মনিব-বন্ধুর কোলে নিরাপদ আশ্রয়ে ঠাঁই নিয়েছে। বিশ্বের ইসলামবিদ্বেষী, থিও-পলিটিক্যাল ভাবধারায় লালিতপক্ষ এসব অপপ্রচারকে মুসলমান দমনের মোক্ষম-ধন্বন্তরি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।
এদেশে হিন্দু সম্প্রদায়কে ডুবাচ্ছে তাদের কুটচালসিদ্ধ রাজনৈতিক সতীর্থ এবং অন্ধ ভারতপ্রীতি। ব্রিটিশ শাসনামলের শুরু থেকে ভারতের হিন্দুত্ববাদী চিন্তা-চেতনা মুসলমানদের প্রতি অত্যাচার ও মুসলিমবিদ্বেষী আচরণ ভারতবর্ষকে দ্বি-জাতি তত্ত্বে বিশ্বাসী করতে মুসলমানদের বাধ্য করে। কোনো জাতি বা সম্প্রদায় নিগৃহীত, নিষ্পেষিত হলে অচ্ছুত ও যবন সম্প্রদায় হিসেবে হিন্দুত্ববাদী ও বহুত্ববাদী ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায়ের বর্ণবাদী সমাজের সাথে বসবাস করতে বেশিদিন রাজি হয় না। নিজেদের সম্মান ও অস্তিত্বকে বজায় রাখার জন্য পৃথক হতে বাধ্য হয়। তাই পাকিস্তান স্বাধীন হয়েছিল এবং তারপর বাংলাদেশও স্বাধীন হয়। অনুসন্ধিৎসু পাঠকবর্গকে সেই বৈদিক যুগ থেকে ভারতবর্ষের ইতিহাস অতি সতর্কভাবে পড়ে দেখার অনুরোধ করছি।
আমি চার বছর ভারতের মধ্যপ্রদেশের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছি। মুসলমানদের প্রতি তাদের অবজ্ঞা, বৈষম্য, অত্যাচার, নিগ্রহ ও ঘৃণা আমি স্বচোক্ষে দেখেছি ও নিজেও ভুগেছি। নিজের চোখ ও কানকে অবিশ্বাস করি কী করে? আমাদের দেশের কোনো কোনো রাজনৈতিক দল এদেশের স্বাধীনতাকে কোনো রাষ্ট্র-গোষ্ঠীর চরণে বিসর্জন দিয়ে নিজেদেরকে স্বাধীনতার রক্ষক বলে দাবি করে, আবার সে রাষ্ট-গোষ্ঠীর সেবাদাস ও দাসী হয়ে কাজ করে। আওয়ামী লীগও এ স্বাধীন দেশকে দিনে দিনে ভারতের হাতে হাওলা করে দিতে চায়। এদেশের ভাত-খাওয়া লোকজন অনেক সচেতন। বাস্তবে বিজ্ঞাপন ও মুখ-দালালি প্রচারণার সাথে কাজের এ বৈপরিত্য ছাত্র-জনতার বিপ্লব ও দাস-দাসীর পলায়ন এবার সব গোমর ফাঁস করে দিয়েছে। এদেশীয় প্রভু-বন্ধুকে হারিয়ে হিন্দু ধর্মের ঠগবাজ লোকজন এখন দিশেহারা। তাদের ভুল ভারতকে ভালোবাসতে গিয়ে তাদের এদেশীয় ভারতীয় সেবাদাসকে বন্ধু হিসেবে বরণ করে নেওয়া। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের উচিত ছিল অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতো এদেশে নিজেদের অস্তিত্ব, নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা। তা না করে তারা ভাত খাবে এখানে আর কুলি ফেলবে ওখানে, তা-কি হয়?
লেখক: অধ্যাপক ও গবেষক
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
শহীদ আবু সাঈদের কবরে তিন উপাচার্যের শ্রদ্ধা নিবেদন
রামগড়ে হত-দরিদ্রদের জন্য বিনামূল্যে চক্ষু চিকিৎসা ক্যাম্প উদ্বোধন
লন্ডনে খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানালেন তারেক রহমান
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিন নবজাতক জন্ম দিলেন এক গৃহবধূ
একনেকে অনুমোদন পেল ৪ হাজার কোটি টাকার ১০ প্রকল্প
নরসিংদীতে জুলাই ঘোষণাপত্র বিতরণ করছেন সারজিস আলম
বিডিআর জওয়ানদের মুক্তির দাবিতে যমুনা অভিমুখে পদযাত্রা, পুলিশের বাধা
ব্রাহ্মণপাড়ায় ডায়রিয়ার প্রকোপ শীত বাড়ছে মৌসুমি রোগবালাই
এ বছর থেকেই এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলি শুরু : শিক্ষা উপদেষ্টা
স্কুলে না থেকেও বেতন নিচ্ছেন নিয়মিত
সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি মাহবুব উদ্দিন খোকনের সঙ্গে ফজল আনসারীর সাক্ষাৎ
কম্বলডা পায়া শান্তিতে ঘুমামু
ঈশ্বরগঞ্জে পুলিশের বিশেষ অভিযানে গ্রেফতার ১১
সিরাজদিখানে মাদক নিয়ে দ্বন্দ্ব ছুরিকাঘাতে ২ জন আহত
নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগে ওয়াসার তাকসিমসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা
রাশিয়ার সাইবার ইউনিট পোল্যান্ডে হামলার লক্ষ্যে সক্রিয়: মন্ত্রী গাওকোভস্কি
সিংগাইরে সিসিডিবি'র উদ্যোগে কম্বল বিতরণ
মতলবে গাছ কাটতে গিয়ে গাছ ব্যবসায়ীর মৃত্যু
ট্রাম্পের গ্রিনল্যান্ড-পানামা খালের প্রতি আগ্রহে উত্তেজনা বৃদ্ধি
লক্ষ্মীপুরে জমি দখলের অভিযোগে যুবদল নেতাকে বহিষ্কার