ভারতের জাতীয় সংগীতের সুরকার নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে কেন?

Daily Inqilab অনলাইন ডেস্ক

১৮ আগস্ট ২০২৩, ০৬:১৯ পিএম | আপডেট: ১৮ আগস্ট ২০২৩, ০৬:১৯ পিএম

 

 

ভারতের স্বাধীনতা দিবস ১৫ অগাস্ট থেকে গত দু-তিন ধরে নানা সামাজিক মাধ্যমে এবং মেসেজিং অ্যাপে কিছু মেসেজ ছড়ানো হচ্ছে, যাতে দেশটির জাতীয় সংগীত ‘জন গণ মন’-এর সুরকার নিয়ে ভুল তথ্য দেয়া হচ্ছে।

 

ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় - যারা দেশটির জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীতের মতো প্রতীকের মর্যাদা রক্ষার দায়িত্বে রয়েছে, তাদের ওয়েবসাইটে এ নিয়ে পরিষ্কারভাবে লেখা আছে যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ও সংগীত আরোপিত ‘জন গণ মন’ নামে পরিচিত গানটির প্রথম স্তবকটিই জাতীয় সঙ্গীত। রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞরা একাধিক প্রমাণ দিয়ে বলছেন, ‘জন গণ মন’ এর সুর রবীন্দ্রনাথের দেয়া এবং বিষয়টি নিয়ে বিতর্কের কোনও অবকাশ নেই। বিবিসি বাংলাও এর স্বপক্ষে একাধিক প্রমাণ খুঁজে বের করেছে।

 

সম্প্রতি যেসব বিভ্রান্তিমূলক এবং ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, তার ভিত্তি হচ্ছে সুভাষ চন্দ্র বসুর সহযোগী ও আজাদ হিন্দ ফৌজের ক্যাপ্টেন রাম সিং ঠাকুরির একটি পুরণো দাবি। তার দাবি হচ্ছে, বর্তমানে যে সুরে জনগণমন গাওয়া হয়, সেটি তার করা সুর। ঠাকুরি একটি বিখ্যাত গান, যা আজাদ হিন্দ ফৌজ এবং পরবর্তীতে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অন্যতম মার্চিং সং হিসাবে বাজানো হয়, সেই ‘কদম কদম বাঢ়ায়ে যা’-এর রচয়িতা এবং সুরকার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুর দেয়া 'জন গণ মন' ক্যাপ্টেন রাম সিং ঠাকুরির সুরারোপিত গান বলে চালানোর প্রচেষ্টার পিছনে হিন্দুত্ববাদীদের হাত আছে কী না, সেটাও একটা খতিয়ে দেখার বিষয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবদ্দশায় ধারণ করা অন্তত দুটি রেকর্ড বিবিসি বাংলা খুঁজে বার করেছে, যেখানে ‘জনগণমন’ গাওয়া হয়েছে। তার একটিতে আবার বঙ্কিম চন্দ্র চ্যাটার্জীর ‘বন্দে মাতরম’ গানটির একটি অপ্রচলিত সংস্করণও রয়েছে। ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত এই দুটি রেকর্ডের একটি ১৯৩৪-এ আর দ্বিতীয়টি ১৯৩৭ সালে ধারণ করা হয়েছিল। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গানটি লিখেছিলেন অনেক আগে, ১৯১১ সালে। প্রথম যে রেকর্ডটি ধারণ করা হয় ১৯৩৪ সালে, হিন্দুস্তান রেকর্ড প্রকাশিত সেই রেকর্ডের সংখ্যা এইএসবি ২৬২। ইউটিউবে গ্রামোফোনেটিক্স নামে একটি ইউটিউব চ্যানেলে সেটি পাওয়া যায়।

 

এখানে গানটি বৃন্দগান হিসাবে গাওয়া হয়েছিল, শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন অমলা দত্ত, নন্দিতা দেবী, সুধীন দত্ত এবং শান্তি ঘোষ। সম্ভবত এই শান্তি ঘোষ হলেন রবীন্দ্র সঙ্গীত বিশারদ শান্তিদেব ঘোষ, যিনি বিশ্বভারতীর ছাত্র হিসাবে সরাসরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে গান শিখেছিলেন। তিনি কোনও রবীন্দ্র সংগীত তার গুরুদেবের অনুমোদিত নয়, এমন সুরে গাইবেন, তা একপ্রকার অসম্ভব।

 

দ্বিতীয় যে রেকর্ডটি পাওয়া যায় ১৯৩৭ সালের, সেটিও ওই গ্রামোফোনেটিক্স ইউটিউব চ্যানেলেই পাওয়া যায়। এখানেও একই সুরে গাওয়া হয়েছে জন গণ মন’। এই গানটির ওপরে ছবি হিসাবে হিন্দুস্তান রেকর্ডের একটি বিজ্ঞাপন ব্যবহার করা হয়েছে, যেখানে তাদের ‘ডিসেম্বর মাসের নতুন রেকর্ডে’র তালিকা ছাপানো রয়েছে। এইচ ৫৭০ নম্বর রেকর্ডের এক পিঠে ছিল বন্দেমাতরম ও অন্য পিঠে জন গন মন অধিনায়ক।

 

এই এলপি রেকর্ডের ছবি বিবিসিকে পাঠিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রায় সব গানের রেকর্ড যার সংগ্রহে আছে, সেই সংগ্রাহক মানস মুখোপাধ্যায়। ওই ছবিতে দেখা যাচ্ছে ‘বন্দে মাতরম’-এর সেই সংস্করণটি শিল্পীদের স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিখিয়েছিলেন। এ থেকে বোঝাই যায়, যে রেকর্ডের প্রযোজনায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যুক্ত, সেই রেকর্ডেরই এক পিঠে ‘জনগণমন’ যে সুরে গাওয়া হয়েছে, সেটি তিনি নিজে শুনেছিলেন এবং অনুমোদনও দিয়েছিলেন।

 

রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, লেখক রাম কুমার মুখোপাধ্যায় বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন যে ‘জন গণ মন’-র সুর যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেওয়া, তা নিয়ে বিতর্কের কোনও অবকাশ নেই। 'জনগণমন' গানটি ১৩১৮ বঙ্গাব্দে রচিত। ১৯১১ সালে কলকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশনে গাওয়া হয় সেটি। রবীন্দ্রনাথের সমস্ত গানের সুর যে গ্রন্থাবলীতে লিপিবদ্ধ আছে, সেই স্বরবিতানের ১৬ নম্বর খণ্ডের ১৮০ পাতায় রয়েছে। প্রথমে গানের কথা আর পরের পাতায় গানের স্বরলিপি রয়েছে,” বলছিলেন মুখোপাধ্যায়।

 

ভারত সরকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা এবং সুরারোপিত গানটিকেই যে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গ্রহণ করেছে, সেই তথ্য ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে একাধিকবার উল্লেখ করা রয়েছে। তাই অন্য কেউ জাতীয় সংগীতের সুরকার বলে দাবি করলে তার গ্রহণযোগ্যতা থাকে কী না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে রাম সিং ঠাকুরি তো নিজেই একজন জাতীয় নায়কের মর্যাদা পেয়েছেন তার নিজস্ব গান ‘কদম কদম বাঢ়ায়ে যা’-এর কথা এবং সুরের জন্য। তাহলে কেন তাকে জাতীয় সংগীতের সুরকার বলে তুলে ধরার চেষ্টা কেন করা হচ্ছে কোনও কোনও মহল থেকে?

 

কেন বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে?

হিন্দুত্ববাদের গবেষক ও সাংবাদিক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য বলছেন, “গত বেশ কিছু বছর ধরে এক অংশের হিন্দিভাষী লেখক এ দাবি করে চলেছেন আর মূলত হিন্দিভাষী গণমাধ্যমও তথ্য যাচাই না করেই তাদের দাবি প্রকাশ করে চলেছে। “২০২১-এ এই দাবি নিয়ে প্রকাশিত রাজেন্দ্র রাজনের বই সে রাজ্যের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ করেন এবং ২০২২-এ দূরদর্শন হিমাচল তাকে নিয়ে তাদের বাগধারা অনুষ্ঠানের একটি এপিসোডও প্রচার করে। সেখানেও একই দাবি রাখা হয়"।

 

"রাম সিং ঠাকুরি হিমাচলের বাসিন্দা হলেও গোর্খা ছিলেন। ভারতীয় গোর্খাদের মধ্যে তাকে নিয়ে বিশেষ গর্ব আছে। মি. ঠাকুরিকে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে গোর্খাদের হিন্দুত্ববাদীরা নিজেদের কাছাকাছি আনতে চাইছে, এরকম সন্দেহ করার কারণ আছে,” বলছিলেন ভট্টাচার্য। তার কথায়, “হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা বরাবরই জনগণমন-এর বদলে বন্দে মাতরমকে জাতীয় সংগীত হিসাবে দেখতে চেয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে এই গান পঞ্চম জর্জের উদ্দেশ্যে রচনা করেননি, তার প্রভূত প্রমাণ থাকা স্বত্বেও এই বিষয়টিকে ফিরিয়ে এনে তারা একাধিকবার বন্দেমাতরমকে জাতীয় সংগীত করার দাবি জানিয়েছে। এই গানটির সুর নিয়ে বিতর্কও ঠিক তারাই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে চাগিয়ে তুলছেন কী না সেটা যদিও এখনও পরিষ্কার নয়।“

 

তার প্রশ্ন, “এটা বলতেই হবে, যে রাম সিং ঠাকুরির যা বাস্তবিক অবদান, তাতে তিনি এমনিতেই একজন জাতীয় নায়ক। কদম কদম বাড়ায়ে যা’র স্রষ্টাকে সম্মান জানানোর জন্য কোনও মিথ্যা প্রচার করার কী দরকার?” সূত্র: বিবিসি।

 


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

একমাত্র সঞ্জয়ই দোষী, সাজা ঘোষণা সোমবার
ইরানের প্রেসিডেন্টের সালামের উত্তর দিলেন পুতিন
ইরানের সুপ্রিম কোর্টের সামনে বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত দুই বিচারক
কেন মেলোনির সামনে হাঁটু গেড়ে বসলেন আলবেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী?
ট্রাম্পের অভিষেকে যোগ দিচ্ছেন মুকেশ ও নীতা আম্বানি
আরও

আরও পড়ুন

মুন্সীগঞ্জে ডাকাতির লুন্ঠিত মালামাল সহ ৭ ডাকাত গ্রেফতার

মুন্সীগঞ্জে ডাকাতির লুন্ঠিত মালামাল সহ ৭ ডাকাত গ্রেফতার

মাগুরার মহম্মদপুরে বিক্ষোভ মিছিল

মাগুরার মহম্মদপুরে বিক্ষোভ মিছিল

স্বৈরাচারের দোসররা দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে: সেলিমা রহমান

স্বৈরাচারের দোসররা দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে: সেলিমা রহমান

ভৈরবে হাইব্রিড ডাকায় বিএনপির দুগ্রুপের সংঘর্ষ, ২০ দোকানপাট ভাঙচুর, আহত ৩

ভৈরবে হাইব্রিড ডাকায় বিএনপির দুগ্রুপের সংঘর্ষ, ২০ দোকানপাট ভাঙচুর, আহত ৩

নানুপুর ওবাইদিয়া মাদ্রাসায় খতমে বুখারী অনুষ্ঠিত

নানুপুর ওবাইদিয়া মাদ্রাসায় খতমে বুখারী অনুষ্ঠিত

টেকনাফে পাহাড়ের খাদ থেকে হাতির মরদেহ উদ্ধার

টেকনাফে পাহাড়ের খাদ থেকে হাতির মরদেহ উদ্ধার

চকরিয়ায় গৃহবধূ হত্যার ঘটনায় ঘাতক স্বামী গ্রেপ্তার

চকরিয়ায় গৃহবধূ হত্যার ঘটনায় ঘাতক স্বামী গ্রেপ্তার

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে ফের বিএসএফের হানা, রুখে দাঁড়িয়েছে হাজারো গ্রামবাসী

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে ফের বিএসএফের হানা, রুখে দাঁড়িয়েছে হাজারো গ্রামবাসী

রাজনৈতিক অঙ্গনকে দুর্বৃত্তমুক্ত করতে হবে :  ড. বদিউল আলম

রাজনৈতিক অঙ্গনকে দুর্বৃত্তমুক্ত করতে হবে : ড. বদিউল আলম

কুষ্টিয়ায় পুলিশ পরিচয়ে ছিনতাইকালে অস্ত্র-গুলিসহ আটক ২

কুষ্টিয়ায় পুলিশ পরিচয়ে ছিনতাইকালে অস্ত্র-গুলিসহ আটক ২

১৯ উইকেট পতনের দিনে এগিয়ে পাকিস্তান

১৯ উইকেট পতনের দিনে এগিয়ে পাকিস্তান

আল্লাহর দয়ায় পা ভাঙেনি: শাওন

আল্লাহর দয়ায় পা ভাঙেনি: শাওন

মাইজভান্ডার দরবার শরীফ জেয়ারতে প্রধান বিচারপতি

মাইজভান্ডার দরবার শরীফ জেয়ারতে প্রধান বিচারপতি

জবিস্থ ফেনী জেলা ছাত্রকল্যাণ পরিষদের নেতৃত্বে শ্রাবণ -আরিফ

জবিস্থ ফেনী জেলা ছাত্রকল্যাণ পরিষদের নেতৃত্বে শ্রাবণ -আরিফ

টিউলিপের পদত্যাগ ছিল অবধারিত

টিউলিপের পদত্যাগ ছিল অবধারিত

গণপরিবহনে শৃঙ্খলায় কাউন্টার স্থাপনের পরিকল্পনা

গণপরিবহনে শৃঙ্খলায় কাউন্টার স্থাপনের পরিকল্পনা

সীমান্তের ঘটনা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে বলেছে বিএসএফ

সীমান্তের ঘটনা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে বলেছে বিএসএফ

মুসলিম বিশ্বে অনৈক্যের কারণেই গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরাইল : মাহমুদুর রহমান

মুসলিম বিশ্বে অনৈক্যের কারণেই গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরাইল : মাহমুদুর রহমান

আ’লীগ সাংবাদিকসহ প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানে দলীয়করণ করেছিল: সাদিক রিয়াজ

আ’লীগ সাংবাদিকসহ প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানে দলীয়করণ করেছিল: সাদিক রিয়াজ

যৌক্তিক সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করুন

যৌক্তিক সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করুন