ভারত প্রতিবেশীদের বন্ধুত্ব হারাচ্ছে
১২ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৮ এএম | আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৮ এএম
ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি অনেক কারণেই ঘটছে এবং এর পেছনে প্রধানত রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং ঐতিহাসিক বিষয়ের জটিলতা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ভারত নিজের পররাষ্ট্র নীতির দিকে যে পরিবর্তন এনেছে, তা প্রতিবেশী দেশগুলির কাছে প্রত্যাশিত ফলাফল এনে দেয়নি। যদিও মোদির ‘পড়শি প্রথম’ নীতি প্রথমে ভালোবাসা পেয়েছিল, এর পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি ঘুরে গেছে। এখানে কিছু কারণ ব্যাখ্যা করা হলো:
১. উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং শক্তিশালী ডানপন্থী আন্দোলন
ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশে উগ্র জাতীয়তাবাদী ধারণার ক্রমবর্ধমান প্রভাব পররাষ্ট্র নীতির উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। মোদির নেতৃত্বে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং তার সহযোগী দলগুলো জাতিগত এবং ধর্মীয় ঐক্যের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও সংস্কৃতির চর্চায়। এর ফলে দেশীয় রাজনীতি প্রতিক্রিয়াশীল জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির দিকে ঝুঁকেছে, যা প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
২. চীন-ভারত সম্পর্ক
চীন-ভারত সম্পর্ক ইতিহাসে জটিল এবং দ্বন্দ্বপূর্ণ ছিল এবং মোদির শাসনামলে এ সম্পর্ক আরো তীব্র হয়ে উঠেছে। ভারতের চীন সীমান্তের বিতর্ক, বিশেষত লাদাখ অঞ্চল নিয়ে উত্তেজনা নিয়মিত উত্থিত হয়েছে। ২০২০ সালে লাদাখ সীমান্তে চীনা বাহিনীর সাথে ভারতীয় বাহিনীর সংঘর্ষ এবং তার পরবর্তী উত্তেজনা দুটি দেশের সম্পর্ককে আরো খারাপ করেছে। চীনকে ভারতের ভূখ-ে প্রবেশ করার ব্যাপারে মোদির বক্তব্য, ‘চীন আমাদের ভূখ-ে প্রবেশ করেনি’, একাধিক প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে। এই বক্তব্য ভারতের জনগণের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি করেছে এবং চীনকে যুক্তিসঙ্গতভাবে আরও শত্রু হিসেবে দেখার অনুভূতি বাড়িয়েছে। চীনের সাথে ভারতের সম্পর্ক অবনতির একটি বড় কারণ সীমান্ত বিরোধ এবং ভারতীয় ভূখ-ে চীনা বাহিনীর উপস্থিতি।
চীন এবং ভারতের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক, যা অতীতে অনেক সমৃদ্ধ ছিল, এখন নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের নানা বিতর্কে আছন্ন হয়ে পড়েছে। চীনের সঙ্গে ভারতের কৌশলগত সম্পর্ক এবং বাণিজ্য পরিসরে ভারতে চীনা পণ্যের প্রতি সীমাবদ্ধতা এবং সরকারি নীতির কারণে বেশ কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। চীন এখন ভারতীয় অর্থনীতি এবং প্রতিরক্ষা সক্ষমতার বিরুদ্ধে কৌশলগত প্রতিযোগী হয়ে উঠেছে, যা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। এভাবে, চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের এই উত্তেজনা আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতকে আরও বিচ্ছিন্ন করেছে।
৩. নেপাল-ভারত সম্পর্ক
নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অত্যন্ত পুরনো এবং জটিল। এই সম্পর্ক নানা ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক কারণে টানাপোড়েনের মধ্যে রয়েছে। ২০১৫ সালে ভারতের সংবিধান সংশোধন নিয়ে নেপাল প্রতিবাদ জানিয়েছিল, যা দুই দেশের সম্পর্ককে আরো তিক্ত করে তোলে। ভারতের সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়ায়, বিশেষ করে মাদেসি জনগণের (যারা নেপালের সঙ্গে সীমান্তবর্তী ভারতীয় জনগণ) অধিকার সম্পর্কে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি, নেপালের কাছে অগ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছিল। নেপালের জনগণের মধ্যে এই সংশোধন নিয়ে বিরোধ গড়ে উঠেছিল এবং ভারতের প্রতি বিরোধিতার কারণে একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়।
এই পরিস্থিতিতে ভারত নেপালের বিরুদ্ধে একাধিক কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল, যার মধ্যে ২০১৫ সালে ভারতের নেপালের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ চাপানো ছিল অন্যতম। ভারতীয় অবরোধের ফলে নেপালে ব্যাপক মানবিক সংকট সৃষ্টি হয় এবং এটি নেপালের জনগণের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাবকে তীব্র করেছিল। বিশেষত, ভারতীয় অবরোধের কারণে নেপালে খাদ্য, জ্বালানি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ বিঘিœত হয়েছিল, যা নেপালের সরকার এবং জনগণের মধ্যে চরম অসন্তোষ তৈরি করেছিল। এই ঘটনা ভারত ও নেপালের সম্পর্কের মধ্যে একটি গভীর ছায়া ফেলেছিল।
৪. বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক
বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে একাধিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে, দুই দেশের মধ্যে কিছু সংকট এবং বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে, যা সম্পর্কের উন্নতি থামিয়ে দিয়েছে। ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) এবং ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন (এনআরসি)-এর মতো অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো বাংলাদেশের মধ্যে বেশ বিতর্কের সৃষ্টি করেছে, বিশেষত এগুলোর প্রভাব বাংলাদেশে বসবাসকারী মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর পড়তে পারে বলে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের প্রতি মোদি সরকারের অন্ধ সমর্থন, বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তি সম্পাদন, শোষণ ও লুণ্ঠন ইত্যাদি বাংলাদেশের মানুষকে বিক্ষুব্ধ করেছে। ভারতের দাদাগিরি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিরুদ্ধে প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশের মানুষ আর ভারতকে বিশ্বাস করে না।
৫. পাকিস্তান-ভারত সম্পর্ক
ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের অবনতি এক দীর্ঘ ইতিহাসের ফল। ১৯৪৭ সাল থেকেই কাশ্মীর বিষয়ক বিবাদ, সন্ত্রাসবাদ বিরোধী পদক্ষেপ, এবং সীমান্তে উত্তেজনা প্রভৃতি ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে। মোদি সরকার আসলে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ৩৭০ ধারা বাতিলের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক আরও কঠিন করে তুলেছে, যা তাদের মধ্যে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনাকে তীব্র করেছে। এই সিদ্ধান্তের পর পাকিস্তান ভারতীয় সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং ভারতকে এই সিদ্ধান্ত ফেরাতে চাপ দেয়।
কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর, পাকিস্তান ভারতীয় দৃষ্টিকোণকে চ্যালেঞ্জ করতে আন্তর্জাতিকভাবে চেষ্টা করেছে, বিশেষত জাতিসংঘের মাধ্যমে। মোদি সরকারের কঠোর পদক্ষেপের কারণে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। এরপর থেকে, দুই দেশের মধ্যে যেকোনো ধরনের কূটনৈতিক আলোচনা স্থগিত রাখা হয়েছে, যা সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটিয়েছে। সীমান্তের ওপারে ক্রমাগত সন্ত্রাসী হামলার অভিযোগ এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের অভিযোজন সম্পর্কের আরও দুর্বলতা সৃষ্টি করেছে।
ভারতের পররাষ্ট্র নীতি এবং প্রতিবেশী সম্পর্কগুলি উগ্র জাতীয়তাবাদ, সীমান্ত বিরোধ এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ক্রমাগত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। চীন, নেপাল, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশÑ এই দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ভারতের আন্তর্জাতিক কূটনীতির জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মোদির নেতৃত্বে ভারত প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে স্থিতিশীলতা ও সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না এবং এর ফলে ভারতীয় পররাষ্ট্র নীতি ও আন্তর্জাতিক অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
মাদুরোকে গ্রেপ্তারে ২৫ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের
যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয়েই একটি স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে চায় :বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত
অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে ইরানে অস্থিরতা বাড়ছে
দ্রুত নির্বাচন হলে সৃষ্ট সংকট দূর হবে : মির্জা ফখরুল
গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনে নিহত আরও ২১
নিষেধাজ্ঞার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাবে
অভিশংসিত প্রেসিডেন্ট বাসভবনকে ‘দুর্গে’ পরিণত করেছেন
ভারতের সঙ্গে করা জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিলের দাবি আনু মুহাম্মদের
পাকিস্তানিদের জন্য ভিসার শর্ত শিথিল করল বাংলাদেশ
মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের ঐক্যবদ্ধ কার্যকরী ভূমিকা সময়ের অপরিহার্য দাবি
রাজনীতি হওয়া উচিত জনমানুষের কল্যাণে -বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আসলাম চৌধুরী
বিএনপির সাথে জামায়াতের দূরত্ব নয় বরং সুসম্পর্ক রয়েছে -চাঁদপুরে ডা. তাহের
আদমদীঘিতে খালেদা জিয়ার রোগ মুক্তি কামনায় দোয়া
ছাত্রাবাস থেকে রুয়েট শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার
দেশীয় চোলাই মদের ট্রানজিট বোয়ালখালী
সোনারগাঁওয়ে বিনামূল্যে চক্ষু শিবির
রূপগঞ্জ অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সভা, সংবর্ধনা ও বার্ষিক মিলনমেলা অনুষ্ঠিত
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মীরাও ফ্যাসিস্ট সরকারের নিপীড়নের শিকার : অধ্যাপক মুজিবুর রহমান
সাম্প্রদায়িক হামলার অভিযোগে ১১৫টি মামলা, ১০০ জন গ্রেফতার
উন্মুক্ত মঞ্চে তরুণদের উচ্ছ্বাস