অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিনিয়োগে জোর দিতে হবে
২০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০২ এএম | আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০২ এএম
পতিত স্বৈরাচার তার সাড়ে ১৫ বছরে লুটপাটতন্ত্র কায়েম করে দেশের অর্থনীতি শেষ করে দিয়েছে। ঘুষ, দুর্নীতি, অর্থপাচার, বখরাবাজি ইত্যাদিতে অর্থনীতি এমন এক নাজুক অবস্থায় পৌঁছায়, যা বর্ণনাতীত। ডলার সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান, আমদানি-রফতানি হ্রাস, কর্মসংস্থানে অচলাবস্থা, বেকারত্ব বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ-শিল্পায়নে স্থবিরতা দেশকে মারাত্মক বিপন্ন অবস্থায় নিক্ষেপ করে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার বিদায় নিয়েছে। মাফিয়াতন্ত্রের অবসান হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নিয়ে প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া অর্থনীতির হাল দেখে বিস্মিত ও হতবাক হয়েছে। কীভাবে অর্থনীতি দুর্নীতি ও লুটপাটে নিঃস্ব হয়েছে, একে একে তার যত তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে, মানুষ ততই বিস্মিত হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার সঙ্গতকারণেই অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে মনযোগ দিতে বাধ্য হয়েছে। গত পাঁচ মাস ধরে ভেঙে পড়া ব্যাংক খাত দাঁড় করাবার চেষ্টা হচ্ছে। ইতোমধ্যে কিছুটা সুফল এসেছে। অস্থিরতা কমেছে। পুঁজিবাজার পুনর্গঠনের চেষ্টা অব্যাহত আছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে পুঁজিবাজার ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে। রেমিট্যান্সে একটা জোয়ার পরিলক্ষিত হচ্ছে। রফতানিতে প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। আমদানি ব্যয়ের স্থিতিশীলতাও দেখা যাচ্ছে। এসব অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক লক্ষণ। পুঁজিবাজারসহ এই দিকগুলোতে আরো নজরদারি বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ড. মইনুুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, এই অগ্রগতি নস্যাৎ করার জন্য এক শ্রেণির ব্যবসায়ী চেষ্টা করছে। কাজেই বাংলাদেশ ব্যাংককে মনিটরিং বাড়াতে হবে। দীর্ঘদিনে ধীরে ধীরে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে অর্থনীতিকে খাদের কিনারে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে। পাঁচ মাসে তার পুনরুদ্ধার ও পুনর্গঠন আশা করা যায় না। এজন্য আরো সময় ও লাগাতার চেষ্টা চালাতে হবে। বিশ্বব্যাংক আগামীতে বাংলাদেশের অর্থনীতির ঝুঁকির দিকগুলো চিহ্নিত করেছে। বলেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে অর্থনীতির গতি কমবে; কারণ, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং বিনিয়োগ ও শিল্পখাতে ভাটার টান। বিপরীতে মূল্যস্ফীতি থাকবে চড়া। বিশ্বব্যাংকের মতে, এ বছর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৪ দশমিক ১ শতাংশে নামতে পারে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়ার মানে, অর্থনীতির গতি মন্থর হওয়া ও কর্মসংস্থানের হার কমা, বেকারত্ব বৃদ্ধি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি হ্রাস পাওয়া।
দেশের ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা অর্থনীতিতে সুবাতাস প্রত্যাশা করছেন। সরকারের ইতিবাচক সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ কামনা করছেন। বিদ্যমান ও আশংকিত পরিস্থিতিতে তারা উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত। তারাই শুধু নন, অর্থনীতিবিদরাও বলেছেন, ব্যাপক বিনিয়োগ ছাড়া অর্থনীতি দৃঢ়ভিত্তি ও স্থিতিশীলতা লাভ করতে পারবে না। মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর ‘স্বেতপত্র এবং অতঃপর : অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, সংস্কার ও বাজেট’ শীর্ষক এক সিম্পোজিয়ামে বলেছেন, বিনিয়োগের ব্যাপারে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকাীদের আস্থা অত্যন্ত নেতিবাচক। তার মতে, এখন অর্থনীতি এতটাই নাজুক যে গত ৩৪ বছরে এমনটি দেখা যায়নি। বিনিয়োগে চ্যালেঞ্জের কথাও তিনি বলেছেন, যার মধ্যে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ও কষ্ট অব ফাইনান্সের উচ্চমুখিতা অন্যতম। ওই একই সিম্পোজিয়ামে প্রধান অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান অন্তর্বর্তী সরকারকে বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টিতে উদ্যোগী হওয়ার আহবান জানিয়েছেন। তার মতে, উপযুক্ত বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিত করা হলে বিদেশে অর্থপাচার, অর্থ স্থানান্তর ও বিনিয়োগ কমে যাবে এবং দেশেই তা বিনিয়োগ হবে। তিনি আরো বলেছেন, বিদেশে অর্থ চলে যাওয়া অর্থনীতির জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ ও গতিশীল করার জন্য বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই। পতিত স্বৈরাচারের সময়ে বৈদেশিক ঋণের টাকায় বড় বড় মেগা প্রকল্প গ্রহণ করাতে যতটা আগ্রহ দেখা গেছে, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ প্রতিষ্ঠা ও বিনিয়োগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে ততটাই অনাগ্রহ ও অনীহা প্রত্যক্ষ করা গেছে। বলা বহুল্য, মেগা প্রকল্পে বিদেশি বিনিয়োগ করা হয়েছে বখরাবাজির সুবিধার জন্য। যাহোক, বিনিয়োগ বাড়লে শিল্পায়ন হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়বে। উৎপাদন ও রফতানি বাড়বে। কর্মসংস্থান হবে। বেকারত্ব কমবে। মানুষের আয় বাড়বে, ক্রয় ক্ষমতা বাড়বে। জীবনযাত্রার উন্নয়ন ও বিকাশ ঘটবে। এতদিন বিনিয়োগের কেন্দ্রে দেশ ও মানুষ আসেনি। মাফিয়াচক্র উন্নয়নের গান গেয়ে লুটপাট করেছে। এখন সময় এসেছে বিনিয়োগে গতি আনার। তার জন্য আগে বিনিয়োগ পরিবেশে নিশ্চিত করতে হবে। জমি, ব্যাংক ঋণ, গ্যাস-বিদ্যুতের যোগান নিশ্চিত করতে হবে। ব্যবসা শুরুর সময় ও ব্যয় কমাতে হবে। রাজনৈতিক স্থিতি ও আইন-শৃঙ্খলার উন্নয়ন সাধন করতে হবে।
আমাদের অর্থনীতির সংকট আছে, বাধা আছে, চ্যালেঞ্জ আছে। কিন্তু সম্ভাবনাও কম নেই। বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অর্থনৈতিক কারবার ও গ্রোথ দুই-ই বাড়ছে বিভিন্ন দেশে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশ আগের চেয়ে সামনে সুদিন দেখছে। আমাদের উন্নয়ন সহযোগী ও বাণিজ্য সহযোগী দেশগুলোকে যদি আমরা বিনিয়োগে আগ্রহী করে তুলতে পারি, বাণিজ্য বাড়াতে উদ্বুদ্ধ করতে পারি, তবে আমাদেরই সবচেয়ে বেশি লাভ হবে। এ জন্য যোগাযোগ ও সুসম্পর্ক বৃদ্ধি জরুরি। অন্তর্বর্তী সরকারকে এদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এ সরকার ক্ষমতাশীন হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, জাপান প্রভৃতি দেশ যেভাবে স্বাগত জানিয়েছিল, বিনিয়োগসহ সর্বক্ষেত্রে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিল, তা এখনো কাজে লাগানো যায়নি। এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে। আইএমএফ’র ঋণের শর্ত পালনে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে জনগণের ঘাড়ে