হৃদয় ভাঁজে কারবালা
২৮ জুলাই ২০২৩, ০৮:৩৭ পিএম | আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২৩, ১২:০১ এএম
কারবালার ঘটনায় কাঁদেনি এমন মুসলমান পাওয়া অসম্ভব। রয়েছে এ ঘটনা নিয়ে ঐতিহাসিক তুমুল মতভেদ। এসব মতভেদে আড়াল হয়ে আছে নিরেট কিছু সত্য, যা হয়তো অনেকেরই অজানা। অপরদিকে এমন বিষাদ ঘটনা জড়ানো হয়েছে, যা লোকমুখের প্রসিদ্ধে সাধারণ মুসলমান বোঝতেই পারছেন না প্রকৃত ঘটনা কোনটি? নির্ভেজাল সঠিক তথ্য উপস্থাপন সত্ত্বেও অধির আগ্রহ পাঠকের বিকৃত ইতিহাসের প্রতি। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর দু’বছর খেলাফত শেষে হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) থেকে হযরত মুআবিয়া (রা.) পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশ্বাসঘাতক-মুনাফিক ঝাপটা মেরে বসেছিলো। চেষ্টার কমতি রাখেনি সোনালী যুগের ইসলাম ও মুসলমানদেরকে ফাঁদে ফেলে ইসলামকে মিটিয়ে দিতে। জেনে রাখা উচিত যে, মুসলমানদের মিটিয়ে দিলেও ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করা যায় না; ছিলো আছে এবং থাকবে। আর সে সুযোগটাই পেতে এসব ‘আস্তিন কা সাপ’ প্রিয়নবি (সা.) থেকে কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা পর্যন্ত লেগেই ছিল। ওহি নাজিলের মাধ্যমে নবিজি (সা.)-কে জানিয়ে দেওয়ায় সেটা পাকাপোক্ত করতে না পেরে ধারাবাহিকভাবে কারবালা পর্যন্ত আসে। সার্বিক দিক বিবেচনায় কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার দু’টি কারণ উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথমত : বিশ্বাসঘাতক-মুনাফিকদের উস্কানি। দ্বিতীয়ত : প্রিয়নবি (রা.)-এর ভবিষ্যদ্বানী। মুসলমানগণ প্রত্যেকেই এক দেহের মতো। দেহের কোথাও আঘাত পেলে যেমন সমস্ত শরীর তা জানতে পারে, তেমনি পৃথিবীর কোথাও মুসলিম আক্রান্ত হলে তাদেরকে সহযোগিতা করা।
নবিজি (সা.) মুসলমানদের উদ্দেশ্যে ইরশাদ করেনÑ ‘মুমিনদের উদাহরণ তাদের পারস্পারিক ভালবাসা, দয়ার্র্দ্রতা ও সহানুভূতির দিক থেকে একটি মানব দেহের ন্যায়, যখন তার একটি অঙ্গ আক্রান্ত হয়, তার সমস্ত দেহে ডেকে আনে তাপ ও অনিদ্রা।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৬৪৮০) এ আদর্শে চলছিলো প্রিয়নবি (সা.)-এর জীবদ্দশা থেকে খুলাফায়ে রাশেদার সোনালী যুগ পর্যন্ত। তা দেখে বিশ্বাসঘাতক-মুনাফিকরা অস্থির হয়ে পরস্পরে বিবাদ লাগানোর চেষ্টা করে। দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর খেলাফতকালে আবু লুলু নামক এক বিশ্বাসঘাতকের হাতে শাহাদাত বরণ করেন। তাঁকে শহিদ করেই ক্ষান্ত হয়নি। তৃতীয় খলিফা ওসমান ইবনে আফফান (রা.)-কে আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা নামক আরেক বিশ্বাসঘাতক শহিদ করে। অপরদিকে মুসলিম উম্মাহের কাছে গুজব ছড়িয়ে দিয়েছে যে, হযরত আলী (রা.) চক্রান্ত করে হযরত ওসমান (রা.)-কে হত্যা করিয়ে নিজে খলিফার মসনদে বসেছেন।
এই ক্রান্তিলগ্নে আম্মাজান আয়েশা (রা.)-সহ বেশ কয়েকজন সাহাবী হযরত আলী (রা.)-এর কাছে এই বলে পাঠান যেÑ তিনি যেনো ওসমান-হত্যাকারীদের দ্রুত কিসাসের ব্যবস্থা করেন। আলী (রা.) এ দাবী পূরণের আশ্বাস দেন। তাতে সাবাইরা ভয় পেয়ে ফন্দি করে; আম্মাজান আয়েশা (রা.) ও হযরত আলী (রা.)-এর মধ্যে বাঁধিয়ে দেয় যুদ্ধ। ফলে সে যুদ্ধে বড় বড় অনেক সাহাবী ও পূন্যবান লোক শাহাদাত বরণ করেন। যাকে উষ্ট্রীর যুদ্ধ বলা হয়। যুদ্ধের পর সাবাই ও তার দোসররা চক্রান্ত অব্যাহত রেখে মুসলিমদের দু’দলে বিভক্ত করে। একদলÑ অতিরিক্ত আলীভক্তি ও অপরদলÑ আলীবিদ্বেষী। এই বিদ্বেষীরা আবার দু’দলে বিভক্ত। একদলÑ নাসিবি, অপরদলÑ খারিজী। সাবাইদের এই নাপাক চক্র হযরত আলী ও মুআবিয়া (রা.)-র মধ্যে ভুলবোঝাবুঝির মাধ্যমে বাঁধিয়ে দেয় সিফফিনের যুদ্ধ। সে যুদ্ধেও হাজার হাজার মুসলমান শাহাদাত বরণ করেন। সাবাইদের প্রতারণায় খারেজীরা হযরত আলী (রা.)-কেও শহিদ করে। খলিফা চতুষ্টয়ের পর সাবাইরা তৎকালীন বিশিষ্ট বুজুর্গ হাজার বিন আদীকে অনুপ্রাণীত করে হযরত হাসান ও হোসাইন (রা.)-কে হযরত মুআবিয়া (রা.)-এর বিরোধিতা করতে।
উল্লেখ্য, বিন আদী সাবাইদের চক্রান্তে শিকার হয়ে অবশেষে সাহাবী বিদ্বেষী (মুআবিয়া রা.-এর বিরোধিতা এবং ইমামদ্বয় রা. সাবাইদের মতানুযায়ী না হওয়ায় তাঁদেরও বিরোধিতা) হয়ে যায়। জান্নাতের সর্দারগণ থেকে হযরত মুআবিয়া (রা.)-এর প্রতি আনুকুল্য জবাব পেয়ে দুষ্ট চক্রগুলো আরো জ্বলে ওঠেও ব্যর্থ হয়। ইসলাম ও মুসলিম ষড়যন্ত্রকারীদের ব্যাপারে হযরত মুআবিয়া (রা.) এতই কঠোর ছিলেন যে, তাঁর ২১ বছরের খেলাফতকালে ইবনু সাবাই গোষ্ঠী কিছুই করতে সাহস পায়নি। ৬০ হিজরিতে আমীরে মুআবিয়া (রা.) ইন্তেকাল করলে ইবনু সাবাইর প্রেতাত্মারা মিষ্টি বিতরণ করে আনন্দ করে। আফসোস! আজ অবধিকাংশ মুসলিমরা সাবাইদের শেখানো অভিশপ্ত এই প্রথা ‘মিষ্টিমুখ’ করে আসছে। (বিশ্বাসঘাতকদের ইতিহাস, পৃষ্টা-২২) আমীরে মুআবিয়া (রা.)-এর ইন্তেকালের পূর্বে ইয়াজিদ ইবনে মুআবিয়াকে ইসলামী আইনানুযায়ী খলিফা নির্বাচিত করা হয়। ইমাম হোসাইন (রা.) দ্বীন ও ইমানের আলোকে স্বার্থমুক্ত ও আন্তরিক সিদ্ধান্ত ছিলোÑ ইয়াজিদ ইবনে মুআবিয়া খেলাফতের অযোগ্য।
এ মত প্রকাশের সুযোগে সাবাইদের ষড়যন্ত্র তুমুল আকার ধারণ করে। সাবাইরা কুফা থেকে কুফার অধিবাসী সেজে প্ররোচণামূলক চিঠি লিখে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর নিকট। যা আমন্ত্রণপত্রের স্তুপ বলে ঐতিহাসিকগণ বর্ণনা দিয়েছেন। (ইতিহাসের কাঠগড়ায় হযরত মুআবিয়া রা., পৃষ্টা ৮২ ও ১২৪) এতসব চিঠি ও বার্তা পেয়ে কুফা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে পরীক্ষামূলক ইমামের চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকিলকে পাঠালেন। সেখানে তাঁকে মাত্রাতিরিক্ত কষ্ট দিয়ে শহিদ করা হয়। শাহাদাতের পূর্বে কোনো এক সময় ইমাম হোসাইন (রা.)-কে চিঠি পাঠানোর পর চিঠি পৌঁছার পূর্বেই মুসলিমকে হত্যা করা হয়। এ সংবাদ ইমামের কাছে না পৌঁছায় তিনি কুফার দিকে রওয়ানা হলেন। ইমাম হোসাইন (রা.)-এর প্রতি কুফাবাসীদের এ বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়ে কোনো তথ্যও ছিলো না ইমাম পরিবারের কাছে। তিনি প্রায় কুফায় পৌঁছেই গিয়েছিলেন। ৬১ হিজরির ৩ মুহাররম ইমাম হোসাইন (রা.); ইবনে যিয়াদ বাহিনীর মুখোমুখি হতে হয় ফোরাত নদীর তীরে।
১০ মুহাররম সকালে কারবালার প্রান্তরে এ মর্মান্তিক ট্রাজেডি সংঘটিত হয়। (কারবালা ইমাম মাহদি দাজ্জাল গজওয়ায়ে হিন্দ, পৃষ্টা ২১-৪৫) হযরত আলী (রা.) শহিদ হওয়ার পর ইমাম হাসান (রা.)-এর খেলাফতের ৬ মাস যেতে না যেতেই ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্য বোঝতে পেরে স্ব-ইচ্ছায় ইমাম হাসান (রা.) আমীরে মুআবিয়া (রা.)-এর মাঝে শান্তি চুক্তি হয়। কারণ, উষ্ট্রী এবং সিফফিন যুদ্ধের মতো মুসলিমদের রক্ত আর দেখতে না চাওয়ায় এ শান্তিচুক্তি হয়েছিলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে। আর সে সম্পর্কেই প্রিয়নবি (সা.) ভবিষ্যতবানী করেছিলেন যে, ‘হাসান বসরি (রহ) বলেন, আমি আবু বাকরাহ (রা.)-কে বলতে শুনেছিÑ রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে আমি মিম্বরের ওপর দেখেছি। হাসান বিন আলী (রা.) তাঁর পাশে ছিলেন। তিনি একবার লোকদের দিকে আরেকবার তাঁর দিকে তাকাচ্ছিলেন আর বলছিলেন, আমার এ সন্তান একজন নেতা। সম্ভবত তার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের দু’টি বড় দলের মধ্যে মীমাংসা করাবেন।’ (সহিহ বোখারি, হাদিস : ২৭০৪) মুহাদ্দিসগণ হাদিসটিকে শান্তিচুক্তির ভবিষ্যতবানী বলে উল্লেখ করেন।
আর হোসাইন (রা.) সম্পর্কে বিশ্বনবি (সা.)-এর ভবিষ্যতবানী ছিলোÑ ‘আম্মাজান আয়শা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ভূমিতে হোসাইনকে শহিদ করা হবে জিবরাঈল আমাকে সে স্থানের মাটি দেখিয়েছেন। যে ব্যক্তি হোসাইনের রক্ত ঝরাবে সে মহান আল্লাহর রোষানলে পতিত হবে। হে আয়েশা! এ ঘটনা আমাকে অত্যন্ত ব্যথিত করে। আমার উম্মতের মধ্যে কে সেই ব্যক্তি যে আমার হোসাইনকে শহিদ করবে?’ (কানজুল উম্মাল, খ--১২, পৃষ্টা-১২৭, হাদিস : ৩৪৩১৮) মুহাদ্দিসগণ এই হাদিসকে কারবালার মর্মান্তিক ট্রাজেডির ভবিষ্যতবানী বলে উল্লেখ করেছেন। সর্বোপরি, সোনালী সে-ই যুগ থেকে অধ্যাবদি মুসলমানদের পর্যদুস্ত করতে ইবনে উবাই, ইবনে সাবার প্রেতাত্মারা বিভিন্ন নামে, রঙে ও ভাষায় এসে ধোঁকা দিচ্ছে। আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে ঐশী চিন্তার মাধ্যমে রুখে দাঁড়ালে পুনরায় কারবালা ট্রাজেডির মতো ঘটনা ঘটানো অসম্ভব। তাই মুসলমানগণকে মহান প্রভু পূর্বোল্লিখিত হাদিস মোতাবেক একই দেহের মতো হয়ে বেঁচে থাকার তাওফিক দিন। আমিন।
বিভাগ : ইসলামী জীবন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস
শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া
ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল
‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’
প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের
প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া
মুসলিম চিকিৎসক
শীর্ষে দিল্লি
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান