ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

বার্ধক্য ও নিঃসঙ্গতা

Daily Inqilab ইনকিলাব

০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৮ এএম | আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৮ এএম

একটা সময় দেশে জন্ম নিয়ন্ত্রণের অন্যতম জনপ্রিয় বিজ্ঞাপন ছিল ‘ছোটো পরিবার’। পরবর্তীতে সেই বিজ্ঞাপনের বচন মেনে দেশে জন্মহার কতটা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে তা নিয়ে সংশয় থাকতে পারে। কিন্তু পরিবার বিশেষত, সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার ছোটো হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই ছোটো পরিবার সত্যিই কতটা সুখী হয়েছে তা বলা মুশকিল। বাংলাদেশী মধ্যবিত্তের ছোটো ছোটো পরিবারগুলোর জীবনে কিন্তু বহুদিন যাবৎই সুখের চেয়ে নানা শঙ্কার ছায়াই ক্রমশ গাঢ়তর হয়েছে। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দোলাচল, শিক্ষায় অব্যবস্থা, সমাজে নৈরাজ্য, কর্মসংস্থানের অভাব ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুর্ভাবনা সেই শঙ্কার একটা দিক হতেই পারে। গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রী আর এক বা দুই সন্তান এই ছোট্ট মধ্যবিত্ত সংসারে এমন শঙ্কা অস্বাভাবিক নয়। যেখানে সংসারে আয়ের পথ একটি সেখানে এই শঙ্কা যে অপেক্ষাকৃত গাঢ় তাও বলার অপেক্ষা রাখে না।

মূল সমস্যা হল-বেশ কয়েক বছর ধরে একের পর এক বিভীষিকাময় ঘটনায় মধ্যবিত্তের ছোটো পরিবারের ওই শঙ্কায় ঢুকে পড়েছে মৃত্যুভয় জ্ঞাত-অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে নির্মম যন্ত্রণাময় মৃত্যুচিন্তা। আর ভয়চিন্তা বেশি করে গ্রাস করছে শহর মহানগরে বহুতলে-বন্দি ছোটো পরিবারের বয়স্ক মানুষজনকে। আততায়ীর নিষ্ঠুর হাত এড়িয়ে জীবনের শেষটুকু নির্বিঘেœ কাটানো যাবে কি না-এই প্রশ্নই এখন নিঃসঙ্গ বার্ধক্যের সামনে সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে দুষ্কৃতীদের একটা প্রধান টার্গেট বয়স্ক মানুষজন। ফ্ল্যাটে বা বাড়িতে স্বামী-স্ত্রী মিলে থাকেন, ছেলে-মেয়েরা চাকরি বা উচ্চশিক্ষার জন্য ভিন্ন জেলা বা প্রবাসে এমন পরিবারের দিকেই খুনীদের ঝোঁক বেশি। উদ্দেশ্য, কখনও টাকা-পয়সা, গয়নাগাটি লুঠ, কখনও সংশ্লিষ্টের জমি-বাড়ি, ফ্ল্যাট দখল। আর যেটা সবচেয়ে লক্ষণীয় তা হল এমন সব খুনের ঘটনায় জড়িতরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিহত হতভাগ্যদের বিশেষ পরিচিত। এই পরিচিতদের তালিকায় আত্মীয়-পরিজন, বাড়ির কাজের লোক, এমনকি আর্থিক বা অন্যভাবে উপকৃত কৃতঘœ শ্রেণির লোকও থাকছে।
ভালোবাসা, মায়া-মমতা, বিশ্বাস, কৃতজ্ঞতাবোধ সব তো তছনছ হয়েই গিয়েছে। এদিক-ওদিক ছিটেফোঁটা যেটুকু পড়ে আছে সেটুকুও কি থাকবে না। হায় আল্লাহ তা হলে ভবিষ্যতে মানুষ বাঁচবে কী নিয়ে? মনে হবে না এমন কথা? এমন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা খুনের ঘটনা ঘটলেই দেখা যায় আঙুল ওঠে পুলিশের দিকে। পুলিশ বয়স্ক মানুষজনকে ঠিকমতো নিরাপত্তা দিতে পারছে না, তাই একের পর এক এমন মর্মান্তিক সব ঘটনা ঘটছে অনেকেই অভিযোগের সুরে এমন কথা বলেন। কিন্তু, সত্যিই কি এভাবে হাজার হাজার, লাখ লাখ প্রায় নিঃসঙ্গ মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব! আমাদের দেশের নিরাপত্তা পরিকাঠামোর ভিত কি ততটা মজবুত? এই কোটি-কোটি মানুষের দেশে তেমন পুলিশি বন্দোবস্ত কি আদৌ সম্ভব? প্রতিশ্রুতিতে ওস্তাদ স্বেচ্ছাসেবীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। কেউ কেউ আবার দেখা যায়-প্রবাসী সন্তানদের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন। ওরা নাকি নিজেদের উন্নতি চিন্তায় বয়স্ক বাবা-মায়েদের অবহেলা করেছেন তাই এমন সব নির্মম ঘটনা ঘটছে। এটাও সর্বাংশে গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। বিদেশে বা ভিন জেলার যাঁরা চাকরি বা পড়াশুনার সূত্রে থাকেন, তাঁদের বাধ্যবাধকতাটা ভাবতে হবে। হুট করে বললেই কি কাজকর্ম ফেলে আসা যায়? কর্মসংস্কৃতিটা সর্বত্র এক রকম ভাবলে কী করে হবে। বলা হচ্ছে না যে, প্রবাসী বা ভিন জেলাবাসী সব সন্তানই বাবা-মা অন্তঃপ্রাণ তাঁদের জন্য ভেবে ভেবে আকুল হয়। হতেই পারে কেউ কেউ একটু অবহেলা করে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে কাজের চাপেও অবহেলা হয়ে যায়। তবে, বাঙালি ঘরের বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে এখনও বাবা-মাকে ভালোবাসে তাদের জন্য চিন্তা করে।

আসলে, যেদিন থেকে একান্নবর্তী মধ্যবিত্ত পরিবারে ভাঙন ধরল বড়ো-মেজ-ছোটোরা আলাদা আলাদা বাসা করল, পরিবারে গুরুজনের দূরে রেখে নিজের বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে আলাদা সংসারের স্বাধীনতা এবং সামাস্য আয়েও এক ধরনের সচ্ছলতার স্বাদ পেতে শুরু করল বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের এই অসহায়তা, এই নিরাপত্তহীনতার সূত্রপাত সেদিনই ঘটে গিয়েছিল। তারপর সময় যত এগিয়েছে ঘর-পরিবারগুলো তত ছোটো হয়েছে। একদিন যাদের অঙ্গুলিহেলনে চলত পরিবার, সেই রাশভারী প্রবীণ-প্রবীণরা ক্রমশ যেন গুরুত্ব হারিয়ে সরে যেতে থাকলেন সংসারের প্রান্ত সীমায়। তারপর এক সময় গোটা বিশ্বের সঙ্গে আমাদের দেশে আমাদের ঘরেও উড়ে এল বিশ্বায়নের মোহিনী মায়া এবং তার অনিবার্য পরিণতিতে নিজের জেলা বা ভিন শহর ছেড়ে ইউরো-ডলার বা পাউন্ডের দেশে ছেলেমেয়েদের পাঠিয়ে তাদেরকে ওই স্বপ্নের ভবিষ্যতে পৌছে দিতে উঠেপড়ে লাগবেন বাবা-মায়েদের অনেকেই।

সব মিলিয়ে বয়স্কদের চারপাশ থেকে একটু একটু করে সরে যেতে লাগল পারিবারিক বাঁধনের সুতোগুলো, এক একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো ফ্ল্যাটে-ফ্ল্যাটে, বাড়িতে বাড়িতে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা ভেসে বেড়াতে লাগলেন আর তাঁদের সম্পত্তি জমি-বাড়ি হয়ে উঠতে লাগল মূর্তিমান বিপদ। সত্যি বলতে কী-পরিবার যত ছোটো হচ্ছে নিঃসঙ্গতা প্রবীণদের তত গ্রাস করছে।

কিন্তু সারা জীবন কত কষ্ট করে যিনি বাড়ি-ঘর বা ফ্ল্যাট বানালেন যে, পরিবেশে বছরের পর বছর কাটালেন, যার পানি, বাতাস, আকাশ গাছপালা মানুষজনসমেত চারপাশ হাতের তালুর মতো চেনা ক’টা খুনে গুন্ডার ভয়ে সেসব ছেড়ে-ছুড়ে সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা পরিবেশে পরের অনুগ্রহভাজন হয়ে শেষের দিনগুলো কাটাতে হবে! এর চেয়ে কষ্টের আর কী হতে পারে? এতো শাস্তিরই নামান্তর?

ষ আফতাব চৌধুরী
সাংবাদিক-কলামিস্ট।
সহ সভাপতি-প্রবীন হিতৈষী সংঘ, সিলেট।


বিভাগ : স্বাস্থ্য


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

এইডস সম্পর্কে জানুন ও সচেতন হোন
মুখে ক্যান্সার ও দাঁত তোলা
প্রতিবন্ধীদের বিশেষ সুরক্ষা প্রয়োজন
ডেঙ্গুজ্বর বেড়েই চলেছে
মেয়েদের স্তন ক্যান্সার
আরও

আরও পড়ুন

সউদী আরবকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

সউদী আরবকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগের আহ্বান উপদেষ্টা নাহিদের

গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহত আরও ৩৬

গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহত আরও ৩৬

যুক্তরাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ রফতানিতে চীনের নিষেধাজ্ঞা

যুক্তরাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ রফতানিতে চীনের নিষেধাজ্ঞা

বিক্ষোভের মুখে প্রত্যাহার দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক আইন

বিক্ষোভের মুখে প্রত্যাহার দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক আইন

সিরিয়ার প্রেসিডেন্টকে সতর্ক করে যা বললেন এরদোগান

সিরিয়ার প্রেসিডেন্টকে সতর্ক করে যা বললেন এরদোগান

নভেম্বরে রপ্তানি আয় বেড়েছে ১৫.৬৩ শতাংশ

নভেম্বরে রপ্তানি আয় বেড়েছে ১৫.৬৩ শতাংশ

সৈয়দপুরে পিকআপের ধাক্কায় এক শ্রমিক নিহত

সৈয়দপুরে পিকআপের ধাক্কায় এক শ্রমিক নিহত

শিক্ষার্থীদের মারধর ও শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার প্রতিবাদে শ্রমিকদের সঙ্গে খুবি শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া

শিক্ষার্থীদের মারধর ও শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার প্রতিবাদে শ্রমিকদের সঙ্গে খুবি শিক্ষার্থীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতীয় ষড়যন্ত্র বরদাস্ত করা হবে না : বিক্ষোভ মিছিলে খেলাফত আন্দোলন

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতীয় ষড়যন্ত্র বরদাস্ত করা হবে না : বিক্ষোভ মিছিলে খেলাফত আন্দোলন

আগরতলায় সহকারি হাইকমিশনে উগ্রবাদীদের হামলার প্রতিবাদে  চাঁদপুরে খেলাফত মজলিস বিক্ষোভ

আগরতলায় সহকারি হাইকমিশনে উগ্রবাদীদের হামলার প্রতিবাদে চাঁদপুরে খেলাফত মজলিস বিক্ষোভ

বগুড়ায় ম্যাজিষ্ট্রেটের সিল-স্বাক্ষর জাল করার অভিযোগে ৩ প্রতারক গ্রেফতার

বগুড়ায় ম্যাজিষ্ট্রেটের সিল-স্বাক্ষর জাল করার অভিযোগে ৩ প্রতারক গ্রেফতার

পিলখানা হত্যা, শাপলা চত্বরে গণহত্যা ও ২৪'র গণহত্যার বিচারের জন্য ছাত্র ঐক্যের প্রয়োজন: শিবির সভাপতি

পিলখানা হত্যা, শাপলা চত্বরে গণহত্যা ও ২৪'র গণহত্যার বিচারের জন্য ছাত্র ঐক্যের প্রয়োজন: শিবির সভাপতি

‘কুটনীতিকদের উপর আক্রমণ করে ভারত নিজেদের অসভ্য জাতি হিসেবে পরিচয় দিয়েছে’

‘কুটনীতিকদের উপর আক্রমণ করে ভারত নিজেদের অসভ্য জাতি হিসেবে পরিচয় দিয়েছে’

ষড়যন্ত্র রুখতে সরকারের পাশে থাকবে বিএনপি

ষড়যন্ত্র রুখতে সরকারের পাশে থাকবে বিএনপি

ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ইস্যু নিয়ে ব্যাপক মিথ্যা ও অপতথ্য ছড়ানোয় বিএফইউজে ও ডিইউজের উদ্বেগ

ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ইস্যু নিয়ে ব্যাপক মিথ্যা ও অপতথ্য ছড়ানোয় বিএফইউজে ও ডিইউজের উদ্বেগ

স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য

স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য

ইনকিলাব সাংবাদিকের বাসায় দুর্ধর্ষ চুরি

ইনকিলাব সাংবাদিকের বাসায় দুর্ধর্ষ চুরি

পঞ্চগড়ে বিএনপির আনন্দ মিছিল

পঞ্চগড়ে বিএনপির আনন্দ মিছিল

অব্যবহৃত মসজিদ বা তার জায়গা সংরক্ষণ করা প্রসঙ্গে?

অব্যবহৃত মসজিদ বা তার জায়গা সংরক্ষণ করা প্রসঙ্গে?

চা শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করুন

চা শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করুন