বিশ্বব্যাপী ৭৫ ভাগ গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণে দায়ী জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার। একে জলবায়ু বিপর্যয়ের ‘বিষাক্ত উৎস’ হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। কিন্তু বিশ্বে শিগগিরই এর ব্যবহার কমছে না।

ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইইএ) বলছে, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি খাতে চলতি বছর বৈশ্বিক বিনিয়োগ ২ ট্রিলিয়ন ডলার ছুঁতে পারে, যা জীবাশ্ম জ্বালানি খাতে ব্যয়ের প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু এ পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের অর্ধেকেরও কম। ২০২৩ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনতে প্রায় ৪৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগের দরকার।

পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহারের বৈশ্বিক অগ্রগতিও আশাব্যঞ্জক নয়। বিশ্বজুড়ে বায়ু ও সৌর বিদ্যুতের উৎপাদন বৃদ্ধি চীন বা ভারতের মতো বড় অর্থনীতির দেশগুলোর বাড়তি চাহিদার তুলনায় পিছিয়ে পড়েছে। গত সপ্তাহে প্রকাশিত এনার্জি ইনস্টিটিউটের (ইআই) প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী মোট জ্বালানি ব্যবহারের ৮১ দশমিক ৫ শতাংশই ছিল জীবাশ্ম জ্বালানি, যা আগের বছরের চেয়ে সামান্য কম। ২০২২ সালে এ পরিমাণ ছিল ৮২ শতাংশ। আর ১৯৯৫ সালে এ পরিমাণ ছিল ৮৬ শতাংশ।

জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে পরিবেশবান্ধব জ্বালানিতে উত্তরণ এখনো শুরুই হয়নি বলে মনে করেন ইআইয়ের প্রধান নির্বাহী নিক ওয়েথ। তার মতে, ‘পরিবেশবান্ধব জ্বালানি বৈশ্বিক চাহিদা পূরণে সক্ষম নয়। ফলে জীবাশ্ম জ্বালানিকে এখনই প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে না।’

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি হ্রাস আইনের অধীনে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন প্রকল্পগুলোয় ভর্তুকির পরিমাণ বেড়েছে। ফলে দেশটিতে মোট জ্বালানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে জীবাশ্ম জ্বালানির পরিমাণ ২ শতাংশ কমেছে। তবে এখনো ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে জীবাশ্ম জ্বালানিই ব্যবহার হচ্ছে। দেশটিতে কয়লার ব্যবহারও গত বছরের তুলনায় ১৭ শতাংশ কমে গেছে। অনেক কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

ইআইয়ের তথ্যানুসারে, বর্তমানে আটলান্টিকের দুই পাশের দেশগুলোয় জীবাশ্ম জ্বালানির চাহিদা বেড়েছে। নিক ওয়েথ বলেন, ‘শিগগিরই এ চাহিদা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছবে। এরপর কমতে শুরু করবে। যুক্তরাষ্ট্রের শাসনক্ষমতায় যে-ই থাকুক, দেশটিও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মতো পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহার বাড়াতে উদ্যোগী হবে।’

যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে জ্বালানি উৎপাদনে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। যা অন্য দেশগুলোর জন্য নজির তৈরি করেছে।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চীনে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে কার্বন নিঃসরণের হার গত বছর ৫ দশমিক ২ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। একই সঙ্গে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে দেশটিতে। ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী নতুন করে ৫১০ গিগাওয়াট নবায়নযোগ্য জ্বালানি সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। এর ৬০ শতাংশই হয়েছে চীনে, যা বৈশ্বিক বৃদ্ধির হিসেবে দুই দশকের মধ্যে দ্রুততম।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে দীর্ঘমেয়াদে উৎপাদন ব্যয় কমার সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তিগত উন্নতিও অব্যাহত থাকা উচিত। এতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমতে থাকবে। থিংকট্যাংক রকি মাউন্টেইন ইনস্টিটিউটের (আরএমআই) মতে, বিগত দশকের সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় ৭৫ শতাংশের বেশি কমে গেছে। জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তোলন, পরিশোধন ও প্রক্রিয়াকরণেই প্রচুর জ্বালানি ব্যবহার হয়। ফলে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে যতটা চ্যালেঞ্জ আছে বলে মনে করা হয়, প্রকৃত চ্যালেঞ্জ এর থেকে কম। আরএমআইয়ের গবেষক ও বিশ্লেষক কিংসমিল বন্ড বলেন, ‘জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যাপক ব্যবহারের ওপর দৃষ্টি না দিয়ে বড় জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কীভাবে বাড়ানো যায়, সেদিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।’ উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘১৯২০ সালে বাহন হিসেবে এক কোটি ঘোড়ার বিপরীতে গাড়ির সংখ্যা ছিল ১ লাখ। সংখ্যায় কম হওয়ায় কি গাড়ির অগ্রগতি ঠেকানো গেছে?’

আরএমআইয়ের মতে, সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ২০১০ সালের পর প্রতি দুই-তিন বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। ব্যাটারিতে বিদ্যুৎ সংরক্ষণের সক্ষমতাও প্রতি বছর দ্বিগুণ হয়েছে। সংস্থাটির পূর্বাভাস অনুসারে, এ বছর সৌর ও বায়ুবিদ্যুতের উৎপাদন চাহিদাকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। এমনকি জীবাশ্ম জ্বালানি বা জৈব জ্বালানির চেয়ে বিদ্যুতের ব্যবহারও বেড়ে যেতে পারে। সূত্র : ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস।