তাদের মানবতাবাদ ও ইসলাম
০৭ জুলাই ২০২৩, ১০:১৯ পিএম | আপডেট: ০৮ জুলাই ২০২৩, ১২:০১ এএম
মানুষ সম্পর্কে অস্তিত্ব ও মূল্যবোধের দৃষ্টিতে বিভিন্ন ধরনের চিন্তা ধারা বিদ্যমান। কারও মতে মানুষ সর্ব শ্রেষ্ঠ জীব। তবে অনেকের ধারণা অন্য সাধারণ প্রাণীর ন্যায় মানুষও একটি প্রাণী মাত্র। অনেক মনীষী মানুষকে বরং অন্য প্রাণীর চেয়ে অধম মনে করেন। তাদের ধারণা মানুষ এ গ্রহের প্রাণী নয়, কিন্তু তারা এ গ্রহে এসে অন্যান্য প্রাণীদের উপর জবর দখল করে পৃথিবীতে বসবাস করছে। তবে পৃথিবীতে যেহেতু একমাত্র মানবজাতি সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছে, ফলে অন্য প্রাণীদের সাথে উত্তম অধমের তুলনা করাও অযৌক্তিক। প্রশ্ন হলো অন্য প্রাণী আর মানুষের বৈশিষ্ট্যগত তফাৎ কি? মানুষের প্রকৃত সত্তা কি? এবং তার মধ্যে কি ধরনের শক্তি ও যোগ্যতা প্রচ্ছন্ন রয়েছে? এ সকল উত্তর খুঁজতে গিয়ে দার্শনিকগন সমাজে নতুন মতবাদের জন্ম দিয়েছেন।
এক্ষেত্রে মোটামুটি বিপরীতমুখী দৃষ্টি ভঙ্গি বিদ্যমান। প্রথমত: মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বনির্ভর একটি সত্তা, সে তার সাফল্য ও সৌভাগ্যের পথ নিজেই নির্ধারণ করতে সক্ষম। এবং নিজেই তার ভাগ্য চিত্রিত করতে পারে। স্বাধীন সত্তা হিসেবে নিজেই নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। দ্বিতীয়ত: মানুষ একটি স্বাধীন, বিবেকবান সত্তা হলেও সে সকল জ্ঞানের অধিকারী নয়। এবং তার মস্তিষ্ক-প্রসূত জ্ঞান পথ প্রদর্শনের জন্য যথেষ্ট নয় বরং সে ঐশী পথ নির্দেশনার মুখাপেক্ষী। বিগত ছয় শতাব্দীর চেষ্টা-প্রচেষ্টার পর প্রথম দৃষ্টিভঙ্গিটি তাত্ত্বিক রূপ লাভ করে এবং মানব জীবনের সকল ক্ষেত্রে এর সর্বোচ্চ প্রয়োগের চেষ্টা শুরু হয়। তবে প্রথম ও দ্বিতীয় মতবাদের মূল আলোচ্য বিষয় হলো মানুষের মুক্তি ও সফলতা। এজন্য ঐশী ধর্মসমূহ মানুষের মূল্যবোধ সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছে। যাতে মানুষের প্রকৃতি অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট সমাধানে পৌঁছা যায়।
অন্যদিকে পাশ্চাত্য তৈরি মানবতাবাদ মানুষের সৃষ্টি তত্ত্বের চেয়ে বস্তুবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। কারণ হলো: এর ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন গ্রীসের পৌরাণিক কাহিনীর দৃষ্টিভঙ্গির উপর। আমরা দেখি, এসব কাহিনীতে স্বর্গ ও মর্ত্যের (দেবতাদের জগৎ ও মানব জগৎ) মধ্যে প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, এমনকি প্রতিহিংসা পর্যন্ত কাজ করে। সেখানে দেবতারা মানুষের বিরুদ্ধ শক্তি। মানুষের উপর স্বৈরাচারী কায়দায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালানো হলো দেবতাদের কাজ। মানুষেরা যেন আত্মসচেতনতা, স্বাধীনতা ও মুক্তি অর্জন করতে না পারে এবং প্রকৃতির উপর জয়ী হতে না পারে – দেবতাদের সার্বক্ষণিক সংগ্রাম ও মনোযোগের বিষয় হলো তা নিশ্চিত করা। মানুষ মুক্তির পথে পা বাড়ানোর ন্যূনতম পদক্ষেপ নিলেই তা বিরাট পাপ ও ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বলে বিবেচিত হয়। একে পরকালের সবচাইতে কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে নিন্দা করা হয়। এমতাবস্থায়, এই বন্দীদশা থেকে মুক্তির জন্য মানুষ যে সর্বদাই প্রচেষ্টা চালিয়ে যেত, তা আমরা সহজেই বুঝতে পারি। ঐশ্বরিক ক্ষমতা অর্জন করার মধ্য দিয়ে মানুষ স্বাধীনতা অর্জনের চেষ্টা করতো, যেন সর্বশক্তিমান দেবতাদের খপ্পর থেকে নিজের নিয়তিকে মুক্ত করা যায় এবং নিজের স্বাধীন ইচ্ছার আলোকে নিজের ভবিষ্যত গড়ে নেয়া যায়। ডেনিস দিদেরো ও ভলতেয়ার থেকে শুরু করে ফয়েরবাখ ও মার্ক্স পর্যন্ত আধুনিক মানবতাবাদীদের সকলে প্রাচীন ধর্মগুলোর আধ্যাত্মিকতা ও পবিত্রতাকে প্রাচীন গ্রীসের পৌরাণিক জগতের মত করেই দেখেছেন। অথচ পৌরাণিক কাহিনীর সাথে মহান আল্লাহ প্রদত্ত জীবন ব্যবসস্থার ঢের তফাৎ রয়েছে। কারণ মহান আল্লাহ নিজেই তার নবীদের কাছে ওহী প্রেরণ করে মানুষকে অন্ধকার থেকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেছেন।
মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন: (হে মুহাম্মাদ) এটি এমন একটি কিতাব, তোমার প্রতি এটি নাযিল করেছি, যাতে তুমি লোকদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোর মধ্যে নিয়ে আসো (সূরা ইব্রাহীম:১)।
ফ্রানঞ্জ ফানোঁ (১৯২৫-১৯৬১) তাঁর বিখ্যাত বই ইষধপশ ঝশরহ, ডযরঃব গধংশং এ আলোচনা করেন: রেনেসাঁ-প্রসূত এই মানবতাবাদের প্রথমদিকের প্রচারক ইউরোপ নিজেই পুঁজিবাদ, ঊপনিবেশবাদ ও বর্ণবাদের রোগে আক্রান্ত হয়ে মানবতাবাদকে কলঙ্কিত করেছে, চর্চা করেছে বিকৃত এক মানবতাবাদ। ঐতিহাসিকভাবে রেঁনেসার শুরুতে মানবতাবাদের ধারণাটি প্রথমে একটি সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক, চিন্তাগত ও শিক্ষা ভিত্তিক আন্দোলন হিসেবে বিদ্যমান ছিল যা পরবর্তীতে সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। এ কারণেই এ চিন্তাধারা সকল দার্শনিক, নৈতিক, শৈল্পিক ও সাহিত্যিক বিষয়কে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়।
ইউরোপের সকল মতবাদ সচেতন বা অসচেতনভাবে এ চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। কমিউনিজম, উপযোগবাদ, আধ্যাত্মবাদ, অস্তিত্ববাদ, ব্যক্তি - স্বাতন্ত্র্যবাদ, উদারতাবাদ, এমনকি মার্টিন লুথারের সংস্কারপন্থী বিরুদ্ধবাদী ( প্রোটেস্টানিজম ) ধারাসহ ইউরোপের সকল মতবাদ ও চিন্তাধারাই মানবতাবাদী দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। যদিও এ চিন্তাধারার বীজ প্রাচীন রোমান ও গ্রীক চিন্তাধারায় ছিল, কিন্তু প্রথমবারের মতো ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে রেনেসাঁর বেশ কিছু পূর্বে ইটালীর উচ্চ শ্রেণির একদল লোকের মধ্যে এ চিন্তাধারা একটি আন্দোলন রূপে প্রকাশিত হয়। অতঃপর তা সমগ্র ইটালীতে ছড়িয়ে পড়ে এবং ক্রমে ক্রমে পার্শ্ববর্তী দেশ সমূহে ও বিস্তার লাভ করে।
মানবতাবাদ বা মূল্যবোধ মূলত মানুষের ভিতর থেকে উৎপত্তি হয়। এর বাহ্যিক কোন অস্তিত্ব নেই। অতএব, এটি ভাবগত বা ব্যক্তিনির্ভর বিষয়ও বটে। এ কারণেই বাস্তববাদী বা বস্তুবাদীগণ এগুলোকে অস্বীকার করে। তাদের নিকট মূল্যবোধ স্রেফ একটি কুসংস্কার, আবেগ বা অনুভুতির নাম। কিন্তু মানব অস্তিত্বের এই মহত্তম প্রকাশকে কীভাবে অস্বীকার করা সম্ভব? তাহলে দেশের জন্য যিনি জীবন উৎসর্গ করেছেন, ব্যক্তিস্বার্থের পরিবর্তে মহত্তর আদর্শকে যিনি বেছে নিয়েছেন, ব্যক্তিগত সুখ-আনন্দের চেয়ে সামাজিক মূল্যবোধ ও কল্যাণকে যিনি বড় মনে করেন তার বিষয়টি তারা কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
ব্যক্তিবাদের প্রবক্তা বিখ্যাত দার্শনিক নীটশে একটি মালবাহী ঘোড়াকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বস্তুবাদীদের বিচারে একটি প্রাণীর জন্য একজন প্রতিভাবান ব্যক্তির জীবন দেওয়া অর্থহীন বলেই বিবেচিত হবে। তবে প্রকৃত মানবতা বা নৈতিক মূল্যবোধ মানুষের দৈহিক অস্তিত্বের চেয়েও বড় কিছু, এমনকি ব্যক্তিটি যদি প্রতিভাবানও হয়ে থাকেন। যা পশ্চিমা মতবাদ সমূহের পৃষ্ঠপোষকতায় পালিত ‘মানবতাবাদ’ বুঝতে একেবারেই অক্ষম।
বিভাগ : ইসলামী জীবন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস
শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া
ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল
‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’
প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের
প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া
মুসলিম চিকিৎসক
শীর্ষে দিল্লি
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান