ইসলামের দৃষ্টিতে রোগীর রোগের চিকিৎসা

Daily Inqilab ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

১০ মার্চ ২০২৩, ০৮:২৩ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১০:৩৯ পিএম

মানুষ যাতে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকে সে ব্যাপারে ইসলাম জোর তাগিদ দিয়েছে। অসুস্থ হলে চিকিৎসা গ্রহণের জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) উৎসাহিত করেছেন। তিনি নিজে অসুস্থ হলেও চিকিৎসা গ্রহণ করতেন। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘হে আল্লাহর বান্দাগণ! তোমরা চিকিৎসা গ্রহণ করো, কেননা আল্লাহ তাআলা এমন কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি, যার প্রতিষেধক তিনি সৃষ্টি করেননি; শুধু বার্ধক্যরোগ ব্যতীত।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৩৮৫৫)। অভিজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে চিকিৎসার নির্দেশ অভিজ্ঞ ব্যক্তির দিকনির্দেশনায় চিকিৎসা করা হলো ইসলামের নির্দেশ। হাদিস শরিফে এসেছে, সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) হৃদরোগে আক্রান্ত হলে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে তখনকার প্রসিদ্ধ ডাক্তার হারেস ইবনে কালদাহর কাছে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৮৭৫)। মুসনাদে আহমাদের অপর একটি বর্ণনায়ও এসেছে যে জনৈক রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে রাসুল (সা.) গোত্রের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। (হাদিস : ২৩১৫৬)।

ইসলামী শরিয়ত যেভাবে রোগীকে নির্দেশ দেয় অভিজ্ঞ ডাক্তারের মাধ্যমে চিকিৎসা গ্রহণের, তদ্রূপ ডাক্তারকে নির্দেশ দেয় পরিপূর্ণ জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের। না জেনে চিকিৎসা করা বৈধ নয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ডাক্তারি না শিখে কারো চিকিৎসা করে, আর এতে অজ্ঞতার কারণে রোগীর কোনো ক্ষতি করে ফেলে, তাহলে চিকিৎসক দায়ী হবে।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৫৮৭)। সরকারি আইনে সার্টিফিকেটের বাধ্যবাধকতা থাকলে সরকারি আইন মেনে চলাও আবশ্যক। (আলফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু : ৫/৪৪৯, আহসানুল ফাতাওয়া : ৮/৯৫)। রোগীর প্রতি চিকিৎসকের দায়িত্ববোধ কেমন হওয়া উচিত তা বলে বুঝানোর প্রয়োজন নেই। রোগীর প্রতি চিকিৎসকের দায়িত্ব, চিকিৎসা শাস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হওয়ায় শিক্ষকরা ছাত্রদেরকে অবশ্যই তা তালিম দিয়ে থাকেন। প্রাচীন চিকিৎসাবিদ্যার শুরু আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে। আদিম মানুষ রোগবালাই ও অন্যান্য দুর্যোগকে স্রষ্টার অভিশাপ, শরীরে ভূতপ্রেতের অশুভ আছর বা দুষ্টগ্রহের কুপ্রভাবের ফল মনে করত। পরবর্তী কালের মানুষ চিকিৎসাবিদ্যার অনেক উন্নতি ঘটায় এবং বিভিন্ন দ্রব্যাদি রোগের নিরাময়ে ব্যবহার করে।

বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে বর্তমানকাল পর্যন্ত ভারতীয় চিকিৎসা পদ্ধতি আয়ুর্বেদ অর্থাৎ প্রাণবিজ্ঞান নামে অভিহিত। আত্রেয় (প্রায় ৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে), চরক, সুশ্রুত ও ভগবত ছিলেন আয়ুর্বেদের বিশ্রুত বিশেষজ্ঞ। প্রথম ভারতীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও শিক্ষকরূপে পরিগণিত আত্রেয় বর্তমান পাকিস্তানের তক্ষশীলার বাসিন্দা ছিলেন। বর্তমানকালেও আয়ুর্বেদের অন্যতম জনপ্রিয় নাম চরক ছিলেন বৌদ্ধরাজা কণিষ্কের রাজচিকিৎসক (২০০ খ্রিস্টাব্দ)। চরকের চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিখ্যাত গ্রন্থটির নাম চরক-সংহিতা। বারাণসীর বাসিন্দা সুশ্রুত ভারতীয় শল্যচিকিৎসার আকরগ্রন্থ সুশ্রুত-সংহিতা লিখেছিলেন। প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসকগণ ভগ্ন বা স্থানচ্যুত অস্থিসন্ধির চিকিৎসা, শরীরের অর্বুদ (টিউমার), হার্নিয়া ও চোখের ছানি অপসারণে দক্ষ ছিলেন। ভারতে মুসলমান বিজয়ের পর থেকে আয়ুর্বেদ চিকিৎসার ক্রমে অবনতি ঘটতে থাকে। পাঠান ও মুগল রাজাদের আনুকূল্যে বিকশিত ইউনানি তিবিব চিকিৎসা পদ্ধতি আয়ুর্বেদের স্থান দখল করতে থাকে। এভাবে আঠারো শতকে ব্রিটিশ রাজত্বের সূচনাকাল পর্যন্ত ইউনানি তিবিব চিকিৎসার প্রসার অব্যাহত থাকে। দিল্লি, আগ্রা, আলীগড়, লক্ষ্ণৌ, হায়দ্রাবাদ এসব নগরকে কেন্দ্র করে ইউনানি চিকিৎসা বিকশিত হয়েছিল। ১৮১০ ও ১৮৩৯ সালের মধ্যবর্তী সময়ে জার্মান চিকিৎসক স্যামুয়েল হ্যানিম্যানের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা ভারতে গ্রহণযোগ্যতা পায় এবং এখনও এই চিকিৎসার জনপ্রিয়তা অব্যাহত রয়েছে।

বর্তমান বাংলাদেশ ভূখ-ে এলোপ্যাথিক চিকিৎসার প্রচলন হয় ব্রিটিশ আমলে। প্রাথমিক অবস্থায় হাতে গোনা কয়েকজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এলোপ্যাথিক ডাক্তার ছিলেন। এদেশের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশরা দক্ষ ইংরেজ চিকিৎসক নিয়োগের এবং স্বাস্থ্যখাতে পরিবর্তন আনার প্রয়োজন অনুভব করে। ১৮৫৯ সালে বহু বেসামরিক লোক ও সেনা সদস্যের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানের জন্য একটি রয়েল তদন্ত কমিশন ভারতে পাঠানো হয়। কমিশন প্রতিটি প্রেসিডেন্সিতে একটি করে জনস্বাস্থ্য কমিশন গঠনের সুপারিশ করে। ১৮৬৪ সালে বোম্বে, মাদ্রাজ ও বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির প্রত্যেকটির জন্য প্রতিটি ৫ সদস্যের ৩টি স্যানিটারি কমিশন গঠিত হয়। সিভিল সার্জনরা পদাধিকারবলে জেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। ১৮৬৯ সালে মেডিক্যাল অফিসার পদের নাম বদলে স্যানিটারি কমিশনার রাখা হয়। সরকার ওই বছরই কেন্দ্রে ও অন্যান্য রাজ্যে কয়েকজন স্যানিটারি কমিশনার নিযুক্ত করে।

১৮৭৩ সালে আইনের মাধ্যমে জন্মমৃত্যু নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়। ১৮৮০ সালে গুটিবসন্তের টিকা নেওয়ার জন্য আইন এবং ১৮৮১ সালে প্রথমবারের মতো ভারতীয় শিল্পকারখানা আইন চালু হয়। ১৮৯৬ সালে হাজার হাজার লোক প্লেগ রোগে মারা যায় এবং সরকার একটি প্লেগ কমিশন গঠন করে। ১৮৯৭ সালে সংক্রামক ব্যাধি আইন ঘোষিত হয় এবং ১৯০৪ সালে প্লেগ কমিশন তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করে। কমিশন জনস্বাস্থ্য সংস্থাগুলি পুনর্গঠনের সুপারিশ করে। অন্যান্য প্রদেশের মতো বাংলার স্যানিটারি কমিশনার জনস্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পায় এবং সংস্থার অফিস সার্জন জেনারেলের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে, নবী (সা.) খুব সংক্ষেপে, কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা আমাদের শিখিয়ে গেছেন। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করেন, বান্দা যখন কোনো কাজ করে বা কোনো বিষয় শিখে তা যেন খুব ভালোভাবে করে বা শিখে।’ (তবরানী, আল মুজামুল আওসাত, খ--১, পৃষ্ঠা: ২৭৫)।রাসূল (সা.) এর কথার মর্ম হচ্ছে, একজন ছাত্র ডাক্তারি পোশাক গ্রহণ করলে, তার জন্য কর্তব্য হচ্ছে, উক্ত পেশায় পূর্ণ দক্ষতা অর্জন করা। কেউ ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইলে, উক্ত বিষয়ে সে যেন ভালোভাবে দক্ষতা অর্জন করে। আধা আধা শিখে কোনো কাজ শুরু করা খুবই অন্যায়। একটি প্রবাদ বাক্য আছে, অর্ধেক মোল্লা দ্বীনের জন্য হুমকি আর অর্ধেক ডাক্তার জীবনের জন্য হুমকি।’ তাই কর্তব্য হলো পূর্ণ দক্ষতা নিয়ে মানুষের সেবা করা।

নি¤েœ চিকিৎসা ও চিকিৎসকদের নিয়ে মুসলিম ব্যক্তিবর্গের কিছু সরল কথা তোলে ধরবো। কথা স্বাভাবিক হলেও, এর প্রভাব ও শিক্ষা সুদূর প্রসারী। উদ্দেশ্য, মুসলিম চিকিৎসগণ দ্বীনি দিক থেকেও সচেতন হয়ে যেন দায়িত্ব পালন করেন। চিকিসৎসা শাস্ত্র ও অন্যান্য বিদ্যার মাঝে পার্থক্য হলো, এখানে মানুষের জীবন মরনের প্রশ্ন জড়িত। তাই চিকিৎসা শাস্ত্রের কোনো অসম্পূর্ণতা নিয়ে মানুষের সেবা করা মানে মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করা। সনদ থাকার কারণে, ভুল চিকিৎসা করে মানুষ মারলে দুনিয়ার আদালতে হয়তো ছাড় পেয়ে যাবে, কিন্তু বিবেকের দংশন ও আখেরাতের যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি থেকে কখনো মুক্তি পাবে না। (চলবে)


বিভাগ : ইসলামী জীবন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

মা-বাবাকে কখনো ভুলে যাবেন না, তাদের খিদমত করুন: হযরত আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী
'শবে বরাত', আল্লাহর রহমত,ক্ষমা ও সামাজিক সম্প্রীতির রাত
রমজানের প্রস্তুতি হোক শাবান থেকেই
শবেবরাতে করণীয় ও বর্জনীয়
জাহান্নাম থেকে বাঁচবো কীভাবে
আরও

আরও পড়ুন

ট্রাম্প-পুতিন আলোচনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের সূচনা

ট্রাম্প-পুতিন আলোচনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের সূচনা

বিপ্লবীরা ও আ.লীগ একসঙ্গে এ দেশে থাকতে পারে না : হাসনাত

বিপ্লবীরা ও আ.লীগ একসঙ্গে এ দেশে থাকতে পারে না : হাসনাত

পটুয়াখালী জেলা ছাত্রদলের আহবায়ক,যুগ্ম আহবায়ক ও সদস্য সচিবকে কারণ দর্শানোর নোটিশ

পটুয়াখালী জেলা ছাত্রদলের আহবায়ক,যুগ্ম আহবায়ক ও সদস্য সচিবকে কারণ দর্শানোর নোটিশ

দুই দিনের সফরে পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট এরদোগান

দুই দিনের সফরে পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট এরদোগান

দুবাই পৌঁছেছেন প্রধান উপদেষ্টা

দুবাই পৌঁছেছেন প্রধান উপদেষ্টা

তাইওয়ান প্রণালীতে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ! পাল্টা হুঁশিয়ারি চীনের

তাইওয়ান প্রণালীতে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ! পাল্টা হুঁশিয়ারি চীনের

চার লাল কার্ডের ম্যাচে লিভারপুলকে রুখে দিল এভারটন

চার লাল কার্ডের ম্যাচে লিভারপুলকে রুখে দিল এভারটন

রিজওয়ান-সালমানের অনবদ্য সেঞ্চুরিতে পাকিস্তানের রান তাড়ার রেকর্ড

রিজওয়ান-সালমানের অনবদ্য সেঞ্চুরিতে পাকিস্তানের রান তাড়ার রেকর্ড

কফিন কাঁধে মিছিল, আ.লীগ নিষিদ্ধ চাইল ছাত্র-জনতা

কফিন কাঁধে মিছিল, আ.লীগ নিষিদ্ধ চাইল ছাত্র-জনতা

শিরোপার স্বপ্ন নিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বাংলাদেশ

শিরোপার স্বপ্ন নিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বাংলাদেশ

মেয়েদের ক্রিকেট

মেয়েদের ক্রিকেট

এতীমের মা খ্যাত ফুলতলীর বড় ছাহেবের সহধর্মিণীর জানাযায় মানুষের ঢল : বিভিন্ন মহলের শোক

এতীমের মা খ্যাত ফুলতলীর বড় ছাহেবের সহধর্মিণীর জানাযায় মানুষের ঢল : বিভিন্ন মহলের শোক

নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছাড়া কেউ সংবিধান সংশোধন করতে পারে না

নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছাড়া কেউ সংবিধান সংশোধন করতে পারে না

মুন্সীগঞ্জে থেমে থাকা বাসে আগুনে ঘুমন্ত হেলপারের মৃত্যু

মুন্সীগঞ্জে থেমে থাকা বাসে আগুনে ঘুমন্ত হেলপারের মৃত্যু

ডেভিল হান্টে ধরা আরো ৫৯১ জন

ডেভিল হান্টে ধরা আরো ৫৯১ জন

ডেভিল হান্ট অপারেশনে আশানুরূপ অস্ত্র উদ্ধার হয়নি :গাজীপুরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

ডেভিল হান্ট অপারেশনে আশানুরূপ অস্ত্র উদ্ধার হয়নি :গাজীপুরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

পুলিশে আস্থা ফেরাতে ডিসিদের প্রস্তাব

পুলিশে আস্থা ফেরাতে ডিসিদের প্রস্তাব

বিলুপ্তির পথে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য মৃৎশিল্প

বিলুপ্তির পথে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য মৃৎশিল্প

নাফিজের নিথর দেহের সেই ছবির স্কেচ জাতিসংঘের প্রতিবেদনের প্রচ্ছদে

নাফিজের নিথর দেহের সেই ছবির স্কেচ জাতিসংঘের প্রতিবেদনের প্রচ্ছদে

তিন ফুট বাই এক ফুটের সেল, টয়লেট ও বিছানা

তিন ফুট বাই এক ফুটের সেল, টয়লেট ও বিছানা