খরচের বোঝা না চাপিয়ে বিদেশি বিনিয়োগ ও আর্থিক সহযোগিতা আনার চেষ্টা করা উচিত ছিল। অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদসহ অনেকেই ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির তীব্র সমালোচনা করেছেন। ব্যবসায়ীরাও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। অন্তত একশ’ পণ্য ও সেবায় শুল্ক বৃদ্ধি হওয়ায় মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে। পর্যবেক্ষক-বিশ্লেষকদের মতে, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ইত্যাদি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দারস্থ হওয়া দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর উচিত নয়। তাদের ঋণের শর্ত মানতে গিয়ে জনগণের ওপর জুলুম চালাতে বাধ্য হতে হয়। পরিশেষে আমরা যা বলতে চাই, তাহলো আমাদের অর্থনীতির সমৃদ্ধি ও বিকাশের যেসব সম্ভাবনা আছে, সেগুলোকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো রেমিট্যান্স। সেটা বাড়ছে। আরো বাড়াতে হবে। বিদেশে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। রফতানি, বিশেষত গার্মেন্ট রফতানি বাড়াতে হবে। আমাদের গার্মেন্টপণ্য প্রধানত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে যায়। ওই বাজার ধরে রাখাই শুধু নয়, আরো বাড়াতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়াতে আমাদের একটি বাড়তি সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হলে তার সুফল বাংলাদেশ পেতে পারে। গামের্ন্ট আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্র ট্যাক্স আরোপ করে রেখেছে বাংলাদেশের জন্য ১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ আর চীনের জন্য ২৫ শতাংশ। চীনের ক্ষেত্রে আগামীতে শুল্ক হতে পারে ৬০ শতাংশ। সঙ্গতকারণেই এতে চীনের রফতানি কমবে। এই হিসাবটি বাংলাদেশ পেতে পারে। এনিয়ে এখনই বাংলাদেশের তৎপর হওয়া দরকার। মোটকথা, আমাদের সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে আমরা সহজেই অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম হতে পারি।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ব্রাইটনের বিপক্ষেও বিপর্যস্ত ইউনাইটেড
‘ন্যায়বিচারকে হত্যা’ করা হয়েছে: পিটিআই
নতুন ভূগর্ভস্থ নৌ ঘাঁটি উন্মোচন ইরানের
রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধ করছে অনেক আফ্রিকান সেনা
পাওয়ার প্ল্যান্টের ৩৬০ মেট্রিকটন তেল ডাকাতি
বাংলাদেশি কর্মী নিতে প্রস্তুত রাশিয়া: রাষ্ট্রদূত
রাজনৈতিক দলগুলো বেশি কিছু সংস্কার না চাইলে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন: প্রেস সচিব
এবার ওলমোর ইনজুরি দুঃসংবাদ বার্সার
কুড়িগ্রাম স্টুডেন্টস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃত্বে ইমন ও আলামিন
এসএমই ফাউন্ডেশনের নতুন চেয়ারপার্সন মো. মুশফিকুর রহমান
বিয়ের ওপর কর বাতিলের দাবি
শহীদ জিয়ার নাম মুছে ফেলার অপচেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছে আ.লীগ : মির্জা ফখরুল
নামাজের প্রথম কাতারে জামাত পড়াবস্থায় অজু ভেঙ্গে যাওয়া প্রসঙ্গে।
কয়েক মিনিটে বাংলাদেশ দখল করে নিতে পারে ভারত: শুভেন্দু অধিকারী
নরসিংদীতে নিখোঁজের ৫ দিন পর নদীতে পাওয়া গেল স্কুল ছাত্রের লাশ
বিএনপি : দেশবাদ যার রাজনীতির মূল কথা
পাহাড়ি উপজাতিরা আদিবাসী নয়
সংস্কার প্রতিবেদন : জাতির নতুন অধ্যায়ে অভিযাত্রা
ভারতে ৫ বছর সাজাভোগ করে দেশে ফিরলেন স্বামী-স্ত্রী
চার দিনের সফরে সোমবার সুইজারল্যান্ড যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা