মিথ্যা ন্যারেটিভ ভেঙ্গে দেয়া আমাদের ইতিহাসের দায়বদ্ধতার অংশ

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:১১ এএম | আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:১১ এএম

 

একাত্তরের স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজনীতি ৫৩ বছর ধরে অব্যাহতভাবে ভারতীয় আধিপত্যবাদী সাংস্কৃতিক বয়ান সৃষ্টি করেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল লক্ষ্য ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের লঙ্ঘন হয়, এমন কোনো কিছুই সত্তুরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহার কিংবা মুক্তিযুদ্ধের কোনো ঘোষণাপত্রে ছিল না। মনে রাখা দরকার, সত্তুরের নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা পাকিস্তানের সংবিধানের প্রতি শপথ নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের পার্লামেন্ট মেম্বার হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় স্বাধীন রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়নে একটি নতুন গণপরিষদ নির্বাচন করা প্রয়োজন ছিল। তা না করে পাকিস্তানের সংবিধানের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই বাহাত্তরের সংবিধান রচনা ও গ্রহণ করেছিল। সেই সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র এবং বাঙ্গালী জাতিয়তাবাদ ঢোকানো হয়েছে, যা’ বাংলাদেশের স্বাধীন ও ঐক্যবদ্ধ জাতিসত্তা এবং মুসলমানদের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকরা বাঙ্গালি হিসেবে বিবেচিত হলে এখানকার উপজাতিসহ ভিন্ন ভাষার নাগরিকদের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা হয়েছে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের মধ্যে অসন্তোষ-উত্তেজনার এটিও অন্যতম কারণ ছিল। শেখ মুজিব নাকি তাদেরকে বলেছিলেন, ‘তোরা বাঙ্গালি হয়ে যা’। ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা এবং পাকিস্তানের আইয়ুব খানের ডিক্টেটরিয়াল ক্ষমতা বাহাত্তরের সংবিধানে অর্ন্তভুক্ত করে একনায়কতান্ত্রিক বাকশাল প্রতিষ্ঠা করতে আরো কিছু মৌলিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সংবিধানকে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের স্পিরিট থেকে বিচ্চুত করা হয়েছে। বিকৃত, পরিবর্তিত সংবিধান শেখ মুজিবুর রহমানকে একজন নিকৃষ্ট স্বৈরাচারে পরিনত করেছিল, যা শেষ পর্যন্ত শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে শক্তিশালী সামরিক অভ্যুত্থান ও সপরিবারে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল। গত পঁচাত্তর পরবর্তী দশকে জিয়াউর রহমানের হাত ধরে সংবিধানে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটলেও শেখ হাসিনার কয়েকটি সংশোধনী বাংলাদেশের সংবিধানকে মূলত একটি নাগরিক নিপীড়ন ও নিষ্ঠুর স্বৈরাচারের মেনিফেস্টোতে পরিনত করেছিল। সেখানে তাঁকে ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা কিংবা শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার পালাবদলেল সব পথ রুদ্ধ করে তিনি আরেকটি গণঅভ্যুত্থানকে অনিবার্য করে তুলেছিলেন। দেশের অন্যতম জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা, বেগম খালেদা জিয়া ২০১১ সালে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে যর্থাথই বলেছিলেন, ‘যেদিন জনগণের সরকার ক্ষমতায় আসবে, সেদিনই এ সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেয়া হবে।’ বাহাত্তুরের সংবিধান পরিবর্তন করে একটি গণতান্ত্রিক, জনআকাক্সক্ষার সংবিধান প্রণয়ন করার দাবি চব্বিশের জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের প্রধান আকাক্সক্ষায় পরিনত হয়েছে। তবে জুলাই বিপ্লবের অন্যতম রাজনৈতিক অংশীদার বিএনপি নেতাদের সাম্প্রতিক কথাবার্তায় ভিন্ন সুর লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারা বাহাত্তুরের সংবিধানকে অক্ষুণœ রাখার কথা বলছেন, তারা শেখ মুজিবের ফ্যাসিবাদি কাল্টকে প্রতিষ্ঠিত রেখেই ক্ষমতায় যেতে চাইছেন, যেখানে বিপ্লবী ছাত্র-জনতা হাসিনার মাফিয়াতন্ত্র ও আওয়ামী ফ্যাসিবাদের প্রতীক শেখ মুজিবের ছবি ও ভার্স্কযকে গুঁড়িয়ে দিতে চাইছেন। হাজার হাজার গুম-খুন, লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার, দেশের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংসে করে ভারতে পালিয়ে গিয়ে সেখানে বসে বাংলাদেশবিরোধী ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র ও উস্কানির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও প্রতিকারই যেখানে ছাত্র-জনতার অগ্রাধিকার সেখানে বিএনপি নেতাদের প্রতিক্রিয়ায় মনে হচ্ছে, তারা যেনতেন প্রকারে একটি নির্বাচন আদায় করে ক্ষমতার মসনদে বসার জন্য পতিত স্বৈরাচারের সব এস্টাবলিশমেন্টের সাথে আপস করতে চাইছেন।

