লাভ জিহাদের প্রেক্ষিতে উগ্র-হিন্দুত্ববাদীদের হামলার শিকার অভিনেতা সাইফ আলি খান
১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:৩৫ পিএম | আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:৩৫ পিএম
গত (১৫ জানুয়ারি) গভীর রাতে বলিউড ইতিহাসে ন্যাক্কারজনক হামলা হলো জনপ্রিয় অভিনেতা এবং নবাব পরিবারের উত্তরাধিকারী সাইফ আলি খানের উপর। এদিন নিজ বাস ভবনেই আকস্মিকভাবে হামলার শিকার হন সাইফ। চুপিসারে অভিনেতার বাড়িতে ঢুকে তাঁর উপর হামলা চালায় এক কট্টর হিন্দু জঙ্গি। শরীরের একাধিক জায়গায় মেলে আঘাত চিহ্ন। শিরদাঁড়ার কাছে দুই জায়গায় মেলে গভীর ক্ষত। মাঝরাতে তড়িঘড়ি অভিনেতাকে রক্তাক্ত অবস্থায় লীলাবতী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
তারপর টানা আড়াই ঘণ্টা চলে অস্ত্রোপচার। সেই অস্ত্রোপচারে তাঁর শরীর থেকে একটি তিন ইঞ্চির ধারালো বস্তু বের করা হয়েছে। বিষয়টি অনেকটাই স্পষ্ট যে সাইফকে হত্যা করতে আসা সন্ত্রাসী কোন বাইরের লোক নয়। বরং বেশ পরিকল্পিতভাবেই তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে এসেছিলেন। কেননা অভিনেতার বাসার সিসিটিভি ফুটেজ আক্রমণের দুই ঘন্টা আগে থেকেও কেউকে ভিতরে প্রবেশ করতে দেখা যায়নি। এতে স্পষ্ট হয় হামলাকারী বেশ আগে থেকেই ওৎ পেতে ছিল। এদিকে কারিনাও ওই সময় বাসায় নেই। সাইফকে হত্যা করার একদম উপযুক্ত সময়। কেননা ঘুমন্ত অবস্থায় অভিনেতাকে ধীরে সুস্থেই হত্যা করা যাবে এমন পরিকল্পনা নিয়েই হামলাকারী এবং তার দোসরেরা এগোচ্ছিলেন।
ইতোমধ্যেই বাড়ির পরিচারিকাসহ এই ইস্যুতে ৩ জনকে আটক করা হয়েছে। এদিকে সাইফকে গুরুতর জখম করে পালানোর ভিডিওতে দেখা যায় ওই লোকের গলায় গেরুয়া রংয়ের স্কার্ফ, যা বিজেপি এবং হিন্দু জঙ্গী,সন্ত্রাসীদের প্রধান পরিচায়ক। তবে অবাক করা বিষয় হলো এমন হিন্দুত্ববাদী জঙ্গী হামলাকে দেশটির মিডিয়া ডাকাতি বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে। ভারতে অভাবের তারনায় পিছিয়ে পড়া মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা ছোট-খাটো অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়লে দেশটির হিন্দুত্ববাদী চক্রগুলো তাদেরকে জঙ্গীসহ নানা রকম অপপ্রচার করে।
এমনকি ভালোবেসে হিন্দু-মুসলিমদের মাঝে বিয়ের সম্পর্ককে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি 'লাভ জিহাদ'। এই লাভ জিহাদের বলি হয়েছে অনেক ভারতীয় মুসলিম যুবক-যুবতী। এমনকি এই ঘটনার জেরে অনেক সংখ্যালঘু মুসলিমদের প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তবে তাদের এই থিয়োরি কেবল মুসলিমদের জন্যই প্রযোজ্য। অন্য কোন ধর্মের মানুষ বিশেষত খ্রিষ্টান কিংবা শিখ ধর্মের কারো সাথে এমন সম্পর্ক হলে তাতে কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদীদের কোন সমস্যা হয়না। মুসলিম তারকাদের নিয়ে বিদ্বেষ ভারতে আজ থেকে নয়।
১৯৯০ সালের জনপ্রিয় নাটক ছিলো 'দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান'। সেই নাটক দেশটিতে এতোটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে তা সহ্য করতে পারেনি সেখানকার মুসলিম বিদ্বেষী হিন্দুত্ববাদী জঙ্গিরা। শেষ অব্দি সেই শুটিং সেটে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় যাতে মারা যায় ৬২ জন কলাকুশলী,এমনকি মুখ পুড়ে যায় অভিনেতা ফিরোজ খানের ভাই টিপু সুলতান চরিত্রের নায়ক সঞ্জয় খানের।
গত বছরের পুরোটা সময় ধরে বলিউডের সুপারস্টার সালমান খানকে অসংখ্যবার প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে বিষ্ণোই গ্যাং নামেট একটি চক্র। যারা মূলত বিজেপিরই পেলে পুষে বড় করা সন্ত্রাসী।
যাদের একমাত্র কাজই হলো মুসলিমদের দেশটিতে টিকতে না দেওয়া। সালমানের থেকে একাধিকবার চাঁদা দাবি করার পাশাপাশি তাকে মন্দিরে গিয়ে ক্ষমা চাইতে বলা হয় যে কারনে সালমান খান সম্প্রতি স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন তিনি কোনভাবেই কোন হরিণ হত্যা করেননি। তবুও বারংবার সালমানকে হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কেবল সালমানই নয় তার পুরো পরিবারকে দেওয়া হচ্ছে হুমকি এমনকি গুলি করা হয় তার বাড়ি উদ্দেশ্য করে। এছাড়াও জনপ্রিয় মুসলিম রাজনৈতিক নেতা এবং সালমান খানের বন্ধু বাবা সিদ্দিককে প্রকাশ্যে হত্যা করে এই তথাকথিত গ্যাংয়ের আড়ালে উগ্র কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদী এই জঙ্গীরা। এছাড়া বলিউডের রোমাঞ্চের কিং শাহরুখ খানকে দেওয়া হয় হত্যা করার হুমকি। এমনকি তার কাছেও চাঁদা দাবি করা হয়।
সাইফ হামলায় লরেন্স-যোগের পাশাপাশি মহারাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিয়েও বিজেপিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন দিল্লির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। তাঁর দাবি, 'ডবল ইঞ্জিন সরকার নিয়ে মুম্বাইয়ের সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ বিজেপি।'
এমনকি তিনি এটাও দাবি করেন যে, গুজরাটে বসেই সাইফ হামলার ছক কষা হয়েছিল।
এদিন কেজরিওয়াল বলেন, ‘গুজরাটের জেলে বারবার হামলা চালিয়েও নিরাপত্তা পেয়ে যাচ্ছে একজন।’ বর্তমানে গুজরাটের সবরমতী জেলে রয়েছেন লরেন্স বিষ্ণোই। আর এই মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে লরেন্সের বিরুদ্ধেই যে তোপ দেগেছেন এই নেতা তা স্পষ্ট।
এমনকি সাইফকে এমন পৈশাচিকভাবে আক্রমণ করায় প্রতিবাদ জানিয়েছেন দেশটির পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, 'অভিনেতাকে হত্যাচেষ্টার বিষয়ে স্যোশাল হ্যান্ডেল এক্স-এ মমতা লেখেন,' বিখ্যাত অভিনেতা সাইফ আলি খানের ওপর হামলার ঘটনা খুবই উদ্বেগের। আমি তাঁর দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি, বিশ্বাস করি যে আইন, আইনের পথে হাঁটবে এবং যারা দায়ী তারাও ধরা পড়বে। এই কঠিন শর্মিলাদি, কারিনা কাপুর এবং পুরো পরিবারের সঙ্গে রয়েছে আমার প্রার্থনা।'
এসময় তিনি আরও বলেন, 'সব রাজ্যেরই আলাদা আলাদা সমস্যা আছে। আমি বলব, যাতে কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এসময় সাইফ আলি খানের মা তথা অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুরকেও তিনি সম্মান করেন। এমনকি পুরো পরিবার যাতে নিরাপদে থাকে, তা নিশ্চিত করা হোক বলে দাবি করেছেন মমতা।'
মুখ্যমন্ত্রী বলেন, 'শাহরুখ খানেরও প্রাণের ঝুঁকি আছে। সালমান খানেরও আছে। সাইফ আলি খান তো লিস্টে ছিল না। হঠাৎ হামলা হয়ে গিয়েছে।'
কারিনার ক্যারিয়ারের মাঝখানে বিয়ে করেন সাইফ-কারিনা। বিভিন্ন ধরনের বাঁধা এসেছিল তাদের মিলনের ক্ষেত্রে। সব বাঁধা অতিক্রম করে দু'জন সংসার বাঁধেন। যেখানে কারিনাকে অনেকেই পছন্দ করলেও কারিনা কেবল সাইফের প্রতিই আকৃষ্ট হন। আর তাতেই যেন জমতে থাকে যত ক্ষোভ। এমনকি তাদের বিয়ের আগে হুমকিও পেয়েছিলেন কারিনা-সাইফ।
জানা যায়, ২০১২ সালে দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে করেন সাইফ আলি খান এবং কারিনা কাপুর। পতৌদি পরিবারের নবাবের সঙ্গে হিন্দু কাপুর পরিবারের মেয়ের বিয়ের খবর শুনে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল।
সেই ঘটনা নিজেই জানিয়েছিলেন বলিউডের নবাব সাইফ আলি খান। কারিনার বাবা রনধীর কাপুরের কাছে অজ্ঞাত পরিচয় কেউ খুনের হুমকি দেওয়া চিঠি পাঠিয়েছিলেন। সেখানে লেখা ছিল- ‘এই বিয়ে হলে পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং সাইফ-কারিনার বিয়ের ভেন্যুতেও হামলা চালানো হবে।’
সাইফ আলি জানান, ষাটের দশকে যখন তার বাবা-মা মনসুর আলি খান পতৌদি এবং শর্মিলা ঠাকুর ভিনধর্মী বিয়ে করেছিলেন, তখনও এরকম ঘটনা ঘটেছিল।
অভিনেতা বলেন, ‘আমরা বিয়ে করি, কিছু মানুষ আসলে সেটা ভালোভাবে নেয়নি। আমার শ্বশুরের কাছে একাধিক হুমকিবার্তা এসেছিল। বলা হয়েছিল, আমাদের বিয়ের ভেন্যু নাকি বোম দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হবে। নয়তো পরিবারের কারও ক্ষতি করা হবে। তবে এসবে ভয় পাইনি আমি। কারণ হুমকি দেওয়া আর সেটাকে কাজ করে দেখানোর মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে, সেটা জানতাম।’
শর্মিলা ঠাকুর নিজেও একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, মনসুর আলি খান পতৌদির সঙ্গে তার বিয়ের সময়ে কলকাতার বাড়িতে টেলিগ্রামে হুমকিবার্তা পাঠিয়ে বলা হয়েছিল- ‘এরপর গুলি কথা বলবে…।’
কেবল সাইফ-কারিনাই নয় এর আগে ভারতীয় আরেক অভিনেত্রী আয়েশা টাকিয়ার স্বামী ও ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের সমাজবাদী পার্টির যুব সংগঠনের প্রধান আবু ফারহান আজমিকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল।সেসময় হুমকি পেয়ে রাজস্থান রাজ্যের “হিন্দু সেনা” নামের একটি সংগঠনের বিরুদ্ধে মহারাষ্ট্র পুলিশের কাছে এফআইআর দায়ের করেছিলেন তিনি।
মুসলমান হয়ে হিন্দু অভিনেত্রী আয়েশা টাকিয়াকে বিয়ে করার কারণেই এমন হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে ফারহানের দাবি।
ভারতীয় গণমাধ্যমে বলা হয়, পুলিশকে ফারহান জানিয়েছেন, তাঁদের বাড়ি, গাড়ি এবং অফিসে বিস্ফোরক রেখে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে সংগঠনটি। শুধু তাই নয়, তাঁদের পরিবার এবং ইসলাম ধর্ম নিয়েও খারাপ মন্তব্য করেছে “হিন্দু সেনা”-র সদস্যরা।
এমনকি ওই জঙ্গি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনটির সদস্যরা ফারহানের বাবা আবু আসিম আজমিকেও হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন।
অভিযোগে ফারহান বলেন, সংগঠনটির পক্ষ থেকে তাঁকে ফোন করে বলা হয়, “তোমার বাবাকে পশুদের মতো চিৎকার করতে বারণ কর, তা না হলে তাঁকে খতম করে দেওয়া হবে।”
আর সেই সঙ্গে “লাভ জিহাদ”-এর কথা স্মরণ করে আয়েশা টাকিয়াকে বিয়ে করায় তাঁকেও আক্রমণাত্মক কথা বলা হয়েছে বলেও খবর প্রকাশ হয়েছিল।
২ নভেম্বর, ২০২০ সালে বিবিসিতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতে মুসলিম যুবকদের সঙ্গে হিন্দু মেয়েদের বিয়ে, যেটাকে বিজেপি ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো 'লাভ জিহাদ' বলে বর্ণনা করে থাকে, তা তখন আইন করে বন্ধ করার কথা বলেছিল উত্তরপ্রদেশ বা হরিয়ানার মতো একাধিক রাজ্য।
উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এই প্রসঙ্গে এমনও হুমকি দিয়েছিল, হিন্দু মেয়েদের যদি মুসলিম ধর্মের কেউ বিয়ে করে তারা যেন নিজেদের অন্ত্যেষ্টি যাত্রার জন্য প্রস্তুত থাকে!
ভারতের মুসলিম নেতারা অবশ্য আইন করে তথাকথিত লাভ জিহাদ ঠেকানোর প্রস্তাবকে অসাংবিধানিক বলে উল্লেখ করেছেন।
তবে পর্যবেক্ষকদের মতে ভারতীয় সমাজে এই ধরনের স্পর্শকাতর একটি বিষয় নিয়ে আবেগ ক্রমশ বাড়ছে এবং রাজনীতিকরাও তার ফায়দা তুলতে চাইছেন।
এদিকে ২০২৪ সালের ৬ অক্টোবর দ্য হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদনে উঠে আসে ভয়াবহ তথ্য। লাভ জিহাদের নামে হিন্দু মেয়েদের টার্গেট করা হলেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ভয়ঙ্করভাবে শাস্তি দেওয়ার নিদান দিয়েছিলেন উত্তরাখণ্ডের পাউরি গাড়ওয়াল জেলার একজন প্রবীণ বিজেপি নেতা। সেক্ষেত্রে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের দোকান পুড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি চোখ বের করে নেওয়ার নিদান দিয়েছিলেন তিনি। সেই ঘটনায় এবার ওই বিজেপি নেতার বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা রুজু করল পুলিশ।
বিজেপি নেতার বিরুদ্ধে স্থানীয় পুলিশ শত্রুতা প্রচার এবং ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করার অভিযোগে মামলা রুজু করেছে। অভিযুক্ত বিজেপি নেতার নাম লখপথ ভান্ডারি। তিনি পাউরি গাড়ওয়াল জেলা ইউনিটের বিজেপির সহ-সভাপতি।বৃহস্পতিবার জেলার শ্রীনগর শহরে একটি সমাবেশে এভাবেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিশানা করেন। একইসঙ্গে তিনি এক্ষেত্রে তিনি পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তোলেন।
ভারতে বহুল প্রচলিত এই লাভ জিহাদ বলতে আসলে কি? চলুন তাত্ত্বিক জায়গা থেকে জেনে নেওয়া যাকঃ
ভারতে ভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে বিয়ের বিরোধিতার ইতিহাস বহু পুরনো। তবে সেই বিষয়টি আরও বেশি আলোচনায় এসেছে বর্তমান সময়ে কেননা কট্টর হিন্দুত্ববাদী দলগুলো রাজনৈতিক ফায়দা লাভের উদ্দেশ্যে সময়ে সময়ে এই লাভ-জিহাদের ধুয়ো তোলে।
১৯২০ এবং ১৯৩০ এর দশকে উদ্ভূত সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে উত্তর ভারতের কোথা কোথাও হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলো মুসলিম যুবকদের দ্বারা হিন্দু নারী “অপহরণের“ এক প্রচারণা শুরু করেছিল। মুসলিম পুরুষের বিয়ে করা হিন্দু স্ত্রীদের উদ্ধারের দাবি তোলা হয়েছিল। উত্তর প্রদেশে সে সময় মুসলিমদের দ্বারা হিন্দু নারীদের তথাকথিত অপহরণ বন্ধে হিন্দু একটি সংগঠন তৈরি হয়েছিল।
১৯২৪ সালে কানপুর শহরে একজন মুসলিম সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এক হিন্দু নারীকে “অপহরণ এবং জোর করে ধর্মান্তর“ করার অভিযোগ তোলা হয়েছিল। ঐ কর্মকর্তার বাড়ি থেকে ঐ নারীকে “উদ্ধারের“ দাবি উঠেছিল।
ইংরেজ শাসনামলেও হিন্দু নারীদের অপহরণ নিয়ে পার্লামেন্টে বিতর্ক হয়েছে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, যারা এখন প্রধান বিরোধী দল, তারা একটি প্রস্তাব পাশ করেছিল যাতে বলা ছিল - “যে সব নারীদের অপহরণ করে জোর করে বিয়ে করা হয়েছে তাদেরকে বাড়িয়ে ফিরিয়ে আনতে হবে। দলবদ্ধ ধর্মান্তরকরণ অবৈধ এবং মানুষকে তার নিজের পছন্দের জীবনে ফিরে আসার সুযোগ দিতে হবে।“
১৯৪৭ সালে যখন ভারত ভাগের সময় ১০ লাখ মানুষ মারা গিয়েছি। দেড় কোটি মানুষকে ঘরবাড়ি ছাড়িতে হয়েছিল কারণ বহু মুসলিম পাকিস্তানে চলে যায়, অন্যদিকে হিন্দু এবং শিখরা ভারতে চলে আসে। দেশভাগের সময় সেই সহিংসতার প্রধান বলি হতে হয়েছিল নারীদের। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ আরো গভীর হয়।
লাভ জিহাদ অন্তরালে নোংরা রাজনীতিঃ
সাম্প্রতিক সময়ে যে কোনো নির্বাচনের আগে কট্টর হিন্দু গোষ্ঠীগুলো লাভ-জিহাদের আলাপ তুলে ভোটার মেরুকরণের চেষ্টা করছে। ২০১৪ সালে উত্তর প্রদেশে রাজ্যে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সময় নগ্নভাবে এটি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক গুপ্তা বলেন, হিন্দু গোষ্ঠীগুলো পোস্টার, গুজব, কানকথা ব্যবহার করে “মুসলিম পুরুষদের দ্বারা হিন্দু নারীদের তথাকথিত অপহরণ, ধর্মান্তর, ধর্ষণ, জবরদস্তি করে বিয়ে“ ঠেকানোর “সুপরিকল্পিত প্রোপাগান্ডা“ শুরু করেছে।
কট্টর হিন্দু সংগঠন আরএসএস, যাদেরকে বিজেপির আদর্শিক অভিভাবক বলে মনে করা হয় - তারা তাদের মুখপাত্র সাময়িকীতে “লাভ জিহাদের“ নানা কাহিনী প্রচার করেছে। “লাভ ফর এভার, লাভ জিহাদ নেভার“ (ভালবাসা চলবে কিন্তু লাভ জিহাদ কখনই চলবে না) স্লোগান তুলতে অনুসারীদের উৎসাহিত করেছে।
শুধু যে মুসলিম পুরুষদের মোটা দাগে একই ব্রাকেটে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে তাই নয়। সেইসাথে হিন্দু নারীদের লোভ দেখিয়ে ধর্মান্তর করার “আন্তর্জাতিক ইসলামি চক্রান্ত“ তুলে ধরা হচ্ছে। এমন প্রচারণাও চালানো হচ্ছে যে বিদেশ থেকে মুসলিম যুবকদের টাকা পাঠানো হচ্ছে যাতে তারা সুন্দর পোশাক পরে, দামি গাড়ি কিনে এবং উপহার দিয়ে হিন্দু নারীদের আকৃষ্ট করতে পারে।
উত্তর প্রদেশে বিজেপির একজন মুখপাত্র বলেন, “গ্লোবাল জিহাদের অংশ হিসাবে দুর্বল অসহায় হিন্দু মেয়েদের টার্গেট করা হচ্ছে।''
অধ্যাপক গুপ্তা বলেন, “নারীদের নামে রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের পেছনে মানুষ জড়ো করার চেষ্টা চলছে।“
গবেষক এবং পর্যবেক্ষকরা বলছেন লাভ-জিহাদ নিয়ে অতীতে এবং বর্তমানের প্রচারণার মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। তবে বর্তমানে যে প্রচারণা তা অনেক শক্তিশালী কারণ এর পেছনে রয়েছে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি।
“স্বাধীনতার আগে এসব প্রচারণা শুধু সংবাদপত্রের ভেতরের পাতাতেই সীমিত থাকতো। মূলধারার রাজনৈতিক কোনো দল বা নেতা এসব গুজব কাজে লাগানোর চেষ্টা করতেন না। এখন এসব গুজব এবং প্রচারণা মিডিয়ার প্রথম পাতার খবর এবং রাষ্ট্র এসব আইন তৈরি এবং প্রয়োগের প্রধান উদ্যোক্তা,“ বলছিলেন অধ্যাপক গুপ্তা।
অনেকে বলেন অনেক সময় দম্পতিরা ধর্মীয় বিয়ের পথ নেয় কারণ তারা ভারতের স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট এড়াতে চায়। এই বিশেষ আইনে ভিন্ন ধর্মের নারী পুরুষের বিয়ের অনুমোদন থাকলেও বিয়ের আগে সরকারি কর্তৃপক্ষকে এক মাসের নোটিস দিতে হয় যেখানে দম্পতিদের নাম ঠিকানা থাকে। ফলে এই দম্পতিরা ভয় পায় যে পরিবার জেনে গিয়ে বিয়ে আটকে দেবে।
শুধু ভিন্ন ধর্মের বলে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে তাদের জীবন সঙ্গী পছন্দের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ভয়ের একটি সংস্কৃতি তৈরি করা হচ্ছে যেখানে বাবা-মা বা সরকারি কর্তৃপক্ষকে এই অধিকার হরণের আইনি অধিকার দেওয়া হচ্ছে।
বিভাগ : বিনোদন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বিরলে ৫ দিন ব্যাপি চতুর্থ উপজেলা কাব ক্যাম্পুরীর শুভ উদ্বোধন
কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে অবৈধ ইটভাটায় পুড়ছে কাঠ
তারুণ্যের উৎসবে আনন্দের ঢেউ
মুক্ত বাতাসে বাবরের জুমার নামাজ আদায়
কাপ্তাই জাতীয় বিদ্যুৎ শ্রমিক ইউনিয়ন সিবিএ কর্তৃক শীতবস্ত্র কম্বল বিতরণ
কুষ্টিয়ায় দুষ্কৃতকারীদের হুমকিতে গড়াই খননকাজ বন্ধ,থানায় অভিযোগ
মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় আবু সাঈদকে নিয়ে প্রশ্ন
কম্বোডিয়ার পরিবর্তে অনৈতিক কাজে সউদী পাঠানোর প্রস্তাব পাসপোর্ট আটকে রেখে টাকা দাবি
গৌরনদীতে দাদাবাড়ি বেড়াতে এসে শিশু খুনের ঘটনায় ২ নারীসহ গ্রেফতার ৪
জেলা প্রশাসক গোল্ডকাপ ক্রিকেট টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন ভালুকা উপজেলা
ব্রাহ্মণপাড়ায় এইচএমপিভি সচেতনতায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রচারণা
চবি ছাত্রদলের প্রীতিভোজে হামলার অভিযোগে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম
মতলবে শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণ
কুড়িগ্রামের উলিপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় শিশুর মৃত্যু
ভোট ডাকাতি করে ওবায়দুল কাদের চারবার এমপি হয়েছিল: ফখরুল ইসলাম
দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি নির্বাচন দিয়ে দেশটাকে স্থিতিশীলতায় নিয়ে আসুন : এ্যানি
কুয়েটে ‘ওবিই কারিকুলাম ডিজাইন টিচিং লার্নিং বিষয়ক প্রশিক্ষণ
স্মার্টফোনের দাসত্ব থেকে মুক্তির উপায়
ডিমলায় ‘স্বপ্ন পূরণের প্রত্যয়ে আমরা, সামাজিক সংগঠন বাংলাদেশ’র ৫ম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন
দারিদ্র্য বিমোচনে যাকাত : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