জিয়া : স্বাধীনতার ঘোষক
১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৬ এএম
১৯৭১ সালের মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথম প্রহরেই মেজর জিয়াউর রহমান নিজেকে প্রভিশননাল প্রেসিডেন্ট হিসেবে উল্লেখ করে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দেন । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, গবেষণা চলছে । মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনেক বই লেখা হয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অনন্য দলিল এসব বইয়ে নানাভাবে উঠে এসেছে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার দলিল ও প্রেক্ষাপট ।
২৫ মার্চ মধ্যরাতে নিরস্ত্র জনগণের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হামলায় বেঘোরে প্রাণ হারায় অসংখ্য মানুষ । বাঙালির এই দুঃসময়ে জীবনবাজি রেখে প্রবল বিক্রমে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন মেজর জিয়াউর রহমান । চট্টগ্রামে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত তার স্বাধীনতার ঘোষণায় উদ্বেলিত জনগণ সাহসের সঙ্গে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে । স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি তিনি । ‘উই রিভোল্ট› হুংকার দিয়ে নিজেও নেতৃত্ব দেন সশস্ত্র সংগ্রামে । জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা ২৬, ২৭ এবং ২৮ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার প্রচারিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, তৃতীয় খ-ে জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণাটি বর্ণিত হয়েছে।
মেজর জিয়ার স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণাটি ছিল এই:
Dear fellow freedom fighters,
I, Major Ziaur Rahman, Provisional President and Commander-in- Chief of Liberation Army do hereby proclaim independence of Bangladesh and appeal for joining our liberation struggle. Bangladesh is independent. We have waged war for the libreation of Banglsdesh. Everybody is requested to participate in the liberation war with whatever we have. We will have to fight and liberate the country from the occupation of Pakistan Army.
Inshallah. victory is ours.
মুক্তিযুদ্ধের ৩ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর কে এম সফিউল্লাহ (বীর উত্তম) তাঁর [Bangladesh at War, Academic Publishers, Dhaka, 1989] বইয়ের ৪৪-৪৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘মেজর জিয়া ২৫ মার্চের রাত্রিতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সদলবলে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তার কমান্ডিং অফিসার জানজুয়া ও অন্যদের প্রথমে গ্রেফতার এবং পরে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন । পরে ২৬ মার্চ তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর মোকাবিলার জন্য সবাইকে আহ্বান জানান । এতে তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান রূপে ঘোষণা করেন । ২৭ মার্চ মেজর জিয়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আরেকটি ঘোষণায় বলেন, বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সামরিক সর্বাধিনায়করূপে আমি মেজর জিয়া শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।’
মেজর কে এম শফিউল্লাহ ১৯৮৯ সালে তাঁর রচিত, Bangladesh at War গ্রন্থে আরো লিখেন, ‘Having settled his score with his commanding officer on the night of March 25, Zia decided to take his battalion on the outskirts of the city to re-organise, strengthen and then launch a decisive blow on Chittagong. All troops were collected at a place near Patiya.
...All the troops then took an oath of allegiance to Bangladesh. The oath was administered by Zia at 1600 hrs. on March 26. Thereafter, he distributed 350 soldiers of East Bengal Regiment and about 200 troops of East Pakistan Rifles to various task forces under command of an officer each. These task forces were meant for the city. The whole city of Chittagong was divided into various sectors and each sector was given to a task force. After having made these arrangements, Zia made his first announcement on the radio on March 26. In this announcement apart from saying that they were fighting against Pakistan army, he also declared himself as the head of state. This, of course, could have been the result of tension and confusion of the moment. As the battalion began to gather strength, in the afternoon of March 27, Zia made another announcement from the Shwadhin Bangla Betar Kendra established at Kalurghat. The announcement reads as follows:
a. I, Major Zia, provisional commander-in-chief of the Bangladesh liberation army, hereby proclaim, on behalf of Sheikh Mujibur Rahman, the independence of Bangladesh.
b. I, also declare, we have alreadz formed a sovereign, legal government under Sheikh Mujibur Rahman which pledges to function as per law and the constitution.
c. The new democratic government is committed to a policy of non- alignment in international relations. It will seek
friendship with all nations and strive for international peace.
d. I appeal to all governments to mobilize public opinion in their respective countries against the brutal genocide in Bangladesh.
[He further said, «We shall not die like cats and dogs but shall die as worthy citizens of Bangla Ma. Personnel of the East Bengal Regiment, the East Pakistan Rifles and the entire police force had surrounded West Pakistani troops in Chittagong, Comilla, Sylhet, Jessore, Barisal and Khulna. Heavy fighting was continuing.’]
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডিক্লাসিফাই করা বাংলাদেশ সংক্রান্ত দলিলপত্রে বলা হয়েছে: On March 27 the clandestine radio announced the formation of a revolutionary army and a provisional government under the leadership of a Major Zia Khan.
[ভারত সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ বিষয়ক ইতিহাস প্রকাশিত হয়েছে ‘ভারত রক্ষক› শিরোনামীয় সাইটে। সেখানে ৯৩ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর জিয়া ২৬ তারিখে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং তিনি ‹বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের (Temporary Head of Republic) দায়িত্বও গ্রহণ করেছেন।’
১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পরবর্তীতে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ জাতির উদ্দেশে একটি বক্তব্য দেন, যেটি প্রচারিত হয় ১১ এপ্রিল ১৯৭১ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে । সেখানে তাজউদ্দিন আহমদ বলেন, The brilliant success of our fighting forces and the daily additions to their strength in manpower and captured weapons has enabled the Government of the Peoples Republic of Bangladesh, first announced through Major Ziaur Rahman, to set up a fullfedged operational base from which it is administering the liberated areas.” [Bangladesh Documents, vol-I, Indian Government, Page 284] .
