ড. মুহাম্মদ ইউনূসেই জনগণের আস্থা
২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৫ এএম
রক্তক্ষয়ী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট ইতিহাসের নিকৃষ্টতম ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনের অবসানের পর যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, তার প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নোবেল জয়ী বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিকল্প আর কেউ ছিল না। তিনি এমনই এক ব্যক্তিত্ব, যিনি দেশের জনগণের তো বটেই, বিশ্বের কাছে বহুল আকাক্সিক্ষত শ্রদ্ধা ও আস্থার প্রতীক। বাংলাদেশের সৌভাগ্য যে, তাঁর মতো এমন একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে তাঁর দায়িত্ব নেয়াকে দলমত নির্বিশেষে সকলেই অভিনন্দিত করেছেন। পরাশক্তিসহ প্রভাবশালী দেশগুলো তাঁকে অকুণ্ঠচিত্তে সম্ভাষণ জানিয়ে পাশে থাকা ও সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। হাসিনার ভেঙে দেয়া রাষ্ট্র কাঠামো এবং শূন্য হয়ে যাওয়া অর্থনীতিকে পূর্ণ করার এক কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস যাত্রা শুরু করেছেন। একদিকে, রাষ্ট্র সংস্কার ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কাজ, অন্যদিকে দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের মতো দুর্গম পথ তাঁকে পাড়ি দিতে হচ্ছে। ফ্যাসিস্ট শাসনে ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেশের পুনর্গঠন সহজ নয়। ড. মুহাম্মদ ইউনূস দিনরাত পরিশ্রম করে কঠিনতম এই কাজটি তাঁর পরিষদবর্গ নিয়ে করে যাচ্ছেন। বলা বাহুল্য, অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচিত কিংবা নির্দিষ্ট মেয়াদের সরকার নয়। জনগণের স্বপ্রণোদিত জরুরি পরিস্থিতির সরকার। তার দায়িত্ব ডুবন্ত দেশকে ডাঙ্গায় তুলে নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া।
শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দেয়া এবং আস্থা রাখা যে জনগণের সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল, তা তাঁর দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই প্রামাণিত হয়েছে। আমরা দেখেছি, সারাবিশ্ব কীভাবে তাঁকে অভিনন্দিত করেছে, গ্রহণ করেছে। দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে উন্নত বিশ্বের কাছে সহযোগিতা চাওয়ার আগেই জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, অস্ট্রেলিয়াসহ আন্তর্জাতিক সংস্থা আইডিবি, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, জাইকা তাঁকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। প্রবাসীরা অকুণ্ঠচিত্তে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে। শূন্য হয়ে যাওয়া রিজার্ভ ধীরে ধীরে পূর্ণ হয়ে এখন স্থিতিশীল অবস্থায় এসেছে। লুটপাট হয়ে যাওয়া ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। দায়িত্ব নেয়ার অব্যবহতি পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়েছিলেন, তখন সারাবিশ্ব দেখেছে, সদ্যসাবেক যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কতটা আন্তরিকতার সাথে তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব থেকে শুরু করে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর সরকার প্রধানরা তাঁর সাথে একের পর এক বৈঠক করেছেন। বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাঁর সাথে দেখা করার জন্য আগ্রহভরে অপেক্ষা করেছেন। ঠিক একই চিত্র দেখা গেছে, সুইজারল্যান্ডের দোভাসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিওএফ) বার্ষিক সম্মেলনে। এই সম্মেলনের ফাঁকে ফাঁকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বের প্রায় অর্ধশত দেশের নেতা ও ব্যক্তিত্বের সাথে বৈঠক করেছেন। এমন ঘটনা আর কোনো নেতার সাথে ঘটতে দেখা যায়নি। তিনি অকপটে বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিশ্বদরবারে তুলে ধরেছেন। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা দেড় দশক ধরে উন্নয়নের কথা বলে দেশের মানুষের সাথে যে ধোঁকাবাজি করেছেন, জিডিপি বাড়িয়ে দেখিয়েছেন, লক্ষ-কোটি টাকা পাচার করেছেন এবং আগামী জাতীয় নির্বাচন কখন, কীভাবে হবে, তা অকপটে বলেছেন। তিনি হাসিনার পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার সহযোগিতা যেমন চেয়েছেন, তেমনি তার দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন না করায় বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমালোচনাও করেছেন। তাঁর মতো ব্যক্তিত্বই পারেন, বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি অভিযোগের প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে। এটা আমাদের দেশের জন্য অত্যন্ত গৌরবের। গত বৃহস্পতিবার ডব্লিউএফ-এর প্রতিষ্ঠাতা ক্লাউস শোয়েবের সাথে এক বৈঠকে আগামী নির্বাচন নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস খোলাখুলি কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের নাগরিকরা যাতে কোনো বাধা বা হুমকি ছাড়া অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে পারে, সেই পথ সরকার তৈরি করছে। গত ১৬ বছরে বাংলাদেশে যারা নতুন ভোটার হয়েছে, তাদের ভোট দেয়ার সুযোগ হয়নি, যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। তিনি বলেছেন, সরকার নির্বাচন আয়োজনের অপেক্ষায় রয়েছে, তবে জনগণকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে প্রক্রিয়াটি কেমন হবে। তারা কি ছোট পরিসরের সংস্কার কর্মসূচিতে যাবে, নাকি দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার চাইবে। যদি মানুষ দ্রুত সংস্কার চায়, তাহলে আমরা এ বছরের শেষ নাগাদ নির্বাচন করার লক্ষ্য নিয়েছি। আর যদি বলে, দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার দরকার, তাহলে আমাদের আরও ছয় মাস সময় লাগবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এ বক্তব্য থেকে নির্বাচন কবে হবে, তার টাইম ফ্রেম আরও স্পষ্ট হয়েছে। তিনি বরাবরই একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ওপর তাঁর প্রচেষ্টা ও ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করে আসছেন। তিনি আগেও বলেছেন, আমরা এমন একটি নির্বাচন করব, যা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে এবং দেশ-বিদেশের মানুষ মনে রাখবে। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা এবং সমন্বয়করা মাঝে মাঝে এমন কথা বলেন, যা সরকারের ভাবমর্যাদা ক্ষুণœ করছে। নির্বাচন এবং সংস্কার নিয়ে একেক সময় একেক কথা বলে সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলা এবং সমন্বয়ের অভাবকে ফুটিয়ে তুলছেন। সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টাকে রাজনৈতিক দলের সাথে বাগবিত-ায় জড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে। অথচ তাদের এ ধরনের বিত-ায় জড়ানো উচিৎ নয়। কারণ, অন্তর্বর্তী সরকার কোনো রাজনৈতিক দলের নয় এবং উপদেষ্টারাও রাজনৈতিক দলের নন যে, সরকারের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলের সাথে বাহাস করবেন। তাদের যদি রাজনৈতিক বাহাস করতে হয়, তাহলে সরকার থেকে বের হয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করে সমালোচনায় লিপ্ত হতে পারেন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে যে প্রশ্ন তুলেছেন, তা সরকারে থেকে উক্ত উপদেষ্টাদের রাজনৈতিক দল গঠন প্রক্রিয়ার সাথে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকার কারণেই উঠেছে। এতে সরকারের নিরপেক্ষতার বিষয়টি ক্ষুণœ হচ্ছে বলেই মির্জা ফখরুল মন্তব্য করার সুযোগ পেয়েছেন। উপদেষ্টাদের মন্তব্যে এটা প্রতীয়মান হয়েছে, তারা যেন সরকারের বাইরে গিয়ে কথা বলেছেন, যার সঙ্গে সরকারের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তারা এটা করতে পারেন কিনা, সে প্রশ্ন এখন পর্যবেক্ষকরা তুলেছেন। তাদের এ ধরনের বক্তব্য ও আচরণ অনেকটা অর্বাচীনের মতো হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, বিএনপির কিছু নেতা এমনভাবে কথা বলছেন, যাতে পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সাথে কেউ কেউ মিল খুঁজে পাচ্ছেন। বিএনপি নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল তো বলেই ফেলেছেন, ‘জয় বাংলা’ স্বাধীনতার শ্লোগান। তার এ কথার মাধ্যমে ভারত ও আওয়ামী লীগের কথার কোনো ফারাক নেই। অনেকে এখন এমন মনে করছেন, বিএনপির কিছু নেতা ভারতের এজেন্ট হয়ে কথা বলছেন এবং ভারতের সহযোগিতা ছাড়া বিএনপি ক্ষমতায় যেতে পারবে না, এমন ধারণা দেয়ার চেষ্টা করছেন। বিএনপির উচিৎ, এসব বিতর্কিত নেতাদের চিহ্নিত করে দলের কর্মকা- থেকে বিরত রাখা। দেশের মানুষ জানে, বিএনপির রাজনীতি এবং ক্ষমতায় যাওয়ার মূল শক্তিই হচ্ছে, জাতীয়তাবাদী রাজনীতি। এটিই দলটির মৌলিক ভিত্তি। এই ভিত্তির উপরই জিয়াউর রহমান দল গঠন করেছেন এবং বেগম খালেদা জিয়া তা ধারন করে বিএনপিকে বারবার ক্ষমতায় এনেছেন। দুঃখের বিষয়, বিএনপির কোনো কোনো নেতার বক্তব্যের কারণে বিএনপি এই মৌলিক চরিত্র হারাতে বসেছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, আগামী নির্বাচনে যেতে বিএনপিকে ভারতের সহযোগিতা ও সমর্থনের প্রয়োজন নেই। তার রাজনীতির মূলনীতি অবলম্বন করাই যথেষ্ট। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভারততোষণ নয়, বরং জাতীয় স্বার্থে ভারতের চোখে চোখ রেখে কথা বলছেন। বিএনপির উচিৎ, এই নীতি অবলম্বন করে চলা।
আগামী জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সঠিক পথে রয়েছেন। সংবিধান সংশোধন ও অন্য সংস্কার কমিটির প্রতিবেদন পেশসহ যেসব সংস্কার কাজ চলমান, তা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এসব সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে যখন আলাপ-আলোচনা হবে, তখন ঐকমত্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্র সংস্কার এবং আগামী নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। আমরা মনে করি, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ওপর আস্থা রেখে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমকে সব রাজনৈতিক দল ও সচেতন মহলের সর্বাত্মক সহযোগিতা করা অপরিহার্য। তিনি যে রোডম্যাপ উপস্থাপন করবেন, তার মাধ্যমেই একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য এবং অনুকরণীয় নির্বাচন হবে। আমরা চাই, তাঁর অধীনেই স্মরণীয়-বরণীয় একটি নির্বাচন হোক।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
প্রভাবমুক্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর নতুন জ্বালানি মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের দাবি : টিআইবি’র
হেপাটোলজি সোসাইটির নতুন সভাপতি প্রফেসর শাহিনুল আলম, মহাসচিব মো. গোলাম আযম
এনসিটিবি চেয়ারম্যান ওএসডি
জামিন পেলেন সেই ম্যাজিস্ট্রেট তাপসী তাবাসসুম
নির্বাচন বিলম্ব করার কোনো সুযোগ নেই : আমীর খসরু
দুই অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বরখাস্ত
মানসম্মত ও জীবনমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তবায়নে শিক্ষক সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে -বাউবি ভিসি
চিত্রনায়িকা নিঝুমকে অপহরণ চেষ্টা
দেশে মানসম্মত শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হবে
ন্যাশনাল ব্যাংকের এমডির পদত্যাগ
সালথায় চলছে মাটিকাটা ও বালু উত্তোলনের মহোৎসব, নষ্ট হচ্ছে গ্রামীণ সড়ক
ডিআরইউকে ৫ লাখ টাকা অনুদান দিলো দৈনিক ভোরের আকাশ
ভোগাই নদীতে অবৈধ বালু উত্তোলনের অভিযোগে ৩ জনের জেল, সরঞ্জাম ধ্বংস
চাঁদপুরে মেঘনায় ভেসে উঠছে মরা মাছ ১৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে
সিলেটে ইউনিমার্টের প্রথম বর্ষপূর্তি, বিজয়ীরা পেলেন পুরস্কার
ইসলামী আন্দোলনের আমিরের সঙ্গে বিএনপি মহাসচিবের বৈঠক কাল
দিনাজপুরে অনুর্ধ্ব-১৭ বালক-বালিকাদের জাতীয় গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্ণামেন্টে
এক অজু দিয়ে তিন ওয়াক্ত নামাজ পড়া প্রসঙ্গে?
মিথ্যা অপপ্রচারের প্রতিবাদে বিএনপির সাংবাদিক সম্মেলন
মহড়ায় যোগ দিতে পাকিস্তানের পথেবানৌজা সমুদ্র জয়’