প্রশ্ন: যুদ্ধ যুদ্ধবন্দীদের প্রতি ইসলামের নীতি কি?
২১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম
উত্তর: আজকাল যুদ্ধের ভয়াবহ ও মর্মান্তিক পরিণাম দুনিয়ার মানুষের কাছে এতই স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, স্বয়ং সেনানায়করাও এটাকে পৃথিবীর সবচাইতে নিকৃষ্ট ব্যাপার বলে মনে করেন। জেনারেল চার্লস নেপিয়ার যুদ্ধের ভয়াবহরূপ অত্যন্ত চমৎকার উপমার সাহায্যে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি বলেন, একজন যোদ্ধার জীবন সেই বাইজির মতো, যাকে এমনই একটা হলে নাচতে দেয়া হলো, যার দেয়ালগুলোয় ভাঙ্গা কাচ গেঁথে রাখা হয়েছে। যখনই সে নাচতে নাচতে দেয়াল ঘেঁষতে যায়, অমনি তার দেহ ক্ষত-বিক্ষত হয়ে রক্তের স্রোত বয়ে চলে। সঙ্গে সঙ্গে তার নাচের উন্মাদনা ও তন্ময়তা ছুটে যায়। সে বেচারা চোখ খুলে দেখতে পায় যে তাকে বিরাট এক ষড়যন্ত্রজালে আবদ্ধ করা হয়েছে। ঠিক তেমনি একজন যোদ্ধা সমরাস্ত্রের চাকচিক্যে আকৃষ্ট হয়ে যুদ্ধের ময়দানে ছুটে যায় বেশ হাসিখুশি ভাব নিয়েই। কিন্তু কয়েকদিনেই তার চোখ খুলে যায় এবং দেখতে পায় যে অস্ত্রের চাকচিক্য কতখানি অন্ধ ও আহাম্মক করেছিলো। তাই সে তার পথ অন্ধকার দেখতে পায় এবং তার মনে হয় রক্ত ও কাঁটার বিস্তীর্ণ প্রান্তরের মাঝখানে এনে তাকে রাখা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, মানুষের চারিত্রিক মান দিন দিন উন্নত হয়ে চলেছে। বর্বরযুগের নির্দয়তা ও অত্যাচারমূলক রীতি-নীতি প্রায়ই লোপ পেয়ে চলেছে। তার বদলে সহানুভূতি ও ত্যাগের স্পিহা ব্যাপক হারে দেখা যাচ্ছে। অতিতে যুদ্ধ ছিল একটা প্রশংসনীয় ব্যাপার। কিন্তু আজ তাকে অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ বলে গণ্য করা হয়। কিছুদিন আগে মানুষ ভেড়ার ভেতরে লড়াই বাঁধিয়ে গৌরব বোধ করেছে। আজকের প্রত্যেকটি সভ্য মানুষ তা করতে লজ্জাবোধ করে। আগেরকার দিনে পশুর লড়াই দেখার জন্য বিশেষ ময়দান নির্বাচিত করা হতো। এভাবে পশুগুলো কি ভীষণ বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে মানুষ মহাআনন্দ উপভোগ করতো। আজ পশু রক্ষার সমিতি গড়ে তোলা হচ্ছে এবং পশুগুলোকে অকথ্য জুলুমের হাত হতে বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন স্থানে সমিতি করে নেয়া হয়েছে। এভাবে পশুও আজ মানুষের দয়া ও সহানুভূতি লাভ করে চলছে।
যুদ্ধের ভিত্তিমূল হলো হিংসা ও প্রতিশোধস্পৃহা। পৃথিবীর এমন কোন জাতি নেই যাদের বুকে এ অগ্নিকু- প্রজ্বলিত হয়নি। তাই আন্তর্জাতিক সন্ধি বাহ্যত অসম্ভব মনে হয় কিন্তু যুগের ভিত্তিতে আরেক যুগ সম্পর্কে ধারণা ভুল। প্রাচীন যুগে সব জাতি ব্যক্তি বিশেষের ইচ্ছার আত্মহুতি দিত এবং সে ব্যক্তিও জাতির সব স্বার্থ স্বীয় স্বার্থের বেদীতে উৎসর্গ করতো। পক্ষান্তরে, আজ প্রায় সব দেশের সব জাতি মুক্ত ও স্বাধীন। তাদের বাদশা তারাই গড়ে ও চালায়। পৃথিবী এখন ব্যক্তিবিশেষের অত্যাচার-উৎপীড়নের হাত থেকে নিস্তার লাভ করেছে। তারা এখন তাদের সর্ববিধ কল্যাণ ও স্বার্থকে প্রিয়তর ভাবে। বিভিন্ন জাতির ভেতরে এই একই ধরনের লক্ষ্য ও আদর্শ পারস্পরিক ঐক্য ও সম্প্রীতির দারমুক্ত করেছে। স্বেচ্ছাতন্ত্রের জঘন্য পর্দা এখন আর এক জাতিকে অপর জাতি থেকে আড়াল করে রাখে না। ইংরেজ ও ফরাসি জাতির ভেতরে যে বিদ্বেষ ও বিরোধ চলছিলো তার চাইতে বড় উদাহরণ জাতিতে জাতিতে বিরোধ বিসম্বাদের ইতিহাসে আর মিলবে কি? কিন্তু কল্যান চিন্তা ও সন্ধি ব্যবস্থা উভয় জাতিকে আজ একাকার করে দিয়েছে। আজ ইংরেজি ও ফরাসি সৈন্যরা একই কাতারে দাঁড়িয়ে শত্রুর মোকাবেলা করছে। জার্মান ও ফরাসি যদিও দুটি পরস্পর বিরোধী জাতি এবং একদল অপর দলের রক্তপানের জন্য উদগ্রীব, তথাপিকালে যে তাদের ভেতরেও কল্যাণকর সন্ধি ব্যবস্থা জয়ী হবে, সাময়িক ঘটনা প্রবাহে সে কথা আমাদের অস্বীকার করলে চলবে না। এটা অসম্ভব নয় যে একদিন জার্মানি ইংল্যান্ড একাকার হয়ে যাবে।
আগেরকার জাতিরা যুদ্ধবন্দীদের এরূপ অপরাধী ভাবতো যে, কোন আইনই তাদের বিন্দুমাত্র সহায়তা করতে সমার্থ হতো না। তাই তাদের অত্যন্ত নির্দয়ভাবে হত্যা করা হতো। বলাবাহুল্য, যুদ্ধবন্দীদের বেলায় আশুরী, মিসরী ও ইয়াহুদী জাতির নীতি ছিল ভয়ানক। এমন ক, তাদের জবরদস্তির হাত অনেক সময় বন্দীদের আওতা পেরিয়ে স্বাধীন মানুষের গর্দান পর্যন্ত পৌঁছে যেত। ফেরাউন বনু ইসরাইলের নিষ্পাপ শিশুদের নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। এর কয়েক যুগ পরে তাদের এই চরম নীতির কিছুটা শিথিল হলো; ব্যাপক বিপ্লবের মাধ্যমে। হত্যার বদলে দাস বানাবার নীতি গ্রহণ করলো। এটা অবশ্যই জয়ী ও বিজিতদের হত্যাকার্য অনুষ্ঠান থেকে কিছুটা ভালো ব্যবস্থা। রোমোকগণই সর্বপ্রথম এ নীতি অনুসরণ করল। প্রথম প্রথম অবস্থা এই ছিল যে, যে সিপাহী যাকে বন্দী করত সেই তার মালিক। কিন্তু কিছুদিন পরেই রোম সম্রাট সেই মালিকানা নিজের করে নিলেন। তবে মধ্যযুগে রমকরা আবার সেই প্রাচীন হত্যা নীতি অনুসরণ শুরু করল। যুদ্ধবন্দীদের দাসে পরিণত করার বদলে তরবারির শিকারে পরিণত করল। সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধবন্দীদের ক্রয়-বিক্রয় ও দাসে পরিণত করার অধিকারও তাদের রয়ে গেল। এরপরে স্বার্থপরতার আরো একধাপ এগুলো। মানে যুদ্ধবন্দীদের বিনিময়ে মোটা অর্থ সম্পদ আয়ের ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলো। অবশেষে শেষ যুগে ইয়াফায় নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ২০০০ কয়েদীকে হত্যা করে আবার সেই বর্বর দৃশ্য পৃথিবীর সামনে উদ্ভাসিত করে তুলল। অবশ্য দুনিয়ার মানুষের কাছে নেপোলিয়ন কৈফিয়াদের দিল যে, “এরা আরও একবার বন্দী হয়ে আমার হাতে মুক্ত লাভ করে পুনরায় যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ায় এই শাস্তি দেয়া হলো”। বর্তমানে আবু গারিব কারাগারে বন্দীদের সাথে আমেরিকার সৈন্যরা যে অমানবিক নির্যাতন জুলুম করছে তা কোন সভ্য জগতের কাজ হতে পারে না।
বদর যুদ্ধে হযরত মুহাম্মদ (স.) ৭০ জন কয়েদীর মধ্যে সামার্থবানদের থেকে বিনিময় গ্রহণপূর্বক মুক্তির ব্যবস্থা করেন। যাদের সামর্থ ছিল না তারা ১০জন করে মুসলমান শিশুকে শিক্ষাদানের মাধ্যমে মুক্তির ব্যবস্থা করেন। বনু মুস্তালিকের যুদ্ধবন্দীদের একদল কয়েদীর থেকে বিনিময় গ্রহণ করেন অন্যদল থেকে বিনিময় ছাড়াই আজাদী করে দিলেন। দুমাতুল জন্দলের যুদ্ধে প্রায় ১০০ স্ত্রী ও শিশু বন্দি হয়েছিল। আবু যায়েদ মুসলমান হয়ে হযরত সাঃ এর কাছে মুক্তির জন্য আবেদন জানালে তখনই হযরত যায়েদ বিন হারিসাকে নির্দেশ দিলেন মুক্তির জন্য। বনু তামিমের যুদ্ধে সাহাবারা ১১ জন নারী ও ৩০ টি শিশু বন্দি করেছিলেন। হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম তাদের রিমালা বিনতে হারিসের দায়িত্বে আবদ্ধ রাখলেন। যখন তাদের দল প্রতি এলেন তখন তারা তাকে দেখে কান্নাকাটি শুরু করলো। ফলে হযরত মুহাম্মদ সাঃ সবাইকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন । হাওয়াজিনের যুদ্ধে ২০০০ নর-নারী বন্দী হয়ে এলেন। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম তখন সাহাবাদেরকে ডেকে বললেন, এখনই সকল বন্দীদের ছেড়ে দেন। যারা বিনিময় লাভের আশা রাখেন তারা কিছুদিন ধৈর্য ধরুন। আমার পঞ্চমাংশ গনিমতের মাল হাতে এলেই প্রত্যেক কয়েদির বিনিময়ে আমি ১৬ টি উট দিব। ইয়ামামার যুদ্ধে শিমামা নামক এক সর্দার বন্দী হয়ে এলে রসুল স. তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার নিকট কিছু আছে কী? সে জবাব দিল, যদি আপনি আমাকে হত্যা করতে চান তাহলে আমার শিরায় রক্ত আছে, যদি আমাকে ক্ষমা করতে চান তাহলে আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জিহ্বা রয়েছে, যদি ধন-সম্পদ চান তাহলে যত চান তা সহজেই দেয়া যাবে। রাসুল স.) তার উত্তর শুনে পরদিন তাকে বিনা খিসারাতে মুক্তি দিলেন। মুক্ত হয়ে কালেমা পড়ে শিমামা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন। বনু কুরাইজার যুদ্ধে অনেক যুদ্ধবন্দীদেরকে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব সহজেই মুক্ত করে দিয়েছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম মদিনার বনু নাজির ইহুদি সম্প্রদায় কে মদিনা ছেড়ে যাবার নির্দেশ দিলেন। তখন তাদের ভেতরে নব দীক্ষিত কিছু ইহুদি শিশু ছিল। সাহাবারা তাদের ধর্ম থেকে ফেরাবার জন্য রেখে দিতে চাইলেন। তখন সে সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারার ২৫৪ নাম্বার আয়াত নাযিল হলো: আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা বললে, ধর্মে জবরদস্তি কোন স্থান নাই। এ কথা নিশ্চিত যে, সত্য ও অসত্যের পার্থক্য স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে।
আধুনিক যুগে উদারনীতি ভিত্তিক আইন-কাননের দৃষ্টিতে বন্দীদের পোশাক-আশাক ও সাজসজ্জা খুলে নেয়া চলে না। কিন্তু ইসলামের মহান বিধানে শুধু তাই নয়, বন্দীদের উপযুক্ত পোশাক-পরিচ্ছদ দেবার ব্যবস্থা রয়েছে। বদরের যুদ্ধে যখন হযরত আব্বাস বন্দী হয়ে হযরত মুহাম্মদ স.) এর কাছে প্রায় নগ্ন অবস্থায় নীত হলেন তখন তিনি আব্দুল্লাহ বিন সলুলের জামা নিয়ে তাকে দিলেন। বর্তমান সময়ে পৃথিবীর কোন জাতি যুদ্ধবন্দীদের সাথে উদারতা দেখাতে পারেনি। বন্দীদের দৈহিক কষ্টের চাইতেও বেশি মর্মান্তিক হলো মানসিক যাতনা। পিতা-মাতা, ভাই-বোন, স্ত্রী-পুত্র, থেকে দীর্ঘদিন দূরে থাকায় যে বিরহ বেদনার সৃষ্টি হয়, তার তুলনা হয় না। ইসলামই বন্দীদের দৈহিক কষ্ট দূর করার সাথে সাথে মানসিক কষ্ট দূর করারও ব্যবস্থা রেখেছে। যেকোনো সময়ে আত্মীয়-স্বজন এসে বন্দীদের সঙ্গে দেখাশোনা করে যেত অবাধে। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু যখন জনৈক দাসীকে মা থেকে দূরে রাখতে চাইলেন তখন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সালাম তাকে বাধা দিলেন। এ নীতির ভিত্তিতেই ইসলাম কখনো বন্দীদের ধর্ম মত নিয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করতো না।
উত্তর দিচ্ছেন : ইলিয়াজ হোসেন রানা, গবেষক, কলামিষ্ট।
বিভাগ : ইসলামী প্রশ্নোত্তর
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব অব্যাহত থাকবে
চলতি মাসে পদোন্নতি পাচ্ছেন ২৫ ক্যাডারের উপসচিবরা
দুই মামলায় মির্জা ফখরুলকে অব্যাহতি
সেন্টমার্টিন দ্বীপে ভ্রমণ বিধিনিষেধ প্রত্যাহার হচ্ছে না
ফ্যাসিস্ট হাসিনা জানতেন না কুমিল্লা খন্দকার মোশতাকের নয়, মেজর গনি-ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের
৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ২২ ডিসেম্বর
পক্ষভুক্তদের রুল শুনানি আজ
সংবিধান পুনর্লিখনের প্রস্তাব দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন
রাঙামাটির সাজেকে দিনভর গোলাগুলি: ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জেলা প্রশাসনের
'বিপ্লবোত্তর ছাত্র ঐক্য' জবিতে ১২ ছাত্রসংগঠনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ
শেরপুরে সেনা সদস্যকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় ৩৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা : গ্রেপ্তার-৭
ঢাকায় তিন দিনব্যাপী ইরানি চলচ্চিত্র উৎসব শুরু
খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করলেন পাকিস্তানের হাইকমিশনার
ফিলিস্তিনে ইসরাইলের বর্বর হামলার প্রতিবাদে ঢাকায় আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত
বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের বিরুদ্ধে অবস্থাকারীরাই মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের দায়িত্বে
ভিভো ভি৪০ ফাইভজি, হালকা ওজনে শক্তিশালী ব্যাটারি
ভারতের শাসকগোষ্ঠী ও হিন্দুত্ববাদী শক্তি সম্প্রীতি চায় না: তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা
দিল্লী দিশেহারা হয়ে নানা ধরনের বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে: শাহীন শওকত
বাংলাদেশে ব্রিটিশ নাগরিকদের ভ্রমণে সতর্কতা জারি
সামরিক আইন জারি দক্ষিণ কোরিয়ায়