মইদুল হাসান লিখেছেন, মেজর জিয়া তাঁর প্রথম বেতার বক্তৃতায় নিজেকে ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ হিসেবে ঘোষণা করলেও পরদিন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পরামর্শক্রমে তিনি শেখ মুজিবের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার কথা প্রকাশ করেন। [মূলধারা : ৭১,ইউপিএল, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ৫]। একই পৃষ্ঠায় মঈদুল হাসান আরো লিখেন, ‘মেজর জিয়া শেখ মুজিবের নির্দেশে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার কথা বললেও নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে আগেকার ঘোষণা সংশোধন করেননি।’
মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টর কমান্ডার (১১ জুন থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১) পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর রফিক-উল ইসলাম (বীর উত্তম) তাঁর A Tale of Million বইয়ের ১০৫-১০৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘২৭ মার্চের বিকালে তিনি (মেজর জিয়া) আসেন মদনাঘাটে এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন । প্রথমে তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধানরূপে ঘোষণা করেন । পরে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন।’ কেন জিয়া মত পরিবর্তন করেন তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন মেজর রফিক- উল ইসলাম বলেছেন: ‘একজন সামরিক কর্মকর্তা নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধানরূপে ঘোষনা দিলে এই আন্দোলনের রাজনৈতিক চরিত্র (Political Character of the Movement) ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং স্বাধীনতার জন্য এই ঘোষণা গণ- অভ্যুত্থাানরূপে চিত্রিত হতে পারে, এই ভাবনায় মেজর জিয়া পুনরায় ঘোষণা দেন শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে । এই ঘোষণা শোনা যায় ২৮ মার্চ পর্যন্ত।’
মেজর এম এস এ ভূঁইয়া (সুবিদ আলী ভূঁইয়া) তাঁর ‘মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস’ বইয়ের ৫৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “এখানে মেজর জিয়াউর রহমানের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন । আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, বেতার কেন্দ্র থেকে যাঁরা সেদিন মেজর জিয়ার ভাষণ শুনেছিলেন তাঁদের নিশ্চয় মনে আছে, মেজর জিয়া তাঁর হেড অব দি স্টেট ‹ অর্থাৎ রাষ্ট্রপ্রধানরূপেই প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন।’ তিনি আরো লিখেন, সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা এই যে, জিয়াউর রহমান নিজে উদ্যোগ নিয়েই এই ঘোষণা প্রচার করেছিলেন। এতে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের কতটুকু সুবিধা হয়েছিল তাও বিচার্য। সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলার নিরিখে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলার মান ছিল অত্যন্ত উঁচু । ওই সেনাবাহিনীতে প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর ওই সেনাবাহিনীর অফিসার হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণার ঝুঁকি নেয়াটা কম কথা নয় । এর একটা মারাত্মক দিকও ছিল। বিদ্রোহ যদি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যেত তাহলে যারা সেনাবাহিনীতে ছিলেন, মিলিটারি বিচার অনুযায়ী তাদের ভাগ্যে কি জুটত? সামরিক বাহিনীতে যারা ছিলেন এবং যাদের নাম বিপ্লবের শুরুতেই জানাজানি হয়েছিল তাদের ভাগ্যে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ই ছিল না। পাঠক নিশ্চয়ই জানেন, ইতিহাসে বিদ্রোহ করার অপরাধে সামরিক বাহিনীর কত লোকেরই না ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে যেতে হয়েছে। বিদ্রোহ যদি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হতো এবং তৎকালীন পাকিস্তান সরকার টিকে থাকত তখন আমাদের অবস্থাও তাই হতো।”
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে : তারেক রহমান
ঋণখেলাপিরা যাতে মনোনয়ন না পায় চেষ্টা করবো : মির্জা ফখরুল
অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর না হলে রাজনৈতিক সংস্কার টেকসই হবে না : বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি
টিসিবি’র এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডধারীর মধ্যে ৩৭ লাখই ভুয়া: বাণিজ্য উপদেষ্টা
ভোজ্যতেলের সরবরাহ নিশ্চিতে কারখানা পরিদর্শন ভোক্তা অধিকারের
গণপরিবহনে শৃঙ্খলায় কাউন্টার স্থাপনের পরিকল্পনা
রাজধানীর তিন পার্কে ভেন্ডারের চুক্তি : শর্ত ভঙ্গের তদন্তে ডিএনসিসি
বাবা-মায়ের পুরোনো বাড়িতে যাই : শফিকুল আলম
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসায় ১৫০ কোটি টাকা অনুদান
২০২৪ সালে ৩১০ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা
ভারতীয় ৭২ গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে অপতথ্য প্রচার
লেবানন থেকে দেশে ফিরলেন আরো ৪৭
প্লাটফর্ম বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত
শক্তিশালী অর্থনীতি ও গর্বিত জাতি গড়তে শহীদ জিয়ার দর্শন ধারণ করতে হবে : আমির খসরু
কী আছে তৌফিকার লকারে?
ঘটনার তিনদিন পর থানায় মামলা
অনিয়ম ঢাকতে তড়িঘড়ি করে নির্বাচনের পাঁয়তারা
শেবাচিম হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের দুরবস্থা
৯৬টি সিএনজি ভাঙ্গাড়ি হিসাবে সাড়ে ১১ লাখ টাকায় বিক্রি
৩১ দফা জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে রূপগঞ্জে বিএনপির সমাবেশ