আঞ্চলিক আধিপত্যবাদ এবং আন্তর্জাতিক সা¤্রাজ্যবাদ প্রভাবিত বিশ্বে শুধুমাত্র সামরিক ও রাজনৈতিক বিজয় জনগণের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনা। এজন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস, জাতীয় ঐক্য ও সংহতির অনুকুল সাংস্কৃতিক বয়ান সৃষ্টি করে তা জনগণের মন-মগজে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। গত ৫৩ বছর কিংবা শেখ হাসিনার শেষ ১৬ বছরের শাসনামলে জনপ্রত্যাশা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করে ভারতীয় সাংস্কৃতিক ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থের অনুকুল একটি আওয়ামী ফ্যাসিবাদি রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বয়ান প্রতিষ্ঠিত করার সর্বাত্মক প্রয়াস ছিল লক্ষ্যনীয়। সেখানে শেখ মুজিবকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী, জাতির জনক, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রাণপুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে সারা দেশে হাজার হাজার মুজিব মূর্তি, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে মুজিব কর্ণার প্রতিষ্ঠা জয়বাংলাকে একমাত্র ও বিকল্পহীন জাতীয় শ্লোগান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। এসব রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিশ্বাসের বিপরীতে কোনো কিছুই সহ্য করা হয়নি। মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, স্বাধীনতাবিরোধী, বিএনপি-জামাত তকমা দিয়ে যে কাউকে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার, গুম কিংবা নাটক সাজিয়ে ক্রস-ফায়ারে খুন করা অতি সাধারণ ঘটনায় পরিনত হয়েছিল। বাংলাদেশে আওয়ামী ফ্যাসিবাদি ন্যারেটিভের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ’, বাহাত্তুরের সংবিধান, একাত্তুরে তিরিশ লাখ শহীদ, ‘দুইলাখ মা-বোনের ইজ্জত’র মিথ। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ নি:সন্দেহে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবজনক অধ্যায়, এটি কোনো হাইপোথেটিক্যাল মিথ হতে পারেনা। কিন্তু রাজনৈতিক ইতিহাসের একেকটি মিথ্যা বয়ানকে প্রতিষ্ঠিত করতে অসংখ্য গণমাধ্যমে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে অনবরত মিথ্যার ফুলঝুরি ছরানো হয়েছে। সেই মিথ্যা বয়ান আমাদের নাগরিক সমাজের মন-মগজকে এতটাই প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছে যে, ১৬ বছর ধরে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের চরম নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হওয়া দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি’র গুরুত্বপূর্ণ নেতারাও সেই বয়ানকে প্রতিষ্ঠিত করতে আওয়ামী লীগের নির্মূলের রাজনীতির প্রধান টার্গেট প্রথম সারির ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে একই ধরনের বাক্যবাণ নিক্ষেপ করতে শুরু করেছেন। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলন এসব রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিল বলেই রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে কব্জা করে নিয়েও শেখ হাসিনা স্বৈরতান্ত্রিক মসনদ টিকিয়ে রাখতে পারেনি। সেই রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি এবং নির্দলীয় অর্ন্তবর্তী সরকারের কর্মকা-কে প্রশ্নবিদ্ধ, বিভ্রান্ত ও বিচলিত করার মধ্য দিয়ে জনমতকে প্রভাবিত করে দেশকে অস্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যাওয়া সুস্পষ্টভাবে ভারত ও আওয়ামী দোসরদের রাজনৈতিক এজেন্ডা। বিএনপি কিংবা জামায়াত সে এজেন্ডার ফাঁদে পা দিয়ে শর্টকার্ট রাস্তায় ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করলে, তা তাদের জন্য বুমেরাং হয়ে একটি চরম রাজনৈতিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে।

একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধে কত মানুষ শহীদ হয়েছিলেন? এমন প্রশ্নের কোনো অথেনটিক জবাব না থাকলেও আওয়ামী লীগের প্রপাগান্ডা ক্যাম্পেইন এ প্রশ্নে জাতিকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করতে চেয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে থেকে দাবি আদায়ে সংগ্রাম করা আর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া সমার্থক নয়। ‘নেতৃত্ব দেয়া দূরের কথা, মুজিব জানতেনই না যে দেশে যুদ্ধ হচ্ছে।’ এটি বিএনপি-জামায়াতের কোনো নেতার ন্যারেটিভ নয়। বরেণ্য প্রবীণ বামপন্থী বুদ্ধিজীবী, লেখক, গবেষক ও ইতিহাসবিদ বদরুদ্দীন উমর সম্প্রতি গণমাধ্যমে এই বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি আরো বলেছেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস লেখা হয়নি। যা লেখা হয়েছে, তা সরকারি ভাষ্য এবং তার শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগই মিথ্যা। বেশ কিছুদিন ধরে গোপণ আলোচনার পর ২৫ মার্চ পাকিস্তানিদের কাছে গ্রেফতার কিংবা আত্মসমর্পনের আগে শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে রাজি হননি। প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দন আহমদের বয়ানে সেদিনের ঘটনার বিশদ বিবরণ পাওয়া গেছে। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তা কোনো কোনো মুক্তিযোদ্ধা আওয়ামী লীগ নেতা ও আওয়ামী লীগের জোট নেতাদের কেউ কেউ বই লিখে এবং জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়েও সাক্ষ্য দিয়েছেন। ভারতের ইস্টার্ণ কমান্ডের নেতৃত্বাধীন মিত্র বাহিনীর কাছে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পনের পর শেখ মুজিব পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরই নাকি প্রথম জানতে পারেন, দেশে একটি মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল এবং সে যুদ্ধে প্রায় ৩ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সম্ভবত সোভিয়েত বার্তা সংস্থা তাস’র সাংবাদিকের দেয়া তিন লাখের তথ্যকে তিনি থ্রি মিলিয়ন বা তিরিশ লাখ বলে দাবি করেছিলেন। দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগকারি তিনশ, তিন লাখ বা তিরিশ লাখের অংক বড় কথা নয়। প্রতিটি জীবন অমূল্য, জাতির জন্য গর্বের। তাঁরা চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে এসেও একাত্তরের শহীদদের নামের তালিকা করার কোনো উদ্যোগ না নেয়া বা করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য দায়ী ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দল নিজেদের স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি দাবি করার নৈতিক অধিকার রাখে কিনা, নতুন প্রজন্ম সে প্রশ্ন করতেই পারেন। চেষ্টা করলে শহীদের তালিকা তৈরী করা এখনো সম্ভব। তবে তিন লাখ শহীদের তালিকাকে তিরিশ লাখে পরিনত করা হয়তো সম্ভব নয়। সেই অসত্য তথ্যকে সত্যে পরিনত করার প্রয়োজনেই তারা এ তালিকা তৈরীর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে প্রায় দেড় লাখ মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাকে আড়াই লাখে উন্নীত করা অপেক্ষাকৃত সহজ এবং রাজনৈতিকভাবে লাভজনক প্রকল্প ছিল। যদিও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং চব্বিশের আওয়ামী স্বৈরাচার বিরোধী গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে নানামাত্রিক পার্থক্য রয়েছে; এই অভ্যুত্থানে এক সঙ্গে লাখ লাখ মানুষ (ছাত্র-জনতা) হাজার হাজার উদ্ধত আগ্নেয়াস্ত্রের সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়েছিল, এমনটা আমাদের ইতিহাসে আর কখনো ঘটেনি। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে শহীদের তথ্য সংগ্রহ ও তালিকা তৈরীর কাজ চলছে। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে দুই হাজারের বেশি মানুষ শহীদ হয়েছেন। তিরিশ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন।

লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা জাতির হাতছাড়া হয়ে যাওয়া এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদের বশংবদ শক্তির হাতে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা নিশ্চিত রাখতেই ইসলাম বিদ্বেষী মিথ্যা তথ্যের উপর ভর করে আওয়ামী ফ্যাসিবাদি প্রপাগান্ডা ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। চব্বিশের অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার তখতে-তাউস উল্টে গেলেও রাতারাতি সেই ন্যারেটিভ উল্টে ফেলা সহজ নয়। যদিও মুক্তিকামী-সংগ্রামী জনগণই ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সাক্ষি ও ধারক। এ কারণে ৫৩ বছরের ধারাবাহিক প্রচেষ্টার পরও আধিপত্যবাদের আরোপিত মতলবি মিথ্যা ন্যারেটিভ ভেঙে দিয়ে সত্য সাক্ষ্যের আলোকে প্রকৃত ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করা খুব বেশি কঠিন কাজ নয়। বাংলাদেশের ইতিহাস এবং চলমান বাস্তবতা সাক্ষি, অস্ত্র দিয়ে, জীবন দিয়ে ভূমির দখলদার আগ্রাসি শক্তির পতন ঘটিয়ে বাহ্যিক বিজয় অর্জনের চেয়ে আধিপত্যবাদী কালচারাল হেজিমনি ঠেকিয়ে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা অনেক বেশি কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই আধিপত্যবাদী ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্ট প্রকাশ্যে কিংবা গোপণে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর যোগাযোগ ও বোঝাপড়ার চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক। সবচেয়ে তাদের পক্ষ থেকে সবচেয়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি হচ্ছে, কালচারাল হেজিমনি প্রতিষ্ঠার মূল আইকন ও বয়ান ভেঙ্গে মনোজাগতিক দাসত্ব শৃঙ্খল ভাঙ্গার গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডার পেছনে জাতীয় ঐক্যে এক ধরণের ফাঁটল দেখা দিতে শুরু করেছে। আগ্রাসন-নির্যাতনের শিকার হওয়া রাজনৈতিক দলের ্এক গুরুত্বপূর্ণ সিনিয়র নেতা বলেন, ‘বাহাত্তুরের সংবিধান কোনো রাফখাতা নয়, যে তা ছুড়ে ফেলে দিলাম’। সংবিধান পরিবর্তন কালচারাল ন্যারেটিভ বদলের গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হলেও এটি একটি স্থিতিশীল ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অংশ। এটি নিশ্চিত না হলে একাত্তুরের পর পঁচাত্তর, নব্বই, পিলখানা ট্রাজেডি, শাপলা চত্ত্বর ট্রাজেডি, শাহবাগের ফ্যাসিবাদি মঞ্চ, এক-এগারো এবং চব্বিশের রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মত ঘটনা বার বার ঘটতে থাকবে। এ কারণেই ছাত্র সমাজের জুলাই বিপ্লবের প্রোক্ল্যামেশন এবং নতুন সংবিধান ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত জরুরি। দূরভিসন্ধিমূলক মিথ্যা ইতিহাসের জঞ্জাল সরিয়ে জাতিকে একটি সত্যানুসন্ধানি ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাড়িয়ে ভবিষ্যতের পথ নির্মাণে এগিয়ে যেতে হবে। এখানে কোনো আপস চলবে না। সাতচল্লিশ, একাত্তুর, শেখ মুজিব, রবীন্দ্রনাথ, জাতীয় সংগীত, পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রা ইত্যাদি বিষয়গুলো যেন জাতির ঘাড়ে কোনো আরোপিত ন্যারেটিভের অধীনস্থ হয়ে না দাঁড়ায়। স্বাধীন নাগরিক সমাজে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক উদ্ভাসন হবে স্বতঃস্ফূর্ত। জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রে সে আকাক্সক্ষা ও প্রত্যয়ের প্রতিফলন থাকতে থাকতে হবে।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

অভিনেত্রীর নেকলেস চুরি, চোর কি তবে রং মিস্ত্রী?

অভিনেত্রীর নেকলেস চুরি, চোর কি তবে রং মিস্ত্রী?

ভিভো এক্স২০০ এর নজর কাড়া পাঁচ দিক

ভিভো এক্স২০০ এর নজর কাড়া পাঁচ দিক

ভৈরব থানার লুট হওয়া অস্ত্র পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার

ভৈরব থানার লুট হওয়া অস্ত্র পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার

বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনকারীদের মামলায় আসামী অন্তর, ষড়যন্ত্র অব্যাহত

বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনকারীদের মামলায় আসামী অন্তর, ষড়যন্ত্র অব্যাহত

সিলেট কোম্পানীগঞ্জে কিশোরীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা, থানায় অভিযোগ

সিলেট কোম্পানীগঞ্জে কিশোরীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা, থানায় অভিযোগ

সুনামগঞ্জে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি নিহত

সুনামগঞ্জে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি নিহত

মালয়াম অভিনেত্রীকে যৌন হয়রানি, আটক স্বর্ণ ব্যবসায়ী

মালয়াম অভিনেত্রীকে যৌন হয়রানি, আটক স্বর্ণ ব্যবসায়ী

‘উন্নয়ন চাইলেও গণতন্ত্র দরকার সংস্কার চাইলেও গণতন্ত্র দরকার’বিএনপি শীর্ষ নেতা নজরুল ইসলাম খান

‘উন্নয়ন চাইলেও গণতন্ত্র দরকার সংস্কার চাইলেও গণতন্ত্র দরকার’বিএনপি শীর্ষ নেতা নজরুল ইসলাম খান

কেরানীগঞ্জের অস্থায়ী আদালতে চলবে বিডিআর বিদ্রোহ মামলা

কেরানীগঞ্জের অস্থায়ী আদালতে চলবে বিডিআর বিদ্রোহ মামলা

বিশ্বাসের ঘরে ষড়যন্ত্র চলছে: ফারুক

বিশ্বাসের ঘরে ষড়যন্ত্র চলছে: ফারুক

ট্রাম্পের ছেলে ডনাল্ড জুনিয়রের গ্রিনল্যান্ড ভ্রমণ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা

ট্রাম্পের ছেলে ডনাল্ড জুনিয়রের গ্রিনল্যান্ড ভ্রমণ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা

সরকার নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে: প্রধান উপদেষ্টা

সরকার নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে: প্রধান উপদেষ্টা

বিয়ের পূর্বে স্ত্রীর অন্য পুরুষের সাথে অবৈধ সম্পর্ক থাকা প্রসঙ্গে।

বিয়ের পূর্বে স্ত্রীর অন্য পুরুষের সাথে অবৈধ সম্পর্ক থাকা প্রসঙ্গে।

লন্ডন ক্লিনিকে ভর্তি হলেন খালেদা জিয়া

লন্ডন ক্লিনিকে ভর্তি হলেন খালেদা জিয়া

টিম কম্বিনেশনের জন্য দলের বাইরে ছিলাম: রিশাদ

টিম কম্বিনেশনের জন্য দলের বাইরে ছিলাম: রিশাদ

ফুলপুরে তারুণ্যের উৎসব উদযাপনে ফুটবল প্রতিযোগিতায় রুপসী বিজয়ী

ফুলপুরে তারুণ্যের উৎসব উদযাপনে ফুটবল প্রতিযোগিতায় রুপসী বিজয়ী

নাগরিক অধিকার না হলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না মুফতী ফয়জুল করীম

নাগরিক অধিকার না হলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না মুফতী ফয়জুল করীম

মানিকগঞ্জে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ঘিওর উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি এ্যাড.আব্দুল আলীম বহিষ্কার

মানিকগঞ্জে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ঘিওর উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি এ্যাড.আব্দুল আলীম বহিষ্কার

অনলাইনে ফি আদায়ে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাথে সোনালী ব্যাংকের চুক্তি

অনলাইনে ফি আদায়ে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাথে সোনালী ব্যাংকের চুক্তি

নোবিপ্রবিতে আন্ত:বিভাগ ফুটবল প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠিত

নোবিপ্রবিতে আন্ত:বিভাগ ফুটবল প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠিত