ঢাকা   রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৭ আশ্বিন ১৪৩১

রাজনীতির লড়াইয়ে পিছপা হন না এরদোয়ান

Daily Inqilab অনলাইন ডেস্ক

০৯ মে ২০২৩, ০৩:৩৭ পিএম | আপডেট: ০৯ মে ২০২৩, ০৩:৩৭ পিএম

দুই দশক ধরে তুরস্কের মসনদে রয়েছেন রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। রাজনীতিতে বহু লড়াইয়ের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। রয়টার্স এক বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে, রাজনীতির লড়াইয়ে কখনও পিছপা হননি এরদোয়ান। আগামী ১৪ মে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি তার জীবনে সবচেয়ে কঠিন রাজনৈতিক পরীক্ষায় টিকে থাকার জন্য লড়াই করছেন।

আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষে প্রচারের সব রাস্তা খুলে দিয়েছেন এরদোয়ান। রাজনৈতিক লড়াইয়ে দীর্ঘ সময়ে তিনি শক্ত বিরোধীদের হাত থেকে মসনদ রক্ষা করেছেন।

রয়টার্স বলছে, একজন দক্ষ নাবিকের ছেলে এরদোয়ান ১৪ মে নির্বাচনের আগে কঠোর রাজনৈতিক মাথাব্যথার মুখোমুখি হয়েছেন। সাম্প্রতিক ভয়াবহ ভূমিকম্পের প্রতিক্রিয়ায় এবং নির্মাণকাজে ধীরগতির জন্য অর্থনৈতিক সংকটকে দায়ী করেছেন।

জরিপগুলোতে একটি শক্ত প্রতিযোগিতার আভাস মিলেছে। তুরস্কের বর্তমান চিত্রের সঙ্গে ২০০২ সালের চিত্র মেলাচ্ছেন এরদোয়ানের সমালোচকরা। ওই সময়ে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছিল। এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেই সেসময়ে ক্ষমতায় এসেছিল এরদোয়ানের ইসলামপন্থী একে পার্টি।

তার বিরোধীরা তুরস্কে এরদোয়ান যে পরিবর্তনগুলো করেছেন তার অনেকগুলোই বাদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এগুলোর মাধ্যমে এরদোয়ান তুরস্ককে একটি ধার্মিক, রক্ষণশীল সমাজ এবং দৃঢ় আঞ্চলিক খেলোয়াড়ে রূপ দিতে চেয়েছিলেন।

২০১৬ সালে এরদোয়ানের বিরুদ্ধে একটি সামরিক অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছিল। সেই সময়ে বিচ্যুত সেনাদের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিলেন সাধারণ মানুষ। ওই ঘটনায় আড়াই শতাধিক মানুষ প্রাণ হারান।

প্রেসিডেন্ট ও সংসদীয় নির্বাচনে অনেক ঝুঁকি নিয়েছেন এরদোয়ান। এক ডজনের বেশি নির্বাচনে বিজয় অর্জন করেছেন বর্তমানে ৬৯ বছরের এরদোয়ান।

এরদোয়ান ভূমিকম্পের সুবিধা নেওয়ার জন্য বিরোধীদের দায়ী করেছেন। ভূমিকম্পে অর্ধলাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এরই মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে দফায় দফায় পরিদর্শন করেছেন এরদোয়ান। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় দ্রুত পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং ভবন নির্মাণে দুর্নীতির জন্য বহু নির্মাতাদের আটক করেছেন।
নির্বাচনের আগমুহূর্তে তিনি তুরস্কের তৈরি প্রথম বৈদ্যুতিক গাড়ি লঞ্চ করেছেন। তুর্কি ড্রোন বহন করার জন্য নিজেদের তৈরি প্রথম উভচর অ্যাসল্ট জাহাজের উদ্বোধন করেছেন। এছাড়াও বিভিন্ন শিল্প মাইলফলককে নির্বাচনী দৌঁড়ে অর্জন হিসেবে সামনে এনেছেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান।

নির্বাচনের আগে এরদোয়ান কৃষ্ণ সাগরের রিজার্ভ থেকে তুরস্কের প্রথম প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের সুইচ চালু করেছেন। দেশজুড়ে পরিবারের জন্য বিনামূল্যে গ্যাস সরবরাহের ঘোষণা দিয়েছেন এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্বোধন করেছেন।

তুরস্কের মূলধারার গণমাধ্যমগুলো এরদোয়ান ও তার দলের ব্যাপক কভারেজ দিচ্ছে। সেই তুলনায় তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কেমাল কিলিচদারুগলুর দিকে কম মনোযোগ দিচ্ছে। বিরোধীদলগুলো একটি অসম মাঠে খেলার অভিযোগ তুলেছে।

প্রধান বিরোধী জোটের বিরুদ্ধে তুরস্কে নিষিদ্ধ কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে) থেকে সমর্থনের অভিযোগ রয়েছে। এই সংগঠন ১৯৮০ সাল থেকে বিদ্রোহ চালাচ্ছে। এতে এখন পর্যন্ত ৪০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।

কিলিচদারুগলুকে সমর্থন দিচ্ছে কুর্দিপন্থী পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (এইচডিপি)। কুর্দিদের অধিকার রক্ষা করে এরই মধ্যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তিনি এবং এরদোয়ানকে 'লাখ লাখ কুর্দিদের সাথে সন্ত্রাসী হিসাবে আচরণ' করার অভিযোগ করেছেন।

এরদোয়ান বরাবরের মতো রক্ষণশীল ভোটারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছেন। সমকামিতার বিরুদ্ধে সূর চড়িয়েছেন তিনি।

তুরস্কে প্রথম রাউন্ডে জিততে হলে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেতে হবে যেকোনও প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে। তা না হলে ভোট দ্বিতীয় রাউন্ডে যাবে। জরিপ বলছে, ভোট দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে পারে। অনেক জরিপে দেখা গেছে যে, এরদোয়ান কিছুটা পিছিয়ে আছেন। এটি তার অপ্রচলিত অর্থনৈতিক নীতির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয়-সংকটের গভীরতার দিকে ইঙ্গিত করে।

ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির মুখে সুদের হার না বাড়িয়ের কমানোর ধারাতেই রয়েছেন এরদোয়ান। এর ফলে ২০২১ সালের শেষের দিকে তুর্কি মুদ্রার দরপতন এবং মুদ্রাস্ফীতির অবস্থা আরও খারাপ হয়। এরদোয়ান গত মাসে জোর দিয়েছিলেন যে, যতদিন তিনি ক্ষমতায় থাকবেন ততদিন সুদের হার হ্রাস পাবে এবং এর সঙ্গে সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতিও হ্রাস পাবে।

তার শাসনের প্রথম দশকে অর্থনীতি ছিল এরদোয়ানের অন্যতম প্রধান সম্পদ। তখন তুরস্ক নতুন রাস্তা, হাসপাতাল ও স্কুল এবং ৮৫ মিলিয়ন মানুষ জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান বিকাশ উপভোগ করেছিল।

ইস্তাম্বুলের আইসিক ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান সেদা ডেমিরালপ বলেন, 'যদি তিনি হেরে যান, তাহলে তার ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। কিন্তু যারা তাকে ভালোবাসে, তারা খুব সহজে হাল ছেড়ে দেবে না।'

স্থানীয় এক বাসিন্দা হালিমে ডুমান উচ্চমূল্যের কারণে অনেক দরকারি মুদি পণ্যও কিনতে পারছেন না। তারপরও তিনি নিশ্চিত যে এরদোয়ান এই সমস্যার সমাধান করতে পারবেন। ইস্তাম্বুলের একটি বাজারে বসে তিনি বলেন, আমি শপথ করে বলতে পারি, এরদোয়ান তার কব্জির ঝাঁকুনি দিয়ে এটি সমাধান করতে পারেন।'

প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ইস্তাম্বুলের একটি দরিদ্র জেলা থেকে উঠে এসেছেন। তিনি ইসলামিক ভোকেশনাল স্কুলে পড়াশোনা করেন এবং স্থানীয় দলের যুব শাখার নেতা হিসাবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ইস্তাম্বুলের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর তিনি একে পার্টির প্রধান হিসেবে জাতীয় মঞ্চে পা রাখেন এবং ২০০৩ সালে প্রধানমন্ত্রী হন।

এরদোয়ানের একে পার্টি তুরস্কের সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করে। ১৯৬০ সালের পর সামরিক বাহিনী তুরস্কের চারটি সরকারের পতন ঘটিয়েছিল। ২০০৫ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যুক্ত হওয়ার জন্য তুরস্ক আলোচনা শুরু করে। তবে পরে এই প্রক্রিয়া থেমে যায়।

পশ্চিমা মিত্ররা প্রাথমিকভাবে এরদোয়ানের তুরস্ককে ইসলাম এবং গণতন্ত্রের একটি প্রাণবন্ত মিশ্রণ হিসাবে দেখেছিল এবং মনে করেছিল যে এটি মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোর জন্য একটি মডেল হতে পারে। কিন্তু পরবর্তীতে তার ভিন্নতা দেখেছেন তারা।

বিরোধীরা ক্ষমতায় আসক্ত একজন নেতার কর্তৃত্ববাদের অভিযোগ করে আসছেন।

২০১৬ সালে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পর কর্তৃপক্ষ একটি ক্র্যাকডাউন শুরু করে। বিচারের অপেক্ষায় কারাগারে রয়েছেন ৭৭ হাজার জনের বেশি লোক। এছাড়া দেড় লক্ষাধিক মানুষকে সরকারি চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। গণমাধ্যম অধিকার সংগঠনগুলো বলছে, তুরস্ক এক সময়ের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাংবাদিকদের কারাগারে পরিণত হয়েছে।

এরদোয়ানের সরকার বলেছে যে, অভ্যুত্থান সমর্থকদের পাশাপাশি ইসলামিক স্টেট এবং পিকেকে এর হুমকি নির্মূল করা জরুরি ছিল।

আঙ্কারার প্রান্তে অবস্থিত নতুন রাষ্ট্রপতি প্রাসাদ নতুন ক্ষমতার একটি আকর্ষণীয় চিহ্ন হয়ে উঠেছে। এছাড়া বিদেশে তুরস্কের অবস্থান ক্রমশ দৃঢ় হচ্ছে। সিরিয়া, ইরাক এবং লিবিয়ায় হস্তক্ষেপ করেছে তুরস্ক। প্রায়শই সিদ্ধান্তমূলক শক্তির সাথে তুর্কি তৈরি সামরিক ড্রোন মোতায়েন করা হয়। ড্রোনগুলো ইউক্রেনকে রাশিয়ার আক্রমণ থেকে রক্ষা করতেও সহায়তা করেছে।


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

প্লটবঞ্চিত পূর্বাচলের আদিবাসিন্দাদের ৩শ’ ফুট সড়কে অবস্থান : বিক্ষোভ অব্যাহত

প্লটবঞ্চিত পূর্বাচলের আদিবাসিন্দাদের ৩শ’ ফুট সড়কে অবস্থান : বিক্ষোভ অব্যাহত

দেশে সংস্কার  ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার আহ্বান

দেশে সংস্কার ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার আহ্বান

ছাত্রলীগের হামলার শিকার শিক্ষার্থীদের মামলা করতে বললেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ

ছাত্রলীগের হামলার শিকার শিক্ষার্থীদের মামলা করতে বললেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ

উম্মাহর কল্যাণে মুসলমানদের ঐক্যের বিকল্প নেই

উম্মাহর কল্যাণে মুসলমানদের ঐক্যের বিকল্প নেই

বৈরুতে ইসরাইলি হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডারসহ নিহত ১৪

বৈরুতে ইসরাইলি হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডারসহ নিহত ১৪

পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র অপরাধে ব্যবহারের আশঙ্কা

পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র অপরাধে ব্যবহারের আশঙ্কা

মস্কোয় হামলার উপযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্র কিয়েভে পাঠাবে না জার্মানি

মস্কোয় হামলার উপযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্র কিয়েভে পাঠাবে না জার্মানি

জিয়ার ভূমিকাকে অবহেলা করায় পাহাড়ে সমস্যা হচ্ছে : জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরী

জিয়ার ভূমিকাকে অবহেলা করায় পাহাড়ে সমস্যা হচ্ছে : জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরী

মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই: তারেক রহমান

মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই: তারেক রহমান

বিচার বিভাগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা প্রধান বিচারপতির

বিচার বিভাগে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা প্রধান বিচারপতির

একদিনে ৮৪৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত, মৃত্যু ১

একদিনে ৮৪৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত, মৃত্যু ১

কুষ্টিয়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে সুগার মিলের নিরাপত্তা প্রহরীর মৃত্যু

কুষ্টিয়ায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে সুগার মিলের নিরাপত্তা প্রহরীর মৃত্যু

সাজেক ভ্রমণে আটকা পড়েছেন ৮০০ পর্যটক

সাজেক ভ্রমণে আটকা পড়েছেন ৮০০ পর্যটক

‘শুধু সংস্কারে থেমে থাকলেই চলবে না, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে হবে’ : তারেক রহমান

‘শুধু সংস্কারে থেমে থাকলেই চলবে না, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে হবে’ : তারেক রহমান

যে কোনো ষড়যন্ত্রের দাঁতভাঙা জবাব দিতে প্রস্তুত: বিএনপির স্থানীয় কমিটির সদস্য ডা. জাহিদ

যে কোনো ষড়যন্ত্রের দাঁতভাঙা জবাব দিতে প্রস্তুত: বিএনপির স্থানীয় কমিটির সদস্য ডা. জাহিদ

ভোলায় ঝড়ের কবলে পড়ে ১০ ট্রলারডুবি, নিখোঁজ ১

ভোলায় ঝড়ের কবলে পড়ে ১০ ট্রলারডুবি, নিখোঁজ ১

ছাত্ররাজনীতিতে গুণগত সংস্কার প্রয়োজন : শিবির সেক্রেটারী

ছাত্ররাজনীতিতে গুণগত সংস্কার প্রয়োজন : শিবির সেক্রেটারী

মতলবে ছেলের ইটের আঘাতে মায়ের মৃত্যু : আটক ছেলে

মতলবে ছেলের ইটের আঘাতে মায়ের মৃত্যু : আটক ছেলে

মব জাস্টিসের প্রতিবাদে চবিতে মানববন্ধন

মব জাস্টিসের প্রতিবাদে চবিতে মানববন্ধন

গুলিবিদ্ধ ইলহামের জন্য তারেক রহমানের অনন্য উদ্যোগ

গুলিবিদ্ধ ইলহামের জন্য তারেক রহমানের অনন্য উদ্যোগ